উপমহাদেশের সুলতানী মধ্যযুগের ইতিহাসের উৎস হিসেবে বিদেশীদের বিবরণ

উপমহাদেশের সামন্তবাদী মুসলিম প্রাক-মুঘল সুলতানী মধ্যযুগের ইতিহাসের উৎস হিসেবে বিদেশীদের বিবরণ (ইংরেজি: Accounts of Foreign Travellers of Feudal sultanate of Indian history) হচ্ছে ইতিহাস রচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস ছাড়াও আমাদের কাছে মধ্যযুগের সামন্তবাদী ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য এই উৎসটি প্রচুর ব্যবহৃত। বিভিন্ন সময়ে ভারত ভ্রমণকারী বিদেশী পর্যটক ভারতবর্ষ সম্পর্কে বিবরণ লিখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ এ দেশে এসে তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে এবং কেউ এদেশে না এসেও ভারত-প্রত্যাগত বণিক বা অন্যান্য মানুষের মুখ থেকে শুনে শুনে ভারতবর্ষ সম্পর্কে তাদের বিবরণ লিখেছিলেন। 

বিদেশী পর্যটকদের মধ্যে মরক্কোর অধিবাসী ইবনে বতুতা সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত। ১৩০৪ খ্রিস্টাব্দে তাঞ্জিয়ারে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন এবং ৭৪ বছর বয়সে ১৩৭৮ খ্রিস্টাব্দে ফেজ এ মৃত্যুবরণ করেন। ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে তিনি ভারতবর্ষে আসেন এবং দীর্ঘ ১৪ বছর এদেশে ছিলেন। মুহাম্মদ বিন তুঘলক তাঁকে দিল্লির কাজি পদে নিয়োগ করেন এবং এ পদে তিনি ৮ বছর অধিষ্ঠিত ছিলেন। এরপর তিনি সুলতানের দূত হিসাবে চীনে প্রেরিত হন। পথে জাহাজ ডুবির ফলে মালদ্বীপে এক বছর কাটিয়ে ভারতে ফিরে আসেন। ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলায়ও এসেছিলেন এবং সিলেটে হজরত শাহজালালের সঙ্গে দেখা করেছিলেন বাংলা থেকে সমুদ্র পথে জাভা, চীন ও মক্কা শরীফ ঘুরে ১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দে নিজ দেশ মরক্কোতে ফিরে যান।

বিভিন্ন দেশে ভ্রমণকালে ইবনে বতুতা তাঁর অভিজ্ঞতা তাঁর ডায়েরীতে লিখে রাখতেন। দুর্ভাগ্যক্রমে কোনো এক সময় পথে সেটা হারিয়ে যায়। দেশে ফিরে এসে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ইবনে জুজাই নামে সাধারণ্যে পরিচিত আবু আবদুল্লাহ্ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদের কাছে বর্ণনা করেন। ইবনে জুজাই তার এ অভিজ্ঞতার বিবরণ রেহালা নামে সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন।

আলাউদ্দিন খলজীর সমকালীন প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইবনে বতুতা খলজীর সুলতানী মধ্যযুগের রাজত্বকাল সম্পর্কে লিখেছেন। কারণ আলাউদ্দিন খলজীর মৃত্যুর ১৭ বছর পর তিনি এদেশে এসেছিলেন। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের দরবারে দীর্ঘদিন অবস্থানের ফলে সেই সুলতান এবং সেই সময় সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বিবরণ লিখেছেন। তাঁর রেহালায় সমকালীন রাজনীতি, বিচার ও সামরিক ব্যবস্থা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। ডাক বিভাগ, রাস্তাঘাট, কৃষিজ পণ্য, বাণিজ্য, নৌ চলাচল, সঙ্গীত প্রভৃতি সম্পর্কেও রেহালা আলোকপাত করে। 

