সমাজতন্ত্রের বাস্তব ইতিহাস বা সমাজতন্ত্রের ইতিহাসের (ইংরেজি: History of socialism) সূত্রপাত ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লব ও তা থেকে উদ্ভূত পরিবর্তনগুলি থেকে, যদিও ফরাসি বিপ্লব পূর্ববর্তী আন্দোলন এবং ধারণায় সমাজতন্ত্রের নজির রয়েছে। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবে ইউরোপ আলোড়িত হবার ঠিক আগে কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ইশতেহার লিখেছিলেন যাতে তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র শব্দদ্বয় দিয়ে ধারণাটিকে অভিহিত করেছিলেন। উনিশ শতকের শেষ তৃতীয়াংশে, ইউরোপে সমাজ গণতান্ত্রিক দলগুলির উত্থান হয়েছিল, এবং সেসব দলের মতাদর্শ মূলত মার্কসবাদ থেকেই এসেছিল। অস্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টি বিশ্বের প্রথম নির্বাচিত সমাজতান্ত্রিক দল হিসেবে ১৮৯৯ সালে এক সপ্তাহের জন্য উপনিবেশ কুইন্সল্যান্ডে সরকার গঠন করেছিল।[১]
সমাজতন্ত্রের প্রায়োগিক ইতিহাস শুরু হয় বিংশ শতাব্দী থেকে। এই বিশ শতক মানবজাতির জীবনে একটা তীব্র বেগ ও সুগভীর পরিবর্তনের যুগ। প্রগাঢ় বৈপ্লবিক পুনর্গঠনে তা চিহ্নিত, যা সমাজতন্ত্রের পথ খুলে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী। বিশ্বে যে প্রক্রিয়া চলছে তা প্রতিটি লোকের কাছ থেকে তার সুস্পষ্ট উপলব্ধি, জীবনের প্রতি একটা সচেতন মনোভাব গ্রহণের দাবি করে।
সমাজতন্ত্র যে অনিবার্য, বৈজ্ঞানিকভাবে তা প্রতিপাদন করেছিলেন কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, তা নির্মাণের পরিকল্পনা রচনা করেছিলেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, আজ তা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা বাস্তব কর্মকাণ্ড। বর্তমানে সমাজতন্ত্র পরিণত হয়েছে একটা বিশ্ব ব্যবস্থায় স্বাধীন, সমাধিকারী জাতিগোষ্ঠীর একটা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহমিতালিতে। শোষণ, বুভুক্ষা, নিঃস্বতা আর বেকারি নির্মূল করেছে সমাজতন্ত্র; উৎপাদনের উপায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছে সামাজিক মালিকানা। সামাজিক মালিকানার বুনিয়াদের ওপর পরিকল্পিত জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তিতে সষ্টি করেছে প্রবল উৎপাদনী শক্তি। সমাজতান্ত্রিক সমাজ এনে দিয়েছে মেহনতিদের সামাজিক মুক্তি, তাদের বৈষয়িক অবস্থার উন্নয়নে গড়ে উঠেছে ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ বিকাশের পরিস্থিতি।
সমাজতন্ত্রের বিশ্ব ব্যবস্থা
বিশ শতকের মধ্যভাগের একটা অতি গুরত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা হলো সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা গঠন, বিশ্বে সামাজিক-শ্রেণিগত শক্তির অনুপাত তাতে পরিবর্তিত হয়েছে সমাজতন্ত্রের অনুকূলে। মেহনতিদের বৈপ্লবিক সংগ্রামে ইউরোপ, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার একসারি দেশে পুঁজিবাদী সম্পর্কের উচ্ছেদ হয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব দেশে সমাজতন্ত্রের বিজয় একটা আপতিক ঘটনা বা বাইরে থেকে আসা কোনো ব্যাপার নয়। বিপ্লবের ‘রপ্তানি’ সম্ভব নয়, কেননা এক-একটা দেশে বৈপ্লবিক পরিস্থিতি দেখা দেয় অভ্যন্তরীণ শ্রেণি বিরোধ বৃদ্ধির ফলে।
এইসব দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক বিভিন্নতা সত্ত্বেও একটা জিনিস ছিল সাধারণ – উৎপীড়িত আর উৎপীড়কদের মধ্যে সংগ্রামের চুড়ান্ত বৃদ্ধি, যা বিশ্ব সমাজতন্ত্রের ইতিহাস সমৃদ্ধ করে। এইসব দেশের প্রত্যেকটিতে শোষণের বিরুদ্ধে মেহনতিদের সংগ্রাম যুক্ত হয়েছিল জার্মান ফ্যাসিবাদ আর জাপানি সমরবাদের বিরুদ্ধে সাধারণ সংগ্রামের সঙ্গে। তাতে সাহায্য করে সোভিয়েত সৈন্যবাহিনীর সার্থক ক্রিয়াকলাপ, যা ফাসিবাদী দাসত্ব থেকে মুক্ত করে ইউরোপের অনেক জাতিকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান ফ্যাসিবাদকে চূর্ণ করায় সোভিয়েত ইউনিয়ন যে নির্ধারক ভূমিকা নেয়, তাতে প্রতিপাদিত হয় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পরাক্রম। সারা বিশ্বের জগণ দেখল যে সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসক সামরিক যন্ত্রকে প্রতিরোধের ক্ষমতা ধরে সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রের দিকে মেহনতিদের সহানুভূতি ও উন্মুখতায় সক্রিয় হয়ে ওঠে বহু দেশের বৈপ্লবিক আন্দোলন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিগুলির বিজয়ের একটা পরিণাম হলো সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার উদ্ভব।
ইউরোপের মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল এবং এশিয়ার দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের রূপ হয়ে দাঁড়ায় জনগণতন্ত্র। এ শতকের ৫০-এর দশক নাগাদ জনগণতান্ত্রিক দেশগুলিতে শিল্পের জাতীয়করণ হয়, সমাজজীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে ঘটে আমূল সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তন, অবসান হয় শোষণের। জাতীয় অর্থনীতির পরিকল্পিত বিকাশে সদৃঢ় হয় যেমন প্রতিটি দেশের অর্থনীতি, তেমনি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কও। ইতিহাসের দিক থেকে অল্প সময়ের মধ্যেই গড়ে উঠে সমাজতন্ত্রের বিশ্ব ব্যবস্থা।
তথ্যসূত্র
১. অনুপ সাদি, ২৩ মে ২০২০, “সমাজতন্ত্রের ইতিহাস হচ্ছে কয়েক শতাব্দীব্যাপী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/ideology/socialism/history-of-socialism/
২. দ. ক্লেমেন্তিয়েভ, ত. ভাসিলিয়েভা, সমাজতন্ত্রে কী বোঝায়, ননী ভৌমিক অনূদিত, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ১১৫-১১৬।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।