মনীষী প্রগতিশীল ক্রিয়াকলাপ দ্বারা সমাজ রূপান্তর করেন

মনীষী বা বুদ্ধিজীবীদের (ইংরেজি: Intelligentsia) সামাজিক শ্রেণিগত ক্রিয়াকলাপকে হতে হবে সমাজকে রূপান্তরিত করার জন্য প্রগতিশীল ধারণার উৎস হিসেবে, মার্কসবাদী দর্শনে এরকমভাবে উল্লেখ করা হয়। মনীষীদের কাজ হবে রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশ এবং পরামর্শ প্রদান; শহুরে শ্রমিক ও কৃষক জনগণের কাছে দেশের রাজনীতির ব্যাখ্যা প্রদান; এবং তাদের নিজস্ব প্রয়োজনীয় পদমর্যাদার নেতাদের সরবরাহ করা। আবেগের দিক থেকে বুদ্ধিজীবি শব্দ দ্বারা চিন্তাশীল, এমনকি বিবেকবান, প্রগতিশীল একটি মহলকে বুঝানো হয়।[১]

বুদ্ধিজীবীরা কি অনেক বড় অথবা বেশ ছোট বিশেষ গোষ্ঠীর বা জন পরিমণ্ডলের (ইংরেজি: Public sphere) অন্তর্গত? এ বিষয়ে বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে বিশ শতকে দুটো পরস্পরবিরোধী মতামতের কথা উল্লেখ করেছেন এডোয়ার্ড সাইদ। ইতালিয় মার্কসবাদী, একনিষ্ঠ কর্মী, সাংবাদিক ও মেধাবী রাজনৈতিক এবং দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামসির বক্তব্য এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ইতালিয়ান সাম্যবাদী তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামসি (১৮৯১- ১৯৩৭) জন পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্যে কার্ল মার্কসের মনীষা সংক্রান্ত ধারণাটি তৈরি করেছিলেন।

সমকালীন কবিতা নিয়ে কবিতা দিবসের আলোচনা দেখুন

১৯২৬-১৯৩৭ সময়কালে গ্রামসি ফ্যাসিবাদী মুসোলিনির কারণে কারাগারে ছিলেন। কারাগারে থাকাকালীন অবস্থায় তিনি প্রিজন নোটবুকস-এ লেখেন, সব মানুষই বুদ্ধিজীবী একথা প্রত্যেকেই বলতে পারে কিন্তু সমাজে সব মানুষ বুদ্ধিজীবীর কাজ করে না। গ্রামসি তার নিজের জীবনে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন একজন প্রশিক্ষিত ভাষাবিজ্ঞানী। তিনি ছিলেন একাধারে ইতালীয় শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের সংগঠক এবং সাংবাদিকতা-জীবনে দক্ষ সমাজ-বিশ্লেষকদের একজন। তার লক্ষ্য শুধু সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাই নয়, ঐ আন্দোলনের সাথে যুক্ত পুরো সংস্কৃতি ও সংগঠনও নির্মাণ করা।[২]

সমাজে যারা মনীষী বা বুদ্ধিজীবীর কাজ করেন, গ্রামসি তাদেরকে দুটো শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। প্রথমত ঐতিহ্যগত বুদ্ধিজীবী। এঁদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, ধর্মপ্রচারক এবং প্রশাসকরা। তারা বংশপরম্পরায় একই ধরনের কাজ করে যান। দ্বিতীয়ত জৈবিক বুদ্ধিজীবী। গ্রামসি তাদেরকে সরাসরি শ্রেণির সাথে সম্পর্কিত বলে বর্ণনা করেছেন। তাদেরকে স্বার্থ হাসিল, অধিক শক্তি অর্জন ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কাজে লাগানো হয়। এইভাবে গ্রামসি জৈবিক বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে বলেন, তারা পুঁজিবাদী উদ্যোক্তা, শিল্প প্রযুক্তিবিদ, রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ, নতুন সংস্কৃতি ও নতুন বৈধ ব্যবস্থা ইত্যাদির সংগঠক তৈরি করে। গ্রামসির মতে আজকের যে বিজ্ঞাপনী কিংবা জনসংযোগ কুশলী কোনো ডিটারজেন্ট কিংবা এয়ারলাইন কোম্পানীর জন্য বেশি বাজার তৈরি করতে পারবেন এবং গণতান্ত্রিক সমাজে যে ব্যক্তি সম্ভাব্য ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করে সফলকাম হবেন এবং ক্রেতা কিংবা ভোটারদের মতামত তৈরি করতে পারবেন তিনিও জৈবিক বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচিত হবেন। গ্রামসি মনে করেন, জৈবিক বুদ্ধিজীবীরা সক্রিয়ভাবে সমাজের সাথে যুক্ত অর্থাৎ তারা অবিরামভাবে মানুষের মনের পরিবর্তন ও বাজার বৃদ্ধি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষক ও ধর্মপ্রচারকদের মতো একস্থানে বসে থেকে বছরের পর বছর একই ধরনের কাজ না করে জৈবিক বুদ্ধিজীবীরা সবসময় চলমান থাকে। সবসময়ই কিছু না কিছু তৈরিতে নিজেদের ব্যস্ত রাখে।[২]

মাও সেতুং বিপ্লবী মনীষী বা বুদ্ধিজীবীদের কাজকে গুরুত্ব প্রদান করেছেন। মাও সেতুং লিখেছেন, “শ্রমিক শ্রেণি বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের সাহায্যকে স্বাগত জানাবে এবং কখনোই তা প্রত্যাখ্যান করবে না। কারণ তাঁদের সাহায্য ছাড়া শ্রমিক শ্রেণি নিজে সামনে এগিয়ে যেতে পারে না বা বিপ্লবকে সফল করে তুলতে পারে না।”[৩]

আরো পড়ুন

তথ্যসূত্র

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৩২।
২. এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাইদ, রিপ্রেজেন্টেসনস অব দ্য ইন্টেলেকচুয়াল, দেবাশীষ কুমার কুন্ডু অনূদিত এবং ড. মাহবুবা নাসরীন সম্পাদিত, সংবেদ ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা ২০-২১
৩. মাও সেতুং, ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪০, ‘চীনের শ্রমিক’ পত্রিকার পরিচয় প্রসঙ্গে, নবজাতক প্রকাশন, কলকাতা, মাও সেতুংয়ের নির্বাচিত রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫০৭-৫০৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!