বিশ্বকোষকার বা বিশ্বকোষীয় দার্শনিক জনগণের লড়াকু রাজনৈতিক দার্শনিক

বিশ্বকোষকার বা মহাকোষকার (ইংরেজি: Encyclopaedists) ছিলেন ফ্রান্সের বিদ্বান লোকদের সমাজ,  যারা ১৭৫১ সালের জুন থেকে ১৭৬৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সম্পাদক ডেনিস দিদেরো এবং জ্যাঁ লে রন্ড ডি’আলেমবার্টের অধীনে বিশ্বকোষ বা জ্ঞানকোষ রচনা ও বিকাশে অবদান রেখেছিলেন।

বিশ্বকোষীয় দার্শনিক মানুষ হচ্ছেন জনগণের মুক্তি, গণতান্ত্রিক অনুশীলন ও বিপ্লবী ধারার লেখক যারা উক্ত সমাজে অবস্থান হেতু সামন্তবাদ কিংবা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন।   

আমরা যে সময় অতিক্রম করছি তা যেন রেনেসাঁ পূর্ববর্তী ইউরোপের মধ্যযুগের সাথে তুলনীয়। বাংলাদেশ ও ভারতে অনাচারের এক পিরামিড তৈরি হয়েছে এবং উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তরা পাপাচারের জগদ্দল পাথরকে চিরস্থায়ী করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে বের হবার জন্য দরকার লড়াইয়ের এক দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতির দরকার আন্তর্জাতিক এক জ্ঞানগত আন্দোলন ও নবজাগরণ এবং শুরুটা হওয়া দরকার এখনই।

বাংলাদেশে এই জ্ঞানগত আন্দোলন যুক্ত করবে রাজনৈতিক আন্দোলনকে এবং ব্যাপ্ত করবে প্রকৃতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের সমস্ত শাখাকে এবং দর্শনের সমস্ত দিককে। এই জ্ঞানগত রাজনৈতিক আন্দোলন সম্পন্ন করবে মানুষের অতীতসৃষ্ট সমস্ত জ্ঞানের সংশ্লেষণ এবং পশ্চাৎপদতাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। এই নবজাগরণ সারা পৃথিবীর নিপীড়িত শ্রেণিকে সাহস জোগাবে ‘উৎপাদন সংগ্রাম, শ্রেণিসংগ্রাম, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা’য় এবং চালিত করবে মানবেতিহাসের সবচেয়ে মহিমান্বিত সংগ্রাম ‘দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধে’।

বিশ্ববিপ্লবের অংশ হিসেবে চালিত বাংলাদেশের এই জ্ঞানগত রাজনৈতিক আন্দোলন নবজাগরণের পরিণতিতে নিপীড়িত জনগণ সাম্রাজ্যবাদসহ পৃথিবীর সমস্ত যুদ্ধবাজ, গণহত্যাকারী, দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিকারী শয়তানদের বিচারের মুখোমুখি করতে পারবে। পৃথিবীতে যতদিন না চিরস্থায়ী শান্তির সূচনা হচ্ছে, দিকে দিকে এই জ্ঞানগত রাজনৈতিক আন্দোলন লড়াইয়ের সকল পদ্ধতিকে পরিব্যাপ্ত করে ছড়াতেই থাকবে।

কিন্তু এই কাজ অল্প আয়াসে সাধন করা যাবে না। সমসাময়িক ইস্যুতে মাথা ঠুকে হাহুতাশ করে সমাধান করা যাবে না। এজন্য স্বল্পমেয়াদে ও দীর্ঘমেয়াদে কাজ করতে হবে।  উত্তেজিত হয়ে হুটহাট কাজ করলে মুক্তি আসবে না।  দীর্ঘমেয়াদে সমাধান খুঁজতে হবে, মানবজাতির সমস্ত লড়াই, সংগ্রাম ও যুদ্ধ থেকে  শিখতে হবে এবং সেসবকে কাজে লাগাতে পথে নেমে পড়তে হবে।

কেন এই লড়াইটি হবে দীর্ঘমেয়াদে? এরকম দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ের ইতিহাস দেখতে একটু পেছনে তাকানো যাক। ১৮৪০-এর দশক থেকে ১৮৯০-এর দশক পর্যন্ত অদৃষ্টপূর্ব রকমের বর্বর ও প্রতিক্রিয়াশীল জারতন্ত্রের পীড়নের তলায় থেকে অগ্রণী ভাবনা ও সঠিক বিপ্লবী তত্ত্বের জন্য সতৃষ্ণ সন্ধান চালিয়েছিলো একটি দেশের চিন্তক ও সৃজনশীল দার্শনিকেরা। সেই ক্ষেত্রে তারা ইউরোপ ও আমেরিকার প্রতিটি ‘শেষ কথার’ অনুশীলন করেছিলেন আশ্চর্য অধ্যবসায়ে ও খুঁটিয়ে। ১৯৫০ সালের ভেতরে সেই দেশটি সকল ক্ষমতাধর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোকে অর্থনৈতিক সামরিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে ধরে ফেলে।

