সামন্তবাদী ভারতের ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস (ইংরেজি: Archaeological sources of Indian history) হচ্ছে ইতিহাস রচনার একটি প্রধান উৎস। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান তথা লেখ, মুদ্রা ও স্মৃতিসৌধের মত বিষয়গুলো প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানতে আমাদের সাহায্যে করে। শুধুমাত্র সাহিত্যিক উপাদানের ওপর নির্ভর করতে হলে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের অনেক কিছুই আমাদের অজানা থেকে যেত। প্রত্নতত্ত্ব এক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করেছে।
ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের বিকাশ ঘটেছে সাম্প্রতিককালে, ফলে ভারতের ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয়েছেও সাম্প্রতিককালে। লর্ড কার্জনের শাসনামলে এ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর প্রথম মহাপরিচালক ছিলেন স্যার জন মার্শাল। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও গবেষণা কর্মে প্রধানত ড. বুকানন হ্যামিল্টন, জেমস প্রিন্সেপ, স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম, জেমস বার্জেস, স্যার জন মার্শাল, স্যার মর্টিমার হুইলার – এর মত কয়েকজন ইউরোপীয় পন্ডিত অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। ভারতীয়দের মধ্যে যারা এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়, কে. এন. দীক্ষিত, ননীগোপাল মজুমদার, ড. আহমদ হাসান দানী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
লেখ বা লিপি
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে লেখমালা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পাথর বা ধাতব বস্তুতে উৎকীর্ণ হওয়ায় এগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং এগুলো পরিবর্তন করা সহজ নয়। বৃহদাকার লেখগুলো স্থানান্তরযোগ্য না হওয়ায় এগুলোতে রাজ্যের সীমানা নির্ধারণে সাহায্য করে। লেখগুলোতে সব সময় তারিখ না থাকলেও এগুলো ব্যবহৃত লিপির প্রকৃতি থেকে এগুলোর প্রায় সঠিক সময়কাল নির্ণয় করা যায়। স্মিথ এবং ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার উভয়েই নির্ভরযোগ্য উপাদান হিসাবে লেখকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান বলে মনে করেন।
ভারতীয় লেখগুলোর মধ্যে অশোকের লেখগুলো প্রাচীনতম না হলেও গুরুত্বের দিক থেকে সেগুলোর স্থান প্রথম। শিলাখন্ড বা স্তম্ভের গায়ে উৎকীর্ণ রয়েছে সম্রাটের আদেশ ও নির্দেশ যা থেকে আমরা তাঁর ব্যক্তিত্ব, চরিত্র ও কার্যাবলী সম্পর্কে জানতে পারি। উত্তর পশ্চিম এলাকায় কয়েকটি লেখে খরেষ্ঠি বর্ণমালা ব্যবহৃত হয়েছে যা ডান দিক থেকে বামে লেখা হয়। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে পাওয়া অশোকের বাকী লেখগুলোতে ব্যবহৃত হয়েছে ব্রাহ্মী বর্ণমালা যা বাম দিক থেকে ডান দিকে লেখা হয়। ১৮৩৭ সালে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা জেমস প্রিন্সেপ সর্বপ্রথম অশোকের লেখগুলোর পাঠোদ্ধার করেন।
অশোক-পরবর্তী সময়কালের লেখগুলোকে সরকারি ও ব্যক্তিগত- এ দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। সরকারি লেখগুলো সাধারণত প্রশস্তিমূলক বা ভূমিদান সম্পর্কিত। রাজকবিদের দ্বারা রচিত প্রশস্তি হচ্ছে রাজাদের গুণকীর্তন যার বিখ্যাত দৃষ্টান্ত হচ্ছে এলাহাবাদ প্রশস্তি। এর রচয়িতা ছিলেন হরিষেণ এবং এতে সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যবিজয় ও ব্যক্তিগত গুণাবলীর উল্লেখ রয়েছে। এলাহাবাদ প্রশস্তি আংশিক গদ্য ও আংশিক পদ্যে রচিত এবং এর ভাষা হচ্ছে সংস্কৃত। এ ধরনের প্রশস্তিমূলক অন্যান্য লেখের মধ্যে কলিঙ্গরাজ খরবেলের হাতিগুম্ফ লিপি, শকক্ষত্রপ রুদ্রদমনের জুনাগড় লিপি, চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর অইহোল লিপি, এবং বিজয়সেনের আমলের দেওপাড়া প্রশস্তি উল্লেখযোগ্য।
