বাঙালির আত্মপরিচয় ও তাদের নবজাগরণ বা রেনেসাঁস ও আত্মশক্তি বিষয়গুলোকে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দেখেছেন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতার জায়গা থেকে এক নিপীড়িত জাতির জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিকশিত হবার দৃষ্টিভঙ্গিতে। তিনি জাতীয়তাবাদের পরিপূরক আন্তর্জাতিকতাবাদকে অবলম্বন করে মানব জাতির অংশ হিসেবে বাঙালির জাগরণ ও বাংলার জনগণের প্রগতিকে কামনা করেন।
বাঙালির যে রাষ্ট্রটি বাংলাদেশ নাম ধারণ করে টিকে থাকার চেষ্টায় নিয়োজিত সেই রাষ্ট্রটি ও তার মানুষগুলোর কর্মপ্রচেষ্টাকে তিনি বারবার মূল্যায়ন করেন। তার কাছে রাষ্ট্র শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, রাষ্ট্র তার কাছে কেবল আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক নয়, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ একটি ঐক্যবদ্ধ সুদৃঢ় শক্তিমান সমৃদ্ধিমান মানবজীবনের সারাৎসার; যে জীবন গড়ে তুলেছেন হাজার বছরের চেষ্টায় সেসব মনীষারা যারা নিজেদের বাঙালি বলে আত্মপরিচয় নির্ধারণ করেছেন। এই আত্মপরিচয় এমনি এমনি আসেনি; কত শত লেখক, সাহিত্যিক, দার্শনিক, চিন্তক, রাজনীতিকের চেষ্টার ফলে আজকের এই বাংলাদেশ, যাকে নিয়ে আমরা হতাশাগ্রস্ত। বাংলাদেশ ও বাঙালির শত ব্যর্থতার মাঝেও তিনি সর্বদাই আশাবাদি, তবে এই আশাবাদ নিছক আশার ছলনা নয়; এই আশার সারমর্ম আছে বাঙালির ইতিহাস ও তাদের বেঁচে থাকার অদম্য জীবনীশক্তিতে, যে জীবনীশক্তি না থাকলে অনেক বিলুপ্ত জাতির মতো বাঙালিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।
বাঙালির আত্মপরিচয় ও জীবনীশক্তির অন্যতম প্রকাশ তার ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতি আর এসব বিষয়ে তিনি ক্রমাগত লিখে চলেছেন। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যত সম্পর্কে তিনি কখনোই নিরুদ্বেগ ছিলেন না। বাঙালির রাজনীতি ও সংস্কৃতির শক্তি সম্পর্কেও তিনি ওয়াকিবহাল আর বাংলা ভাষার সহজীকরণের জন্য তার চেষ্টার কমতি নেই।
বিশ শতকের বাঙালির আত্মপরিচয় সংক্রান্ত সমস্ত বিতর্ককে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়েছে। মোগল আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ উপনিবেশ অতিক্রমকালীন দীর্ঘ প্রায় চারশ বছর (১৫৭৫-১৯৭১) বাঙালির পরাধীনতার কাল; যে পরাধীনতার কালে বাঙালির সৃষ্ট সম্পদ লুট হয়ে চলে গেছে অন্যত্র। আমরা জানি, প্রতিটি জাতির জীবনেই উত্থান-পতন আসে; বাঙালির জীবনেও উত্থান-পতন অবধারিতরূপেই অন্যান্য জাতির মতোই ক্রিয়াশীল ছিলো। দক্ষিণ ভারতীয় সেন শাসনামল এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভকালীন ১২০৪ সাল পরবর্তী পরাধীনতা কাটিয়ে উঠে যে বাঙালি চতুর্দশ শতকে নিজের আত্মপরিচয় নির্ধারণ করেছিলো তারা আজ বিশ শতকের শেষে একুশ শতকের শুরুতে কীভাবে কোথায় আছে তা গভীর একাগ্রতা ও শ্রমের সাথে খুঁজে বের করেছেন তিনি। বাঙালির জীবন ও সংগ্রামের ইতি-নেতির সমস্ত দিককে বিবেচনায় নিয়ে তিনি দেখাতে চেষ্টা করেছেন বর্তমানকালীন ইঙ্গ-মার্কিন আধিপত্য সত্বেও আমাদের ভয় নেই। কোনো কোনো জাতির জীবনে দুর্যোগ-দুর্বিপাক আসে, কিন্তু তা সাময়িক; যৌথ চেষ্টার দ্বারা তা কাটিয়ে ওঠা যায়; বাঙালিও তার অন্ধকার কাল কাটিয়ে উঠবে; বাঙালার মানুষ পৃথিবীতে অগ্রগামি চিন্তার অধিকারী হবে, বদলে দেবে পৃথিবীকে।
