আফগান গৃহযুদ্ধ হচ্ছে গণতান্ত্রিক ও প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রীদের মধ্যকার সশস্ত্র সংগ্রাম

আফগান গৃহযুদ্ধ বা আফগানিস্তান গৃহযুদ্ধ বা আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ (ইংরেজি: Afghan Civil War) হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ আফগানিস্তানে দীর্ঘ চার দশকব্যাপী গণতান্ত্রিক বিপ্লবী ও প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রী প্রতিবিপ্লবীদের মধ্যকার সশস্ত্র সংগ্রাম। এই গৃহযুদ্ধ মোট তিনটি পর্ব অতিক্রম করেছে, এবং বর্তমানে চতুর্থ পর্বে প্রবেশ করেছে। আফগানিস্তানে জমিদারতন্ত্র উৎখাত না হওয়ায়, সরকারি পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যেমন অস্ত্র আছে, তেমনি বিভিন্ন জমিদারদেরও অস্ত্র এবং বাহিনী আছে, যাদেরকে যুদ্ধবাজ লাট বলা হয়। ফলে আফগান গৃহযুদ্ধ অনেকদিন ধরেই চলবে বলে আমি অনুমান করছি।

বাংলার অগ্রগামী জাতিগুলা ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৯ পর্যন্ত যেসব গেরিলা যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, কৃষক অভ্যুত্থান, ও নৈরাজ্যবাদী সমুত্থান ঘটিয়েছে সেগুলার সাথে মধ্যপ্রাচ্যে দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালের বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ তৎপরতার মিল রয়েছে। গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এখন জাতিরাষ্ট্র গঠনের সমস্যা চলছে। এখনকার মধ্যপ্রাচ্যের স্তর আমরা সেই একশ বছরে অতিক্রম করেছি।

* প্রথম আফগান গৃহযুদ্ধের (১৯৮৯-১৯৯২) মাধ্যমে মোহাম্মদ নজিবুল্লাহর নেতৃত্বাধীন রুশ সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী বামপন্থী আফগান সরকারের পতন ঘটে।

* দ্বিতীয় আফগান গৃহযুদ্ধ (১৯৯২-২০০১), আফগানিস্তানের বেশিরভাগ অংশে স্বৈরতন্ত্রী তালেবানের উত্থান ঘটে এবং ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে আফগানিস্তানের বিভিন্ন যুদ্ধবাজ জমিদার ও লাটসাহেবদের সমর্থনে তালেবান শাসিত ইসলামী আমিরাতের প্রতিষ্ঠা ঘটে।

* তৃতীয় আফগান গৃহযুদ্ধ শুরু হয় ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ৭ অক্টোবর সন্ত্রাসবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আফগান আগ্রাসনের ফলে। যদিও তালেবানরা আফগানিস্তানের অধিকাংশ অংস নিয়ন্ত্রণ করে, আর যুক্তফ্রন্ট বা উত্তরাঞ্চলীয় জোট উত্তর আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ করে। এই গৃহযুদ্ধ ১৫ আগস্ট ২০২১ তারিখে শেষ হয়।

* চতুর্থ আফগান গৃহযুদ্ধ ১৫ আগস্ট ২০২১ খ্রিস্টাব্দে কাবুল পতনের পরে শুরু হয়। এটি বর্তমানে পাঞ্জশির প্রতিরোধ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

সাম্প্রতিক আফগান গৃহযুদ্ধ: প্রাধান্যকারী শক্তির দিকবদল

পাঞ্জশির প্রতিরোধ (ইংরেজি: Panjshir resistance) বা দ্বিতীয় প্রতিরোধ যেটি আফগানিস্তানের জাতীয় প্রতিরোধ ফ্রন্ট নামেও পরিচিত, হচ্ছে সাবেক উত্তরাঞ্চলীয় জোট এবং তালেবান বিরোধী যোদ্ধাদের একটি সামরিক মৈত্রী।

২০২১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট কাবুলের পতন ষত্বেও আফগানিস্তানের পাঞ্জশির প্রদেশ তালেবানদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। কাবুল পতনের পর, পাঞ্জশির ভিত্তিক জোট আফগানিস্তানে তালেবানদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে বলে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম দাবি করেছে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আশরাফ গনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর, আফগান সংবিধান অনুসারে, আমরুল্লাহ সালেহ আফগানিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজেকে দাবি করেছেন।

১৭ আগস্ট, আমরুল্লাহ সালেহ, প্রয়াত কিংবদন্তী তালেবান বিরোধী কমান্ডার তাজিক যুদ্ধবাজ লাট আহমদ শাহ মাসুদের পুত্র আহমদ মাসুদ এবং প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিসমিল্লাহ খান মোহাম্মাদীর সাথে পাঞ্জশির উপত্যকায় উপস্থিত হন। সেখানে তিনি তালেবানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বাহিনী গঠন করছেন বলে দাবি করেছেন। ১৮ আগস্ট দেখা যায়, তালেবানের হাত থেকে পালিয়ে আসা সৈন্য এবং মিলিশিয়ারা পানশির উপত্যকায় জড়ো হতে শুরু করেছে, আফগানিস্তানের একমাত্র অঞ্চল যা তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে নেই।

