শ্রমের সামাজিক বিভাগ হচ্ছে বিশেষীকৃত পণ্য উৎপাদনের কাঠামোগত ভিত্তি

শ্রমের সামাজিক বিভাগ (ইংরেজি: Social division of labor) হচ্ছে শিল্প, খামার এবং শ্রমিকদের পেশা অথবা কাজের প্রযুক্তিগত বিভাগের মধ্যে বিভক্ত বিশেষীকৃত পণ্য উত্পাদনের সামাজিক কাঠামোগত ভিত্তি। আদিম যুগে ক্রমবিকাশের পথ ধরে মানুষ অত্যন্ত ধীর গতিতে অগ্রসর হচ্ছিলো, কিন্তু তা সত্ত্বেও অগ্রগমন ঠিকই ঘটছিলো। মানব সমাজ কোনো সময়ই স্থাণু অবস্থায় বসে থাকেনি। হাতিয়ার-পত্র ধীর গতিতে, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই উৎকর্ষতা লাভ করছিল। পূর্বতন সময়ে অ-বোধগম্য প্রাকৃতিক শক্তিসমূহকে মানুষ ব্যবহার করতে শিখলো। আগুনের আবিষ্কার এক বিস্ময়কর ভূমিকা পালন করে। তারপর বর্বর যুগের মানুষেরা শিকার কার্যের জন্যে তীর ও ধনুক তৈরি করতে শিখলো। একটি পাথর, একটি লাঠি সহকারে যাত্রা শুরু করে, মানুষ ধীরে ধীরে লাঠিকে বর্ষায় রূপান্তরিত করতে এবং পাথরকে শান দিতে শিখলো, যাতে তা শিকার কর্মের জন্যে আরো অধিক উপযোগী করে তোলা যায়।

যখন মৃৎ-পাত্র তৈরীর কাজে সাফল্য অর্জিত হলো, যখন মানুষ কাদামাটি থেকে বাসন-পত্র তৈরি করতে শিখলো, তখন এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো। প্রথম গৃহপালিত পশু পোষ মানানো আর শস্য চাষাবাদ এক প্রচণ্ড ভূমিকা পালন করলো। এভাবেই পশুপালন ও কৃষিকর্ম শুরু হয়। আকরিক লৌহ কিভাবে গলাতে হয় তা আবিষ্কার করা, এবং লেখন-পদ্ধতি উদ্ভাবনের সাথে সাথে আদিম যুগের ঘটে পরিসমাপ্তি এবং শুরু হয় সভ্যতার যুগ। কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে মার্কস ও এঙ্গেলস লিখেছেন যে, এই স্থান থেকে শুরু করে মানব সমাজের গোটা ইতিহাস হলো শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস।[১]

শ্রেণির উদ্ভব কিভাবে ঘটেছিলো? শ্রেণির আবির্ভাব সমাজ বিকাশের গোটা প্রক্রিয়ার সাথে সর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। পশুকে পোষ মানানোর ঘটনা আদিম সমাজের গোত্র দলগুলোর অবশিষ্ট জনগণ থেকে পশু-পালক গোষ্ঠীগুলোকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার দিকে চালিত করে। এটাই হলো প্রথম বৃহৎ সামাজিক শ্রম-বিভাগ (ইংরেজি: Social division of labour)। এই সন্ধিক্ষণ থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায় বিভিন্ন সামগ্রী উৎপাদন করতে শুরু করে। পশু-পালক গোষ্ঠীগুলোর রয়েছে পশু-পালন জাত উৎপন্ন দ্রব্য ও পশু, পশম, মাংস, পশুর হাড় ইত্যাদি। গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে উৎপাদিত দ্রব্যের বিনিময়ের একটা ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হলো। প্রথম দিকে বিনিময় কর্ম নির্বাহ হতো গোত্র সম্প্রদায়গুলোর প্রবীণদের দ্বারা; বিনিময়ের প্রধান বস্তু হলো পশু। বিনিময় সর্বপ্রথম ঘটে এমন সমস্ত স্থানে যেখানে বিভিন্ন গোত্রের সাক্ষাৎ ঘটতো; সম্প্রদায়গুলোর আলাদা আলাদা সদস্যদের মধ্যে নয়, বরং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রথমত বিনিময় সংঘটিত হতো।

