শ্রেণি বা সামাজিক শ্রেণি (ইংরেজি: Social class) হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে বিভক্ত বৈষম্যমূলক সমাজে এক অংশের শ্রমকে অপর অংশের দ্বারা আত্মসাৎ করার রাষ্ট্র কর্তৃক বৈধতা প্রদত্ত মানুষের বিভক্ত অংশ। বুর্জোয়া শ্রেণি ও সর্বহারা শ্রেণি – এরাই হলো প্রত্যেক পুঁজিবাদী দেশে দুই মূল শ্রেণি। বুর্জোয়া শ্রেণি শাসন করে। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণি ছাড়া বুর্জোয়া শ্রেণি টিকে থাকতে পারে না। যদি লক্ষ-কোটি শ্রমিক তাদের কল-কারখানা ও ফ্যাক্টরীতে হাড়ভাঙ্গা খাটুনী না খাটে ও মাথার ঘাম না ফেলে তাহলে পুঁজিপতির সমৃদ্ধি আসতে পারে না। বিত্তবানদের পকেট পূর্তির জন্যেই শ্রমিকের রক্ত ও ঘাম ঝনঝনে মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়।[১]
বুর্জোয়া শাসনের বিকাশ ও শক্তি বৃদ্ধি অপরিহার্যরূপে ঘটায় শ্রমিক শ্রেণির বিকাশ, সংখ্যার দিক দিয়ে ও সংহতির দিক দিয়ে তার ক্রম বৃদ্ধি। এভাবে বুর্জোয়া শ্রেণি তৈরি করে তার নিজের কবর-রচনাকারী। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যতই বিকাশ লাভ করতে থাকে, ততই তার অন্তঃস্থলে নতুন, সমাজতান্ত্রিক সমাজের শক্তিসমূহ পরিপক্ক হতে থাকে। শ্রেণি, শ্রেণিসমূহের সংগ্রাম, শ্রেণি-স্বার্থের দ্বন্দ্ব – এটাই পুঁজিবাদী সমাজের জীবন গঠন করে। কিন্তু শ্রেণী কি ? লেনিন নিম্নোক্তভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন:
“সাধারণভাবে শ্রেণি বলতে কি বোঝায়? এটা হলো তা-ই যা সমাজের এক অংশকে অপর অংশের শ্রম আত্মসাৎ করার অনুমোদন দেয়। যদি সমাজের এক অংশ সমস্ত জমির অধিকারী হয়, তাহলে আমরা পাই জমিদার ও কৃষকদের শ্রেণি। যদি সমাজের এক অংশ ফ্যাক্টরী, শেয়ার ও পুঁজির মালিক হয়, অন্যদিকে অপর অংশ এসব ফ্যাক্টরীতে খেটে মরে, তাহলে আমরা পাই পুঁজিপতি শ্রেণি ও সর্বহারা শ্রেণি।”[২]
কিন্তু সেই গূঢ় রহস্যটি কি যা সমাজের একাংশের পক্ষে ঐ সমাজের অপরাংশের শ্রম আত্মসাৎ করা সম্ভব করে তোলে? আর “ফলায় না, অথচ ফল খায়”- এরূপ এক দল লোকের আবির্ভাব ঘটার কারণগুলোই-বা কি?
এটা বুঝতে গেলে, খুঁজে দেখা দরকার সমাজে উৎপাদন কিভাবে সংগঠিত হয়। উৎপাদনের অর্থ কী তা প্রতিটি শ্রমিক, প্রতিটি শ্রমজীবী কৃষক খুব ভাল করেই জানে। বেঁচে থাকতে হলে মানুষের অবশ্যই থাকতে হবে খাদ্য, বস্ত্র ও আশ্রয়। প্রত্যেক শ্রমজীবীই খুব ভালভাবে জানে ঘর-বাড়ি তৈরি করতে, জমি চাষ করতে, রুটি তৈরি করতে, মানুষের চাহিদা পূরণার্থে জিনিসপত্র তৈরি করার জন্য কল-কারখানা ও ফ্যাক্টরীতে কাজ করতে কি পরিমাণ শ্রম দরকার – কারণ প্রত্যেক শ্রমিক, প্রত্যেক শ্রমজীবী চাষী নিজেই এই শ্রমে অংশ নেয়।
শ্রমের বদৌলতে, প্রকৃতি-জগতে প্রাপ্ত বস্তুসামগ্রীকে মানুষ পরিবর্তন করে, সেগুলোকে নিজেদের ব্যবহারের জন্যে ও নিজেদের চাহিদা পূরণের জন্যে উপযোগী করে তোলে। মাটির গর্ভে মানুষ পায় কয়লা, আকরিক লৌহ, তেল। নিজেদের শ্রম দ্বারা তারা এসব প্রয়োজনীয় বস্তু আহরণ করে এবং সেগুলো পৃথিবী পৃষ্ঠে নিয়ে আসে। এখানে এই আকরিক লৌহ গলিয়ে শোধিত করা হয় এবং লোহায় পরিণত করা হয়। পর্যায়ক্রমে এই লোহা ইঞ্জিন থেকে পকেট ছুরি বা সুঁই পর্যন্ত – সর্বাধিক বিভিন্নমুখী জিনিসে রূপান্তরিত করা হয়।
