আমি ২৩ জুলাই ২০১৬ সাল থেকে বাংলা উইকিপিডিয়াতে অবদান রাখা শুরু করেছি। আমি যখন উইকিপিডিয়ায় সম্পাদনা শুরু করি তখন লক্ষ্য করেছিলাম, স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে উইকিপিডিয়া বেশিরভাগই পুরুষ। বিষয়টা আমাকে একটু ভাবায়। এমনকি প্রশাসকের তালিকায় নারীর অংশ গ্রহণ নেই। বাংলা ভাষার উইকিপিডিয়ায় সম্পাদক তালিকা লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে সক্রিয় নারী উইকিপিডিয়ান ১০ জনের বেশি হবে না। এই জেন্ডার গ্যাপ কেবল সম্পাদক এবং সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করে না, এটি প্রায় ৩১২ টি ভাষার বিভিন্ন প্রকল্প, অনলাইন, অফলাইন কাজের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আজকের সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনাটিতে আমি জেন্ডার গ্যাপ নিয়ে কিছু সমস্যা ও পরিকল্পনা তুলে ধরার চেষ্টা করব। উইকিতে মেয়েদের যুক্ত হওয়ার ব্যপারে সমস্যাগুলো আমি বুঝতে পেরেছি অফলাইন কয়েকটি কাজ করতে গিয়ে। আজকে আমার সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনাটির মাধ্যমে প্রাথমিক ভাবে আমি ৩টি সমস্যার কথা এখানে উল্লেখ্যে করছি এবং পরিকল্পনা।
নারীদের অংশগ্রহণের সমস্যা
আস্থার সংকট: অনলাইন নির্ভর সৃজনশীল কাজে যুক্ত হতে মেয়েরা কেন কম আগ্রহী? সাধারণত নতুনদের নিয়ে কাজ করতে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতেই হয়। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে তো বিশেষ বিশেষ কিছু দিক থাকে। আমি উইকিতে মেয়েদের যুক্ত করতে গিয়ে তাঁদের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলাম। এমন কি আমার কিছু আগ্রহী বন্ধুদের সাথেও এই বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। একটি মেয়ে যখন কোন সংগঠন বা সৃজনশীল কাজ করতে আসে তখন তাকে ব্যক্তিগত কিছু ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়েই আসতে হয়। এরমধ্যে আস্থাশীলতার জায়গাটা তাঁরা সবসময় খুঁজে। যেমন অফলাইনের কাজের দেখা যায় যে, কোন মিটআপ, ফটোওয়াক বা অন্য কোন প্রগ্রামে অংশ নিতে গিয়ে যদি দেখে কোন নারী উইকিপিডিয়ান নেই তখন নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যা বা অন্যান্য কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না।
পারিবারিক ও ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালন: পারিবারিক কাজে মেয়েদের দায়িত্ব পালন করতে অনেকটা সময় চলে যায়। একটি মেয়ে যখন লেখাপড়া করতে হল, হোস্টেলে থাকে তখনো একাডেমী প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে শহরে থাকে বাকিটা সময় পরিবারের সাথে। এই সময় পারিবারিক দায়িত্বের কাছে নিজের পছন্দ, আগ্রহের বিষয়টা তুচ্ছ হয়ে যায়। এছাড়াও অফলাইন কাজের মেয়েদের অংশ নেওয়ার জন্য আহ্বান করলে দেখা যায় পরিপাটি হয়ে আসতে যে সময় লাগে এটা ভেবেই অনেকের মধ্যে অলসতা কাজ করে।
ইন্টারনেট ব্যবহার বিষয়ে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা: আমরা নেত্রকোনা সরকারী কলেজে এডুউইকির কর্মশাল করতে গিয়ে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি লক্ষ্য করেছি। সেখানে উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করেছিলাম অনলাইনে তাঁরা কি কাজ করে? উত্তরে তাঁরা বলেছিলো ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ইউটিউব ব্যবহার করে। আমি বলেছিলাম ই-মেইল করতে হলে কি করো? উত্তরে বলেছিল অনেকের তো ইমেইল নাই, আর দরকার হলে দোকান থেকে করে। একাডেমিক বা প্রযোজনীয় কিছু জনতে অনলাইনে কোন সার্চ করে করতেও অনেকে জানেনা।