একই সময়ে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কাজকর্মের পুরাতন পদ্ধতি অপর্যাপ্ত বলে প্রমাণিত হলো। এসব পদ্ধতি দ্বারা ক্রমবর্ধমান সংখ্যক লোক নিজেদের খাদ্যের সংস্থান করতে পারতো না। কৃষি কর্মের প্রথম পদক্ষেপ – চারা গাছ রোপণ – শুরু হয়। তৎকালীন পরিস্থিতিতে, জমি কর্ষণের ঘটনা, যার যার চাষাবাদযোগ্য জমির অংশ সহকারে, কয়েকটি পরিবারের মধ্যে অধিকতর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রতিষ্ঠিত করে।

“পশুপালন, কৃষি, পারিবারিক হস্তশিল্প – সকল শাখায় উৎপাদনের বৃদ্ধি নিজের ভরণ পোষণের জন্যে যা প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি উৎপাদন করায় মানুষের শ্রমশক্তিকে সমর্থ করে তুলে। জনগোষ্ঠী, গৃহস্থ পরিবার বা একক পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের সকলের উপর দৈনন্দিন কাজের যে পরিমাণ দায়িত্ব পড়তো একই সময়ে তা সেটাও বাড়িয়ে দেয়। অধিক শ্রমশক্তি সংযোজন বাঞ্চনীয় হয়ে ওঠে। যুদ্ধবিগ্রহ তার যোগান দেয়। বন্দী শত্রুদের দাসে রূপান্তরিত করা হয়। বিদ্যমান ঐতিহাসিক অবস্থায়, শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে, সম্পদ বৃদ্ধি করে, এবং উৎপাদনমূলক তৎপরতার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে, প্রথম বৃহৎ সামাজিক শ্রম-বিভাগ অপরিহার্য রূপে তার পেছনে পেছনে বহন করে নিয়ে আসে। ক্রীতদাস-প্রথা, প্রথম বৃহৎ সামাজিক শ্রমবিভাগ থেকে জন্ম নেয় দু’টি শ্রেণীতে সমাজের প্রথম বৃহৎ বিভক্তি – দাস-মালিক ও দাস, শোষক ও শোষিত।”[২]

যে পরিমাণে শ্রমের নতুন রূপ ও পদ্ধতি মানুষের আয়ত্বে আসতে লাগলো সে পরিমাণে শ্রম-বিভাগের আরো অধিক বিকাশ ঘটলো। মানুষ শিখলো আসবাব-পত্র তৈরি করতে, সব ধরণের হাতিয়ার-পত্র, বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র-পাতি ইত্যাদি প্রস্তুত করতে। এটা ক্রমান্বয়ে কৃষি থেকে হস্তশিল্পের বিচ্ছিন্নতা ঘটালো। এই সবকিছুই বিনিময় প্রথার বিকাশের ভিত্তি বিপুলভাবে বিস্তৃত করলো।

আদিম সাম্যবাদের লয়প্রাপ্তির ফলশ্রুতিতে ঘটলো এজমালি মালিকানা থেকে গৃহপালিত পশুর ব্যক্তিমালিকানায় রূপান্তর। জমি ও হাতিয়ার-পত্রও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হলো। ব্যক্তিমালিকানার সূচনার সাথে সাথে অসাম্যের উদ্ভব ও ভিত্তি স্থাপিত হলো।

“মুক্ত মানুষ ও ক্রীতদাসদের মধ্যেকার পার্থক্যের সাথে যুক্ত হলো ধনী ও গরীবের মধ্যেকার পার্থক্য। এই ঘটনা ও নতুন শ্রম-বিভাগ স্থাপন করলো শ্রেণিতে শ্রেণিতে সমাজের নতুন বিভক্তি।”[৩]

তথ্যসূত্র

১. এ লিয়নতিয়েভ, মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, সেরাজুল আনোয়ার অনূদিত, গণপ্রকাশন, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৫, পৃষ্ঠা ২২-২৩।

২. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, “পরিবারের উৎস”, পৃঃ ১৯৫

৩. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, ঐ, পৃঃ ১৯৮

Leave a Comment

error: Content is protected !!