একইভাবে ১৯০০-এর দশক থেকে ১৯৩০-এর দশক পর্যন্ত গোটা দুনিয়ার তাবৎ জ্ঞানকে যাচাই করে আরো একটি দেশের জ্ঞানী ও চিন্তকেরা নেমে পড়েছিলেন কাজে। ১৯৭০ সালের ভেতরে সেই দেশটি ইংল্যান্ডের অর্থনীতিকে অতিক্রম করে। ২০১৫ সালে সেটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক ক্ষমতাধর দেশে পরিণত হয়।

যেই দুটি দেশের কথা বলছি সেই দেশ দুটি হচ্ছে যথাক্রমে রাশিয়া ও চীন, আর সেই দুটি দেশের বিশ্বকোষকার বা চিন্তকেরা গ্রহণ করেছিলেন তত্ত্ব হিসেবে মার্কসবাদকে। মার্কসবাদকে গ্রহণ করার সামগ্রিক মূল্যায়ন করতে গিয়ে লেনিন লিখেছেন,

“একমাত্র সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব হিসেবে রাশিয়া মার্কসবাদকে গ্রহণ করেছে অভূতপূর্ব কষ্ট ও আত্মোৎসর্গ, অদৃষ্টপূর্ব বিপ্লবী বীরত্ব, ইউরোপীয় অভিজ্ঞতার অভিজ্ঞতার সন্ধান, অধ্যয়ন, ব্যবহারিক অনুশীলন, মোহভঙ্গ, যাচাই ও তুলনার ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য উদ্যম ও নিঃস্বার্থপরতার অর্ধ শতাব্দী ব্যাপী ইতিহাসের সত্যিকারের যন্ত্রণায় উত্তীর্ণ হয়ে। জারতন্ত্রের আমলে বাধ্যতামূলক দেশান্তর গমনের কল্যাণে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাশিয়া আন্তর্জাতিক যোগাযোগের এমন একটা ঐশ্বর্য, বিপ্লবী আন্দোলনের বিশ্ব-প্রচলিত রূপ ও তত্ত্ব সম্পর্কে এমন চমৎকার জ্ঞান অর্জন করে যা পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেনি।”[১]

চীনের ইতিহাসও প্রায় একই রকমের। চীনের ইতিহাসে সেই প্রথম সাম্যবাদী মতবাদের বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, মহান স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হয়ে, হাজার হাজার শিক্ষিত যুবক ‘মানুষের কাছে’ ফিরে গেছে। দেশের মাটির সংগে গভীরভাবে মিশে চীনের গ্রামাঞ্চলের আলোকিত কৃষকের কাছে গেছে তাদের নবলব্ধ ‘জ্ঞান প্রকাশের’ জন্য, গেছে এক অপেক্ষাকৃত প্রাচুর্যময় জীবন গড়ে তোলার জন্য, তাদের কাছে মৈত্রীর আহবান জানাতে। সুন্দরতর পৃথিবী গড়ে তোলা যায় এবং একাজ তারা একমাত্র নিজেরাই করতে পারে, এই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার সমাধানের সূত্র কমিউনের আদর্শ যুবকেরা বয়ে নিয়ে গেছে মানুষের কাছে, তাদের সম্মতি ও সমর্থন লাভের আশায় এবং বিস্ময়কর সাড়াও তারা পেয়েছে প্রচারের দ্বারা, কাজের মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে তারা হাজির করেছে রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি-সম্পর্কের নতুন ধারণা।[২]

ফরাসি বিপ্লবে আমরা বিশ্বকোষকার বা বিশ্বকোষীয় মহান লড়াকু ব্যক্তিদের বিশাল অবদান দেখি। ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিক দিদেরোর বিশ্বকোষ রচনার চেষ্টা বহু বাঁধাবিঘ্ন পেরিয়ে সাফল্য অর্জন করে।[৩]

