ইউরোকমিউনিজম বা ইউরোসাম্যবাদ (ইংরেজি: Eurocommunism) হলো ইউরোপের কতকগুলো কমিউনিস্ট পার্টি, বিশেষভাবে ইতালি, স্পেন এবং ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি ইউরোপের জন্য যে মার্কসবাদী প্রয়োগকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে তার নাম। মূলত ১৯৫৬ সনের পরে চিন-সোভিয়েত মহাবিতর্ক, হাঙ্গেরির অভ্যুত্থান এবং রুশ অর্থনীতির ব্যাপক পরিবর্তনকে ঘিরে ইউরোপে নানা রকমের ভাবনার সূত্রপাত হয়। আর এক্ষেত্রে ইতালিই এই ভাবনার পথিকৃৎরূপে আবির্ভূত হয়।[১]
যুগোস্লাভ এক সাংবাদিক ফ্রেন বারবিয়েরি প্রথম ১৯৭৫ সালের গ্রীষ্মে এই ভাবনাকে ইউরোকমিউনিজম নাম দেন। মূলত ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর তারিখে ফরাসি ও ইতালীয় কমিউনিস্ট পার্টির নীতিগত এক যৌথ ঘোষণার পর থেকে পশ্চিম ইউরোপের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি উদারনীতি ও সাম্যবাদের (কমিউনিজম) সমন্বয় বিধানে সচেষ্ট হয়।[২]
১৯৭০ সালেই এই ভাবনা স্পষ্টভাবে বিকশিত হয়। এই মতানুসারে রাশিয়ার বলশেভিক আদর্শকে সেই দেশের বিশেষ অভিজ্ঞতা বলে চিহ্নিত করা হয়। ইউরোকমিউনিস্টরা ঘোষণা করে বলশেভিকবাদ সমগ্র বিশ্বের মার্কসবাদী আদর্শ হতে পারে না, ইউরোপে তো নয়ই। তারা বলে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব অপ্রয়োজনীয়। প্রলেতারিয়েতের একদলীয় শাসনের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক উদারতাই বেশি কাম্য। গণতান্ত্রিক পথে, সংসদীয় উপায়েই সমাজতন্ত্র আসবে।
ইতালির কমিউনিস্ট পার্টি গণতান্ত্রিক সংস্কারের আওয়াজ তোলে। অন্যান্য দলের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়। মূলত ইতালির নেতা জওর্জো নেপোলিটানো ইউরোকমিউনিজমের ধ্বজাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন এবং ভুয়া কমিউনিজমের ধারনাকে সামনে আনেন। অন্যদিকে স্পেনের কমিউনিস্ট পার্টি ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে সমাজ-গণতন্ত্রী সরকারের দেশ গঠনের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে নেমে পড়ে। ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি সমাজতন্ত্রীদের সাথে এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করে। লেনিনবাদকে ইউরোকমিউনিজমের দৃষ্টিভঙ্গিতে মার্কসবাদের আবশ্যকীয় উন্নত ধারা বলে গ্রহণ করা হয় না। তাকে রুশ অভিজ্ঞতার চরিত্রে দেখা হয়। আন্তোনিও গ্রামসির চিন্তাধারা ইউরোকমিউনিজমের তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এই তত্ত্বকে প্রভাবিত করে। গ্রামসির পর থেকেই সমাজে মধ্যস্তরের ভূমিকা ইউরোপে গুরুত্বপূর্ণ বলে অনুভূত হয়।
স্পেনের কমিউনিস্ট পার্টির সংশোধনবাদী নেতা সান্তিয়াগো কেরিল্লো (১৯১৫ – ২০১২) ১৯৭৭ সালে ইউরোকমিউনিজম ও রাষ্ট্র নামে এই ভাবনার সংজ্ঞা প্রদানকারী একটি বই লেখেন। বিশ শতকের সাত ও আটের দশকজুড়ে ইউরোকমিউনিজমের বাড়বাড়ন্ত রূপ দেখা যায় যখন পশ্চিম ইউরোপের পার্টিগুলোতে সোভিয়েতের লেনিনবাদী নীতি ও তত্ত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের নিজেদের সমাজপরিবর্তনের নীতি বেছে নেয়। তারা প্রলেতারিয়েতের আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতির বিরোধিতা করে ইউরোপের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর স্বাতন্ত্র্যের কথা বলতে থাকে।
‘ইউরোকমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’-তে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কাজকর্মের অধিকার, সর্বহারার একনায়কত্বের আদর্শ প্রত্যাহার, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের সুপারিশ, সংসদীয় পথে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠা, ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বীকৃতি এবং বিরোধিতার স্বাধীনতা মেনে নেওয়া হয়।[২] এভাবেই ইউরোপে ইউরোকমিউনিজমের নামে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদের কবর রচিত হয়। ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণির একটি বিশাল অংশ এসব কথা বলে মার্কসবাদবিরোধী অবস্থান নেয় এবং সাম্রাজ্যবাদের পদলেহনকারী অপদার্থ হিসেবে নিজেদের প্রতিপন্ন করে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং স্নায়ু যুদ্ধের অবসান ইউরোপের সব বামপন্থী দলগুলোকে নব্য উদারবাদী ধারা গ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করে। মূলত ইউরোপের বামপন্থীরা পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের সেবা করছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হওয়া মাত্রই তারা মুখোশটাকে ছুঁড়ে ফেলে নিজেদের প্রতিক্রিয়াশীল কদর্য রূপকে প্রকাশ্যে আনে।
ইউরোকমিউনিজমের ধ্বজাধারীরা দলে দলে ডানপন্থী পার্টিগুলোতে যোগ দিতে শুরু করে। যেমন ইতালির ‘ডেমোক্রাটস অফ দ্য লেফট’ এবং স্পেনের ইনিশিয়েটিভ ফর কাতালোনিয়া গ্রিনস’ হচ্ছে ইউরোকমিউনিজম থেকে ডানপন্থিতে রূপ নেয়া দুটি দল। এভাবে বামপন্থী থেকে একেবারেই ডানপন্থী পার্টি তে যোগ দিয়েছে ইউরোপের শত শত দল যারা নিজেদেরকে সমাজগণতন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেয়। এদের ছাড়াও ইউরোকমিউনিজম থেকে জন্ম নিয়েছে কিছু পার্টি যারা নিজেদের নামের সাথে কমিউনিস্ট শব্দটা রাখলেও মার্কসবাদ লেনিনবাদের বিন্দুমাত্র ধার ধারে না, বরং সাম্রাজ্যবাদের সেবা করাই তাদের পরম ব্রত। এরকম দুটি পার্টি হচ্ছে ইতালির ‘কমিউনিস্ট রিফাউন্ডেশন পার্টি’ এবং স্পেনের ‘লিভিং ইউনিফাইড সোশ্যালিস্ট পার্টি অফ কাতালোনিয়া’।[৩]
তথ্যসূত্র:
১. সমীরণ মজুমদার, মার্ক্সবাদ বাস্তবে ও মননে; স্বপ্রকাশ, কলকাতা; ১ বৈশাখ, ১৪০২; পৃষ্ঠা-১৬০।
২. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৪২।
৩. লেখাটি রচনার দিন প্রাণকাকলি ব্লগে প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে রোদ্দুরে সাইটে প্রকাশের সময় ২ আগস্ট ২০১৭ তারিখে কিছুটা পরিবর্ধিত রূপে প্রকাশ করা হয়। সেখান থেকে বর্তমানে ফুলকিবাজে প্রকাশ করা হলো।
রচনাকালঃ ১৬ অক্টোবর, ২০১৩, ময়মনসিংহ।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।