গোথা কর্মসূচির সমালোচনা (ইংরেজি: Critique of the Gotha Programme) দলিলটি কার্ল মার্কস ১৮৭৫ সালের মে মাসে জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক ওয়ার্কার্স পার্টির খসড়া কর্মসূচির উপরে লেখেন দলটির একত্রিশ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবার কিছুদিন পূর্বে। এই দলিলে পার্টির আসন্ন কংগ্রেসে প্রস্তাবিত কর্মসূচির বিভিন্ন ক্ষেত্রে মার্কস আপত্তি করেন, যেসব কর্মসূচিতে জার্মান শ্রমিকদের সাধারণ সংগঠনের তাত্ত্বিক অর্থে পিচ্ছিল ও সংস্কারবাদী অবস্থান প্রতিফলিত হয়েছিল।[১]
১৮৯১ সালে এঙ্গেলস গোথা কর্মসূচির সমালোচনার এক সম্পাদিত ভাষ্য প্রকাশ করেন, তবে তিনি পার্টির নেতাদের প্রশমিত করতে কিছু কঠোর মন্তব্য বর্জন করেন। সমালোচনাতে মার্কস তাঁর সাম্যবাদ ও প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের তত্ত্ব প্রয়োগ করেন ‘যেমনি পুঁজিবাদের আসন্ন পতনের ক্ষেত্রে, তেমনি ভবিষ্যৎ কমিউনিজমের ভবিষ্যৎ বিকাশের ক্ষেত্রেও[২]।
এই রচনায় সর্বাধিক পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে রাষ্ট্র এবং ও প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব সম্পর্কে মার্কস এঙ্গেলসের চিন্তাধারা। কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার-এ করা হয় প্রথম পদক্ষেপ, দেওয়া হয় রাষ্ট্র এবং ও প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব বিষয়ক শিক্ষার প্রথম এবং তখনও অনেকটা বিমূর্ত সূত্র, কিন্তু ১৮৪৮ সালের অভিজ্ঞতার পর মার্কস বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্র ‘ভেঙে ফেলার’ প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন; আর ১৮৭১ সালে, প্যারিস কমিউনের পরে, মার্কস ব্যাখ্যা করেন ঠিক কি দিয়ে সে রাষ্ট্রযন্ত্র বদলানো যায়। গোথা কর্মসূচির সমালোচনায় আছে মার্কসের নিম্নলিখিত বিখ্যাত বিচারটি যা হচ্ছে রাষ্ট্র এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে তার সমগ্র বৈপ্লবিক শিক্ষার খতিয়ান স্বরূপ।
‘পুঁজিবাদী এবং কমিউনিস্ট সমাজের মাঝখানে রয়েছে প্রথমটির দ্বিতীয়টিতে বৈপ্লবিক রূপান্তরের পর্যায়। এই পর্যায়টিই হচ্ছে রাজনৈতিক অন্তর্বর্তী পর্যায়, এবং এই পর্যায়ের রাষ্ট্র প্রলেতারিয়েতের বৈপ্লবিক একনায়কত্ব ছাড়া অন্য কিছু হতেই পারে না।’
গোথা কর্মসূচির সমালোচনায় রয়েছে ভবিষ্যৎ সমাজের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ এবং অধীত হচ্ছে কমিউনিজমের বিকাশ ও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলোপের মধ্যেকার সম্পর্ক। এখানে মার্কস অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্পন্ন করেন। তিনি উদ্ঘাটন করেন কমিউনিস্ট সমাজের দুটি স্তর। প্রথম স্তরটি অর্থাৎ কমিউনিজমের নিম্নতম স্তরটি সাধারণত সমাজতন্ত্র বলে পরিচিত। তার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে উৎপাদনের উপায়ের উপর সামাজিক মালিকানার পরিবেশে বৈষয়িক সম্পদ বন্টনের পদ্ধতি হচ্ছে শ্রম অনুসারে বন্টন। সামাজিক কল্যাণে যে পরিমাণ শ্রম প্রয়োজন সেই পরিমাণ শ্রম বাদ দিয়ে কর্মী সমাজের কাছ থেকে ঠিক ততটাই পাবে, যতটা সে সমাজকে দিয়েছে। কমিউনিজমের উচ্চতম স্তরে, যখন উৎপাদনী শক্তি এবং সামাজিক শ্রমের উৎপাদনশীলতার বিকাশের উচ্চ মান বৈষয়িক সম্পদের প্রাচুর্য সৃষ্টি করবে, কার্যকর হবে বন্টনের ভিন্ন নীতি: ‘প্রত্যেকে দেবে আপন ক্ষমতা অনুসারে, প্রত্যেকে পাবে আপন চাহিদা অনুসারে!’
খসড়া কর্মসূচিটির মার্কস ও এঙ্গেলস কৃত তীব্র সমালোচনা সত্ত্বেও তা সামান্য কিছু পরিবর্তনের পর গোথায় অনুষ্ঠিত মিলনকারী কংগ্রেসে গৃহীত হয়।
মার্কস ও এঙ্গেলস যেমনটি আগেই দেখতে পেয়েছিলেন, গোথায় অর্জিত পচা আপস-মীমাংসা পার্টির পরবর্তী বিকাশের উপর ছাপ ফেলে। মিলনের ফলে ‘কিছু ইঁচড়ে পাকা ছাত্র আর বুদ্ধির চেঁকি অধ্যাপকের গোটা একটি দঙ্গল’ পার্টিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তাতে বৃদ্ধি পেতে থাকে তাত্ত্বিক নৈরাজ্য। এ সমস্ত কিছু অচিরেই পার্টির অনেক নেতাকে দ্যুরিঙের ক্ষুদে-বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট করে।[৩]
তথ্যসূত্র
১. শামসুদ্দিন চৌধুরী, মার্কস অভিধান, মধ্যমা ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, পৃষ্ঠা ৮৪।
২. ভি আই লেনিন, ইয়েভগেনিয়া স্তেপানভাতে উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ১৫১।
৩. ইয়েভগেনিয়া স্তেপানভা, এঙ্গেলস, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর ২০১২, পৃষ্ঠা ১৫১-১৫২।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।