ভবিষ্যতের বাঙালি ও তাদের আত্মপরিচয় সম্পর্কে তিনি অনুক্ষণ ভাবেন এবং কখনো কখনো মনে হয় এ চিন্তা তাকে সম্মোহিত করে রাখে। বাঙালির জাগরণ, রেনেসাঁস, রাজনীতি, চিন্তা, পুনর্গঠন, অভিব্যক্তি, প্রকৃতি, ক্ষমতাকাঠামো ইত্যাদি সম্পর্কে দীর্ঘদিন তিনি ভেবেছেন এবং এখন অনায়াসে বাঙালি সম্পর্কে মতামত দিতে পারেন। তিনি স্বপ্ন দেখেন বাঙালি অনতিবিলম্বেই একটি সুসংগঠিত স্বশাসিত জাতি হিসেবে নিজেদেরকে পরিচিত করে তুলবে পৃথিবীতে। এই স্বপ্নের ভেতরে তিনি মোহাচ্ছন্ন নন বরং তিনি বাঙালির দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাগুলো সম্পর্কে সচেতন। ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩ সালেই তিনি লিখেছিলেন‒
“বাঙালির জাতীয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে দেশি এবং বিদেশি সকল ঐতিহাসিকই মূলত দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেনঃ এক. বাঙালি কল্পনাপ্রবণ, ভাবালু, সৌন্দর্যানুরাগী, স্পর্শকাতর, দুর্বলচিত্ত, চিন্তাশীল, ভাবুক, কবিস্বভাব ইত্যাদি। দুই. বাঙালি কলহপ্রবণ, ঈর্ষাপরায়ণ, পরশ্রীকাতর, অদূরদর্শী, ভীরু, সাহসহীন, স্ত্রীস্বভাব, আরামপ্রিয়, অলস, হুজুগে ইত্যাদি।
প্রথমটি বাঙালির গুণের দিক আর দ্বিতীয়টি দোষের দিক হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। অতীতে ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে বাঙালি তার স্বভাব ও চরিত্রের যে স্বাক্ষর রেখে এসেছে, তাতে বাঙালির জাতীয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এসব মন্তব্যকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে আমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে, জাতীয় চরিত্র বা জাতীয় বৈশিষ্ট্য অমোঘ নিয়তির মতো কোনো দুর্লঙ্ঘ্য ব্যাপার নয়; জাতীয় সাধনা ও জাতীয় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতীয় চরিত্র ও জাতীয় বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব এবং পৃথিবীর অনেক জাতি তা করতে সক্ষম হয়েছে। মানবজাতির ইতিহাসে দুর্বল রাষ্ট্রের প্রবল হওয়ার এবং প্রবল রাষ্ট্রের দুর্বল হওয়ার দৃষ্টান্তের অভাব নেই। সভ্যতার ধারায় উত্থান-পতন আছে। মানুষ নিজেরই কর্মফল ভোগ করে, জাতিও ভোগ করে নিজের কর্মফল। উন্নতি করার মতো কর্মফল ব্যক্তি ও জাতিকে অর্জন করতে হয়।”[১]
বাঙালির আত্মপরিচয় ও নবজাগরণ
তিনি বাঙালির আত্মপরিচয় ও আত্মশক্তিকে জাগরিত করতে চান; এই জাগরণকে তিনি রেনেসাঁস নামে অভিহিত করেন। তার রেনেসাঁস চৌদ্দ, পনের ও ষোলো শতকের ইউরোপে উদ্ভুত শিল্প, সাহিত্য ও চিন্তার ক্ষেত্রে যে নবজাগরণ শুধু তাই নয়। তার রেনেসাঁস শুধু বাঙালির উনিশ শতকের নবজাগরণও নয়। তিনি রেনেসাঁস বলতে বোঝেন ইউরোপের রেনেসাঁস থেকে আরম্ভ করে বর্তমান কাল পর্যন্ত সকল মহান ব্যক্তির চিন্তার সংশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন চিন্তার উদ্ভব। বাঙালির জাগরণ বলতে তিনি বোঝেন অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে মানবজাতির সৃষ্ট সকল জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সামনে এগোনোর পথ নির্মাণ এবং এই পথই তার কাছে রেনেসাঁসের পথ। প্রচলিত চিন্তাধারা ও বিধিব্যবস্থাকে উৎখাত করে উন্নততর নতুন চিন্তাধারা ও বিধিব্যবস্থা প্রণয়নই রেনেসাঁসপন্থিরা করেন। পুরাতন শৃঙ্খলাকে তারা ভাঙতে চান উন্নততর নতুন শৃঙ্খলা প্রবর্তন করার জন্য‒বিশৃঙ্খল অবস্থাকে স্থায়ী করার জন্য নয়।