সরকারি লিপির মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে ভূমিদান সম্পর্কিত যা থেকে দান বা বিক্রির মাধ্যমে ভূমি হস্তান্তরের কথা জানা যায়। ভূমিদান সম্পর্কিত এ লেখগুলোর অধিকাংশই তামারপাতে উৎকীর্ণ বলে এগুলোকে সাধারণভাবে তাম্রশাসন বলে আখ্যায়িত করা হয়। এ ধরনের কিছু কিছু লেখ কচিৎ প্রস্তর বা মন্দিরের দেওয়ালেও উৎকীর্ণ দেখা যায়। এ লেখগুলো থেকে হস্তান্তরিত ভূমির সীমানা, দানের উদ্দেশ্য ও শর্তাবলী, জমির মূল্য, জমি মাপার একক ইত্যাদি বিষয়ে জানা যায়। অনেকগুলো তাম্রশাসনে দাতা বংশের বিবরণ এবং শাসনকারী রাজার জীবনী ও কৃতিত্বের বিবরণও থাকে যেমনটি রয়েছে ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসনে। ভূমিদান সম্পর্কিত এ তাম্রশাসনগুলো অর্থনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করা ছাড়াও রাজনৈতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি অন্যান্য বিষয়েও জানতে সাহায্য করে।
প্রশস্তিমূলক লেখগুলো অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিচার-বিশ্লেষণ করে সেগুলো থেকে তথ্য আহরণ করা প্রয়োজন। প্রশস্তি রচয়িতাগণ রাজকবি হওয়ায় তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রাজার গুণকীর্তণ ও তুষ্টি বিধান। ফলে জীবন-চরিতগুলোর মত প্রশস্তিগুলোতে অতিরঞ্জন বা সত্যগোপনের সম্ভাবনা থাকে।
সরকারি লেখের সংখ্যা খুব বেশি নয়। সে তুলনায় ব্যক্তিগত বা বেসরকারি লেখের সংখ্যা অনেক। এগুলো দুই বা তিন শব্দের ছোট লিপি থেকে দীর্ঘ কবিতাও হতে পারে। ধর্মীয় উদ্দেশ্যে দানের ক্ষেত্রে এ লিপিগুলো মূর্তির গায়ে বা মন্দিরের দেওয়ালে উৎকীর্ণ করা হয়ে থাকে। এগুলো এসব মূর্তি ও মন্দিরের কাল নিরূপণ এবং শিল্প ও ধর্মের বিকাশ ও বিবর্তন নির্ধারণে আমাদের সাহায্য করে। একই ভাবে লিপিগুলোর ভাষা ও রচনাশৈলী ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। গুপ্তযুগের আগে পর্যন্ত যে লেখগুলো আমরা পেয়েছি তার প্রায় ৯৫% প্রাকৃত ভাষায় লেখা এবং বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম সম্পর্কিত। কিন্তু গুপ্তযুগ থেকে পরবর্তীকালে উৎকীর্ণ লিপিগুলোর ৯৫%টিই সংস্কৃত ভাষায় লেখা এবং এগুলো হিন্দু ধর্ম সম্পর্কিত। এ থেকে এটা স্পষ্ট যে গুপ্তযুগে সাহিত্যের মাধ্যম হিসাবে সংস্কৃত ভাষার এবং ধর্মের ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। তাছাড়া এসব বেসরকারি লিপিতে অনেক সময়ই সমকালীন রাজার নাম ও তারিখ উল্লেখ করা থাকে যা রাজনৈতিক ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করে।
সুতরাং এতে কোনো সন্দেহ নেই যে লিপি রাজনৈতিক ইতিহাস পুনর্গঠনের প্রধান উৎস এবং সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক ইতিহাস জানার জন্য সাহিত্যিক উৎসের পরিপূরক হিসাবে যথেষ্ট মূল্যবান; এবং এটাকে ভারতের ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়।
মুদ্রা
ইতিহাসের উৎস হিসাবে লিপির পরেই মুদ্রার স্থান। প্রাচীন আমলের অসংখ্য মুদ্রা পাওয়া গেছে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা জানার জন্য মুদ্রা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা বলাই বাহুল্য। তবে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানতেও মুদ্রা আমাদের সাহায্য করে। মুদ্রা থেকে মুদ্রানীতি, ধাতুশিল্পের উন্নতি, শিল্প-নিপুণতা, রাজাদের আচার-আচরণ, ধর্মীয় বিশ্বাস, সঙ্গীতানুরাগ ইত্যাদি সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়।