প্রত্যেকে জানেন, মানুষ একা কাজ করে না, বরং একত্রে মিলেই করে। একটি কয়লা খনি, কারখানা বা ফ্যাক্টরি নিয়ে একজন মানুষ নিজে থেকে একা কী-ই বা করতে পারে? আর গোড়ার কথা হলো, হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া এরূপ কর্মোদ্যোগ কি গৃহীত হতে পারে? যাই হোক, কেবল বড় বড় কর্ম-পরিকল্পনার ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা অচিন্ত্যনীয় নয়। এমনকি এক খণ্ড ক্ষুদ্র জমিতে কর্মরত একজন বিশেষ কৃষক তার বৃদ্ধ ঘোটকী নিয়ে চাষকার্য চালিয়ে যেতে পারে না যদি-না অন্য কিছু লোক তাকে বহু সংখ্যক প্রয়োজনীয় সামগ্রী যোগান দেয়। যে হস্তশিল্পী ও কারিগর নিজে নিজেই কাজ করে, তারাও হাতিয়ারপাতি ও কাঁচামাল ছাড়া এক কদম এগুতে পারে না, যেগুলো হলো অন্যান্য মানুষেরই শ্রমের ফসল।
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সমাজেই উৎপাদন সাধিত হয়। উৎপাদন হলো সামাজিক, কিন্তু সংগঠিত হয় বিভিন্ন পন্থায়।
উৎপাদন করতে হলে, জমি, ফ্যাক্টরী-ঘর, যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল দরকার। এসব কিছুকে বলা হয় উৎপাদন-যন্ত্র (ইংরেজি: Means of production)। কিন্তু মানবিক শ্রম ছাড়া, জীবন্ত শ্রমশক্তি ছাড়া উৎপাদন-যন্ত্র হচ্ছে মৃত। উৎপাদন-যন্ত্রের ক্ষেত্রে যখন শ্রমশক্তি প্রযুক্ত হয়, একমাত্র তখনই উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। মানব সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির অবস্থান ও তাৎপর্য নির্ধারিত হয় উৎপাদন-যন্ত্রের সাথে এসব প্রত্যেক শ্রেণির সম্পর্কের দ্বারা। উদাহরণস্বরূপ, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রধান উৎপাদন-যন্ত্র জমির মালিক হলো জমিদার।। জমির উপর মালিকানার বদৌলতে জমিদার কৃষকদের শোষণ করে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সকল প্রতিষ্ঠান, সকল উৎপাদন-যন্ত্র থাকে বুর্জোয়া শ্রেণির হাতে। শ্রমিক শ্রেণির কোনো উৎপাদন-যন্ত্র নেই। সর্বহারা শ্রেণির উপর বুর্জোয়া শ্রেণির শোষণের এটাই হচ্ছে ভিত্তি।
শ্রেণি ও শ্রেণি-বৈষম্যের স্রষ্টা পুঁজিবাদ নয়। পুঁজিবাদের পূর্বে, সামন্তবাদী ব্যবস্থায় আর এমন-কি তারও পূর্বে, শ্রেণি বিদ্যমান ছিল। কিন্তু পুঁজিবাদ পুরাতন শ্রেণির বদলে নতুন শ্রেণিসমূহকে অভিষিক্ত করে। পুঁজিবাদ নতুন পদ্ধতির শ্রেণি-নিপীড়ন ও শ্রেণি-সংগ্রাম প্রবর্তন করে।
“শ্রেণি হলো মানুষের বিরাট বিরাট দল, যারা সামাজিক উৎপাদনের ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত ব্যবস্থায় তাদের অবস্থান দ্বারা, উৎপাদন-যন্ত্রের সাথে তাদের সম্পর্ক (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আইন মোতাবেক নির্ধারিত ও সূত্রবদ্ধ ) দ্বারা, সামাজিক শ্রম সংগঠনে তাদের ভূমিকা দ্বারা, এবং ফলত, যে সামাজিক সম্পদের তাদের অধিকারের মাত্রা ও তা অর্জন করার পদ্ধতি দ্বারা পরস্পর থেকে ভিন্ন। শ্রেণি হলো মানুষের বিভিন্ন দল যাদের একাংশ – নির্দিষ্ট সামাজিক অর্থনীতিগত পদ্ধতিতে তারা যে বিভিন্ন অবস্থান দখল করে সেই কারণে – অপরাংশের শ্রম আত্মসাৎ করতে পারে।”[৩]
তথ্যসূত্র
১. এ লিয়নতিয়েভ, মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, সেরাজুল আনোয়ার অনূদিত, গণপ্রকাশন, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৫, পৃষ্ঠা ৩-৫।
২. লেনিন, যুব লীগের কর্তব্য, রুশ যুব কমিউনিস্ট লীগের তৃতীয় নিখিল-রুশ কংগ্রেসে প্রদত্ত বক্তৃতা, সঃ রঃ, ৩১শ খন্ড, ইং সং, মস্কো, ১৯৬৬, পৃঃ ২৯২
৩. লেনিন, “এক মহান সূচনা”, ২৯শ খণ্ড, সঃ রঃ, মস্কো, ১৯৬৬, পৃঃ ৪২১
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।