অধ্যাপক আবুল কাসেম জলুল হকের একটি বক্তৃতা শুনুন ইউটিঊব থেকে
রেনেসাঁসপন্থিরা কাজ করেন সদর্থক, ধনাত্মক, গঠনমূলক, সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। উন্নততর নৈতিক চেতনা ও সৃষ্টিশক্তি অবলম্বন করে তারা সামনে চলেন। অদম্য মনোবল নিয়ে যাত্রাপথের বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে তারা লক্ষ্য অর্জন করেন। রেনেসাঁস মানেই তার কাছে গতানুগতি, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নতুন সৃষ্টির ও প্রগতির জন্য চিন্তা ও কাজ করা। তিনি জাতীয় ঐক্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও প্রগতিকে অবলম্বন করে বিচারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রেনেসাঁসের পথে হাঁটতে চান। তিনি মানেন, অতীতের রেনেসাঁসে সবকিছুই ভালো, নির্ভুল ছিলো, নিখুঁত ছিলো‒ কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিলো, তা নয়। তবে সকল সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও তাতে মহান এমন কিছু ছিলো যা অতুলনীয়। রেনেসাঁসের মনীষীদের সৃষ্টি পতনশীল জাতিকে নবউত্থানে সহায়তা করে।[২] রেনেসাঁসকে তিনি গ্রহণ করতে চান বাঙালির জীবন সুন্দর, সমৃদ্ধ, আনন্দময় ও গতিশীল করে উন্নত সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যেতে।
অর্জিত শক্তিকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন যেমন গুরুত্ব দিয়েছেন জ্ঞানকে। তিনি বারবার বলেছেন সেই পুরোনো কথাটি যে জ্ঞানই শক্তি। এই কথাটিকে মার্কিনীরা অক্ষরে অক্ষরে প্রতি মুহুর্তে মেনে চলে অথচ অন্য সব জাতিকে তারা জ্ঞান দিতে চায় না, অন্যান্য জাতিগুলো জ্ঞান অর্জন করুক এটাও মার্কিনীরা চায় না। জ্ঞানের মূল্য বোঝে মার্কিনিরা, তাই জ্ঞানার্জনে তাদের ক্লান্তি নেই; অথচ অন্যান্য জাতিগুলোর জন্য তারা নতুন প্রবাদ তৈরি করেছে তথ্যই শক্তি। জ্ঞানের সমঝদার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদিরা অন্য জাতিগুলোকে তথ্যের জালে আটকাতে চায়।
আমরা বাঙালিরাও জ্ঞানার্জন বাদ দিয়ে তথ্যজালে আটকে গেছি। এর বিপরীতে আবুল কাসেম ফজলুল হক জ্ঞানার্জনকে প্রাধান্যে রেখে আত্মনির্ভরতাকে সিঁড়ি হিসেবে মেনে নিয়ে অনুশীলনকে আঁকড়ে ধরে বাংলাদেশকে গড়তে চান। জ্ঞানকে শক্তিরূপে তিনি মূল্যায়ন করেন ঠিকই, কিন্তু জ্ঞানকে অনুশীলনে যুক্ত করে তার ফলাফলকে দেখে নেবার প্রয়াসীও তিনি। দৈনন্দিন জীবনে তিনি আয়েশী-বিলাসী জীবনধারণ করেননি, কারণ তিনি জানেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক-শ্রমিক বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন না। শ্রমিক-কৃষকের কষ্টকর কর্মবহুল জীবন থেকেই তিনি শিখেছেন জনগণের জন্য কাজ, মানুষের জন্য কাজ কীভাবে করতে হয়। জ্ঞানের সংগে কাজের সম্মিলন ঘটিয়ে তিনি শ্রমিক-কৃষককে মুক্ত করতে চান পার্থিব জড়তা থেকে, তাদেরকে বের করে আনতে চান স্বাধীনতার উন্মুক্ত প্রান্তরে।
তথ্যসূত্র ও টিকা
১. আবুল কাসেম ফজলুল হক; শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ; কথাপ্রকাশ, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ২০১১; পৃষ্ঠা ৪০-৪১।
২. দেখুন, আবুল কাসেম ফজলুল হক; শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ; কথাপ্রকাশ, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ২০১১; পৃষ্ঠা ৩২৫-৩৩৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।