ঐ তিনটি দেশের কষ্টকর অভিজ্ঞতা আমাদেরকে শেখায় যে, শুধু এই তিনটি দেশের লড়াইকেই নয়, ইতিহাসের সমস্ত মহত্তম লড়াইকে সংশ্লেষণ করতে হবে। বাংলাদেশ বা ভারতের দিকে একটু তাকালেই আমরা দেখবো এখন ভারতের অভ্যন্তরে ও তার আশপাশে কী ঘটছে? রাজনৈতিক লড়াইয়ে আদিবাসীরা পুড়ে মরছে। মনিপুরে কাশ্মীরে আজাদির লড়াই চলছে। গোর্খাল্যান্ড আলাদা হতে চায়। মাওবাদীরা ভারতের লাল করিডোরে মাটি কামড়ে থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ ও মার্কসবাদী লড়াই চলছে। দেশগুলো স্বাধীনতার জন্য লড়ছে, জাতিগুলো মুক্তি চাচ্ছে এবং জনগণ নিজেদের সাম্যবাদী পৃথিবী বানানোর জন্য লড়ছে।

আর এসবের ভেতরে পাহাড় ধ্বসে ১৩ জুন, ২০১৭তে বাংলাদেশে শখানেক মানুষ মরে গেল। বাংলাদেশে যখন তখন লঞ্চগুলো উলটে যায়। প্রতিদিন অন্তত ২৫ জন মানুষ স্রেফ গাড়ি দুর্ঘটনায় মরে যায় এই বাংলাদেশে। যারা স্রেফ গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায় তারা যে জাপানি সাম্রাজ্যবাদ আর প্রাইভেট গাড়ি ব্যবসা, টয়োটা, টাটার কারণে মরে সেটি কী আমরা বুঝতে পারি? কত তুচ্ছ হয়েছে বাংলাদেশে আজ মানুষের মৃত্যু!!!! না, এইভাবে মানুষের মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না।

কিন্তু এই যে মানুষের অহরহ মৃত্যুর পাহাড় তা একদিনে নেমে আসেনি, এবং একদিনে থামানো যাবে না। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাইলে একটি বৃহৎ জ্ঞানগত আন্দোলন ও নবজাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। এই আন্দোলনের জন্য দরকার এমন কিছু রাজনৈতিক দার্শনিক বিশ্বকোষীয় মানুষ সাম্যবাদী নেতা যারা জনগণের জন্য অবিরাম শ্রম দিয়ে যাবেন। এইরকম বিশ্বকোষীয় মানুষ যেকোনো স্থানেই তৈরি হতে পারে, কিন্তু তাকে হতে হবে জনগণের জন্য দায়বদ্ধ এক লড়াকু মানুষ। এরকম বিশ্বকোষীয় মানুষ তৈরির সমস্যা তিনটি সমস্যা তথা সংকীর্ণতাবাদ, মতান্ধতাবাদ ও আঞ্চলিকতাবাদকে মোকাবেলা করা প্রয়োজন মুক্তির স্বার্থেই।

রাশিয়া ও চীন যে যন্ত্রণায় উত্তীর্ণ হয়ে মার্কসবাদকে গ্রহণ করেছিল, বাংলার যন্ত্রণা হয়ত তার চেয়ে কঠিন হবে, কিন্তু এই বিপ্লবটি হবে তার চেয়েও বেয়াড়া এবং বেপরোয়া।  রাশিয়া এবং চীনের কতিপয় বিশ্বকোষকার বা বিশ্বকোষীয় বুদ্ধিজীবী এবং দার্শনিকেরা নিশ্চিত হয়েছিলেন যে মার্কসবাদ ছাড়া অন্য কোনোভাবে মুক্তির পথ নেই, তাই তারা সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেন মার্কসবাদ জানা, প্রচার করা এবং এটার অনুশীলনে।

একইভাবে বাংলাদেশের বিশ্বকোষকার, লেখক, দার্শনিকদের আজ একই পথে নামতে হবে। আমাদের প্রস্তুতিই বাংলাদেশসহ সব নিপীড়িত দেশের জনগণকে বাঁচাতে পারে। আমাদের সেই সময় নাই সময় নাই বলার মানেই হচ্ছে সমস্যা না বুঝে অযথা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা, বাংলায় যাকে বলা হয় গোয়া দিয়া হিমালয় ঠেলা।

আরও পড়ুন

তথ্যসূত্র

১. ভি আই লেনিন, ‘কমিউনিজমে বামপন্থার শিশু রোগ‘ চার ভাগে সম্পূর্ণ, চতুর্থ ভাগ, পৃষ্ঠা ১৪-১৬
২. এডগার স্নো, চিনের আকাশে জাগে লাল তারা, তৃতীয় খণ্ড, অধ্যায় পাঁচ, লাল রঙ্গমঞ্চ, প্যারা ২৯
৩. এই বিষয়ে পড়ুন, সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৫১।

রচনাকাল: ২৫ জুন ২০১৪ ও ১৪ জুন ২০১৭

Leave a Comment

error: Content is protected !!