আফগানিস্তানের উত্তরে পাঞ্জশিরে কিজিলবাশ তুর্কমেন (আফগান জনগণের ১০ শতাংশ) তাজিক, হাজারা এবং উজবেক জাতির লোকজন বাস করে! কিজিলবাশ নারী সংগঠন এবং উত্তরাঞ্চলীয় জোট পাঞ্জশিরে তালেবানদের বিরুদ্ধে লড়ছে, এবং তারা ঘোষণা করেছে: “যারা দাসত্ব প্রত্যাখ্যান করে, তাদেরকে আমরা আমাদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাই।”[১]

বাগলান প্রদেশে প্রতিরোধ

পাঞ্জশির প্রতিরোধ এখন উক্ত প্রদেশের পার্শ্ববর্তী বাগলান প্রদেশে ছড়িয়েছে। বাগলান প্রদেশের পুলি হিসার, দিহ সালাহ এবং বানু জেলা তালেবানবিরোধীরা পুনর্দখল করেছে। যুদ্ধে ৬০ জন তালেবান যোদ্ধা মারা গেছেন বলে খবরে বলা হয়েছে। মধ্য বিকেলে, পঞ্জশির থেকে অসমর্থিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে পুল-ই-হিসারকে তালেবানদের কাছ থেকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে, এবং দেহ-ই-সালাহ এবং বানুতে এখনও যুদ্ধ চলছে, ইরানি গণমাধ্যম রিপোর্ট করেছে যে প্রথম বানু এবং তারপর দেহ-ই-সালাহ প্রতিরোধের মুখে পড়ে। পরবর্তী প্রতিরোধের টার্গেটটি নিকটবর্তী আন্দারব জেলা বলে জানা গেছে।

আবদুল হামিদ দাদগারের নেতৃত্বে স্থানীয় তালেবান বিরোধী মিলিশিয়া এই উত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিল। ২০ আগস্ট তারিখে বিকেলের খবর পাওয়া যায় যে দাদগার বাহিনী আন্দারব জেলাকে পুনরায় দখল করে নিয়েছে, যদিও তালেবান এখনও কোনো মন্তব্য করেনি।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

প্রাক্তন ভারতীয় সেনা প্রধান শংকর রায়চৌধুরী বলেছেন যে, আহমদ মাসুদ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ তালেবানবিরোধী উপদলগুলোর আশেপাশে সমাবেশিত আফগান সরকারের সাবেক বাহিনীর সাথে ভারতের যোগাযোগ করা দরকার। ভারত সরকারকে অবশ্যই তালেবানের উপদলীয় গোষ্ঠীগুলোর পাশাপাশি পাঞ্জশির-ভিত্তিক প্রতিরোধ বাহিনীর কাছে পৌঁছাতে হবে যা ভারতের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ হতে পারে।[২]

অন্যদিকে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত দিমিত্রি ঝিরনভ এই প্রতিরোধকে “সর্বনাশ” বলে চিহ্নিত করেছেন এবং বলেছেন যে এই প্রতিরোধ ব্যর্থ হবে। ঝিরনভ আরও বলেছেন যে সালেহ-এর তত্ত্বাবধায়ক রাষ্ট্রপতি ঘোষণা অসাংবিধানিক, এবং যোগ করেছেন যে তাদের কোনো “সামরিক সম্ভাবনা নেই”।[৩]

তথ্যসূত্র

১. সূত্র: পিরহা, ১৮ আগস্ট, ২০২১, “Afganistan’da kadınlar Taliban’a karşı yürüyüşe geçti”, এবিসি গেজেটেসি, ইস্তাম্বুল তুরস্ক, ইউআরএল: https://abcgazetesi.com/afganistanda-kadinlar-talibana-karsi-yuruyuse-gecti-400670
২. ২১ আগস্ট ২০২১, “তালেবানের দিকে নজর, প্রাক্তন সেনাপ্রধান বলেছেন, কাশ্মীরের বিস্তৃতি বাড়ানো দরকার”, প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া, এনডিটিভি.কম, ইউআরএল: https://www.ndtv.com/india-news/eye-on-taliban-former-army-chief-says-need-to-step-up-kashmir-outreach-2515716
৩. Maria Vasilyeva, ২০ আগস্ট, ২০২১, “Resistance to Taliban is doomed, says Russian envoy to Afghanistan”, রয়টার্স.কম, ইউআরএল: https://www.reuters.com/world/asia-pacific/resistance-taliban-is-doomed-says-russian-envoy-afghanistan-2021-08-20/

Leave a Comment

error: Content is protected !!