ইবনে বতুতার রেহালার ক্রটিও আছে। বৃদ্ধ বয়সে তাঁর স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে, পথে তিনি তাঁর ডায়রীও হারিয়ে ফেলেছিলেন। ফলে ঘটনা, স্থান বা ব্যক্তির নাম, তারিখ সম্পর্কে বেশ কিছু ভুল তথ্য তার বিবরণে ঢুকে পড়েছে। সিলেটে তিনি দেখা করেছিলেন শাহ জালাল কুনিয়ার সঙ্গে, কিন্তু বলেছেন শাহজালাল তাবিজী। তাছাড়া বিদেশী হওয়ায় এদেশের রীতিনীতিও তিনি ঠিকমত বুঝতে পারেন নি। তিনি ফার্সি ভালো জানতেন না, হিন্দী কিছুই বুঝতেন না। সমায়নুক্রম সম্পর্কেও তিনি ছিলেন উদাসীন। এত কিছু সত্ত্বেও বলা যায় যে, সুলতানি আমলের উৎস হিসাবে ইবনে বতুতার রেহালা অত্যন্ত মূল্যবান।

শিহাবউদ্দিন আহমদ আব্বাস (১৩০০-১৩৫০ খ্রি:) নামক দামেশকের একজন অধিবাসী ভারতে না এসেও পর্যটকদের মুখে শুনে এদেশ সম্পর্কে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বদরউদ্দিন নামে তাশখন্দের একজন অধিবাসী কিছুদিন মুহাম্মদ বিন তুঘলকের দরবারে অবস্থান করেছিলেন। ফার্সিতে রচিত তাঁর কবিতাগুলো অনেক ঘটনার তারিখ নির্ধারণে আমাদের সাহায্য করে। পারস্যের দূত হয়ে আব্দুর রাজ্জাক ১৪৪২ খ্রিস্টাব্দে কালিকটের রাজদরবারে এসেছিলেন। তিনি বিজয়নগর রাজ্যের সমাজ ও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে একটি বিস্তারিত বিবরণ লিখেছিলেন।

সুলতানী মধ্যযুগের ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে মার্কো পোলো দক্ষিণ ভারতে আসেন। সেখানকার অশ্ব-ব্যবসা সম্পর্কে তিনি বিবরণ দিয়েছেন। তদানীন্তন প্রায় সকল ভারতীয় বন্দরেই তিনি গিয়েছেন এবং বহির্বাণিজ্যের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। ইতালির অধিবাসী নিকোলো কন্তি ১৪২০ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগরে এসেছিলেন। আলফন্সে ডি বুকার্ক নামে একজন পর্তুগীজ ভারত থেকে তাঁর রাজাকে কিছু চিঠি লিখেছিলেন। এ চিঠিগুলোর ভিত্তিতে তার ছেলে একটি বিবরণ সংকলন করেন যা থেকে পর্তুগালের সঙ্গে গুজরাটের সম্পর্কের বিবরণ জানা যায়। ইউরোপীয় অন্যান্য লেখকদের মধ্যে রুশ ব্যবসায়ী নিকিতিন ১৪৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাহমনী রাজ্যে এসেছিলেন। এ ছাড়া ভাস্কো ডা গামা, ভারথেমা, বার্বোসা, জোয়া দ্য ব্যারোস, সিজার ফ্রেডারিক মূল্যবান তথ্য লিপিবদ্ধ করে গেছেন।

ইউরোপীয় পরিব্রাজকরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এ দেশে আসলেও এবং তাঁদের বিবরণে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কেই বেশি আলোচনা থাকলেও তারা মাঝে মাঝে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কেও আলোকপাত করতেন। তুর্কিদের বিহার জয়ের কয়েক বছর পর ধর্মাস্বামী নামে একজন তিব্বতীয় ভিক্ষু বিহারের মঠ ও মন্দিরগুলো দেখতে এসেছিলেন। তিনি নালন্দা মঠে দুবছর অবস্থান করেছিলেন এবং নালন্দা মঠ ও অন্যান্য তীর্থস্থানগুলোর অবস্থা বর্ণনা করেছেন। 

তথ্যসূত্র

১. ড. আবদুল মোমিন চৌধুরী, মোকাদ্দেসুর রহমান ও আকসাদুল আলম, উপমহাদেশ ও বাংলার ইতিহাস, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, পুনর্মুদ্রণ ২০১৪, পৃষ্ঠা ২৩-২৪।

Leave a Comment

error: Content is protected !!