এই সীমাবদ্ধতা বিভিন্ন পরিবারগুলোতেও আছে। উইকির কাজটা যে পড়াশুনার সাথেও যুক্ত রেখে করা যায়, সেটা অনেকেই বুঝে না। ইন্টারনেট নির্ভর কাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও আছে অনেকের মাঝে। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ইন্টারনেট ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়।
নারীদের যুক্ত করার পরিকল্পনা
নতুন নারী উইকিপিডিয়ান বা আগ্রহীদের নিয়ে কর্মশালা: আমরা যারা উইকিপিডিয়ায় সক্রিয় তাঁরা সাধারণের চেয়ে অনেকটা ভালো জানি ইন্টনেটের ব্যবহার নিয়ে। এক্ষেত্রে মেয়েদের জন্য কোন কর্মশালার আয়োজন করা। সরাসরি কোন কর্মশালার আয়োজন করতে যেহেতু ফান্ডের দরকার হবে তাই আমরা যদি অনলাইনে কিছু কর্মশালার আয়োজন করতে পারি তাহলে ভালো হবে মনে হয়। তবে এই কর্মশালাটি অঞ্চলভিত্তিক না। দেশের বিভিন্ন জায়গায় থেকে অংশ নিতে পারবে এমনটা।
পুরনো নারী উইকিপিডিয়ান বা যারা বিভিন্ন এডিটাথন অংশ নিয়েছিলেন, এখন কাজের সাথে যুক্ত নেই এমন ব্যক্তিদের নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করা যায় কিনা সেটা ভাবা। এই অনলাইন কর্মশালায় আগ্রহী নতুনদের আমন্ত্রন জানানো।
বন্ধুদের মধ্যে থেকে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ানো: উইকিপিডিয়ার বিভিন্ন সাংগঠনিক সেক্টরে, অনলাইন, অফলাইন কাজে নারী উইকিপিডিয়ানদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। বাংলা উইকিপিডিয়ার প্রশাসক তালিকায় নারী উইকিপিডিয়ান যেমন নেই তেমনই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এডিটাথন, মিটিংগুলোতেও অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো না। নতুন কোন মেয়ে কাজ করতে এসে যখন দেখে নারী উইকিপিডিয়ান এক/দুজন বা নেই তখন একপ্রকার হতাশার জায়গা তৈরি হয়।
এছাড়া আমরা সক্রিয় যেসব উইকিপিডিয়ান আছি তাঁদের নিজেদের বন্ধু বা বান্ধবীরা আছে তাঁদের উইকিপিডিয়া সম্পর্কে বুঝানো যতটা সহজ হবে, একেবারে নতুনদের বুঝানো ততটাই কঠিন। এক্ষেত্রে ছেলে উইকিপিডিয়ানরা নিজেদের বান্ধবীদের অফলাইন আড্ডা, কর্মশালা বা ফটোওয়াকগুলোতে যুক্ত করতে পারলে জেন্ডার গ্যাপ কমার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে আশা করি।
যৌথ কাজের পরিকল্পনা: যৌথভাবে কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে। নারী উইকিপিডিয়ান যেহেতু তুলনামূলক কম; তাই অনলাইন বা অফলাইন বেশকিছু কাজ যৌথভাবে করা উচিৎ। যেমন নারী দিবস উপলক্ষে কোন অনুষ্ঠানে আয়োজন করা বা কোন কর্মশালার আয়োজন শুধু মেয়েদেরই করতে হবে এমনটা নয়। কোন পুরুষ উইকিপিডিয়ানও শুরু করতে পারে। এছাড়াও বিভিন্ন কাজে বা আয়োজনে নারী উইকিপিডিয়ান যেনো থাকে সেই বিষয়টা নজরে রাখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় তথ্যের সীমাবদ্ধতার জন্য অনেক নোটিশ খেয়াল নাও করতে পারে। কিন্তু ফেসবুক গ্রুপ বা ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে যোগাযোগ করা যেতে পারে। বাংলাদেশে যেহেতু নারী উইকিপিডিয়ান কম সেক্ষেত্রে পশ্চিম বাংলার নারী উইকিপিডিয়ানদের কাজের সমন্বয় করা যায় কিনা সেটা ভাবা যেতে পারে।
দোলন প্রভা বাংলাদেশের একজন কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও উইকিপিডিয়ান। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। তার জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯ তারিখে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার রেলওয়ে নিউ কলোনিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বাংলাদেশের আনন্দমোহন কলেজ থেকে এমএ সম্পন্ন করেছেন। তিনি ফুলকিবাজ এবং রোদ্দুরে ডটকমের সম্পাদক।