প্রাচীন ভারতের প্রাথমিক মুদ্রাগুলোতে শুধু ছবি বা চিহ্ন অঙ্কিত থাকত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলোতে লেখা থাকায় এগুলোর প্রবর্তক বা সময়কাল সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর গ্রিকদের উত্তর-পশ্চিম ভারতে রাজ্য বিস্তারের সময় থেকেই আমরা রাজার নামাঙ্কিত এবং কখলো তার নাম সম্বলিত মুদ্রা পাই। এ ধরনের মুদ্রা থেকেই জানা যায় যে ত্রিশজন গ্রিক রাজা ও রানী ভারতে শাসন করেছিলেন, যদিও সাহিত্যিক উৎসে পাওয়া যায় মাত্র চার-পাঁচ জনের নাম। গ্রিকদের পরে আক্রমণকারী হিসাবে ভারতে আগত শক ও পহ্লবদের মুদ্রাও গুরুত্বপূর্ণ। শকদের এক শাখা বহুদিন ধরে গুজরাট ও কাথিয়াওয়াড়ে রাজত্ব করেছিল এবং তাদের মুদ্রায় সুপরিচিত শকাব্দ তারিখও পাওয়া যায়। পরবর্তীকালের কুষাণদেরও অনেক মুদ্রা পাওয়া যায়, তবে কুষাণদের ইতিহাস অন্যান্য উৎস থেকেও জানা যায়।
গুপ্তবংশীয় সম্রাটগণ বেশ কয়েক ধরনের অত্যন্ত সুন্দর মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন। লিপি এবং অন্যান্য উৎস থেকে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা গেলেও এ মুদ্রাগুলো থেকে সেকালের বিভিন্ন বিষয়ে বহু তথ্য পাওয়া যায়। চন্দ্রগুপ্ত-কুমারদেবী রীতির মুদ্রা থেকে তাঁদের বিয়ে এবং লিচ্ছবিদের রাজনৈতিক গুরুত্বের ধারণা পাওয়া যায়। সমুদ্রগুপ্তের বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা তাঁর সামরিক সাফল্য, শিকার প্রিয়তা, অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান ও সঙ্গীতে পারদর্শিতার প্রমাণ দেয়। এলাহাবাদ প্রশস্তিতে হরিষেন সমুদ্রগুপ্তের গুণাবলীর যে বর্ণনা দিয়েছেন এসব মুদ্রা থেকে তার সমর্থন পাওয়া যায়।
পরবর্তীকালে ভারতে রাজত্বকারী বিভিন্ন বংশের রাজারা বহু মুদ্রা প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু অন্যান্য উৎস থেকে তাদের রাজত্বকালের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় বিধায় তাদের মুদ্রা উৎস হিসাবে তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয় না।
সৌধ, স্মৃতিস্তম্ভ
লিপি ও মুদ্রা ছাড়াও অট্টালিকা, মূর্তি, মৃৎশিল্প ইত্যাদির আকারেও আমরা প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান পাই। এগুলো থেকে ভারতীয় শিল্পকলার বিবর্তন সম্পর্কে জানা যায়। কখনো প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে আমরা পেয়ে যাই কোনো প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ থেকে ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায়। এ শহর দুটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের ফলে ভারতীয় সভ্যতার সময়কাল সহস্রাধিক বছর পিছিয়ে গেছে। অর্থাৎ আগে যেখানে আমাদের ধারণা ছিল যে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে আর্যদের ভারতে আগমনের সময়কাল থেকে ভারতীয় সভ্যতার শুরু হয়েছিল এখন এ আবিষ্কারের ফলে দেখা যাচ্ছে যে ভারতীয় সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল তারও প্রায় সহস্রাধিক বছর আগে।
তক্ষশীলা, সারনাথ, নালন্দা, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ময়নামতি প্রভৃতি স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যের ফলে ভারতীয় ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে নতুন জ্ঞান লাভ করা সম্ভব হয়েছে। এসব প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যের ফলে সেই যুগের জনগণের জীবনযাত্রা, ধর্মবিশ্বাস, শিল্পকলা, স্থাপত্য ইত্যাদি সম্পর্কে আমরা জানতে পারি যা ভারতের ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস হিসেবে গণ্য।
তথ্যসূত্র
১. ড আবদুল মোমিন চৌধুরী, মোকাদ্দেসুর রহমান ও আকসাদুল আলম, উপমহাদেশ ও বাংলার ইতিহাস, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, পুনর্মুদ্রণ ২০১৪, পৃষ্ঠা ১০-১৩।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।