সরল পণ্য উৎপাদন, (ইংরেজি: Simple commodity production) যা ক্ষুদে পণ্য উৎপাদন হিসাবেও পরিচিত, হচ্ছে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস কর্তৃক বানানো উৎপাদনের ক্রিয়াকলাপকে বর্ণনা করার জন্য তৈরি করা একটি শব্দ যাকে কার্ল মার্কস পণ্যের “সাধারণ বিনিময়” বলেছিলেন, যেখানে স্বাধীন উৎপাদকগণ তাদের নিজস্ব পণ্য বেচাকেনা করে। আমরা দেখেছি যে, মানুষের ইতিহাসের অতি প্রাচীনকালেই বিনিময়-প্রথার উদ্ভব ঘটে। সমাজে শ্রম-বিভাগের প্রথম পদক্ষেপগুলোর সাথে একত্রেই বিনিময়-প্রথার ভিত্তি রচিত হয়। প্রথম দিকে কেবলমাত্র প্রতিবেশী কমিউনগুলোর মধ্যেই বিনিময় সংঘটিত হতো, প্রত্যেকেই তাদের নিজেদের বাড়তি উৎপন্ন-দ্রব্যের সাথে অন্যের বাড়তি উৎপন্ন-দ্রব্যের বিনিময় করতো। কিন্তু, কমিউনগুলোর সীমান্তে জন্ম নিলেও, এই বিনিময়-প্রথা অবিলম্বেই কমিউনের অভ্যন্তরস্থ পারস্পরিক সম্পর্কসমূহের উপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে। মুদ্রার আবির্ভাব ঘটে। প্রথম দিকে যেসব উৎপন্ন-দ্রব্য ছিল বিনিময়ের প্রধান প্রধান বস্তু, সেগুলোই মুদ্রা হিসেবে কাজ করে। এভাবে বহু ক্ষেত্রেই যখন পশুপালক গোত্র বা গোষ্ঠীর সাথে বিনিময় ঘটতো, তখন গবাদি পশুই মুদ্রা হিসেবে কাজ করতো। কোনো গোত্রের সম্পত্তি পরিমাপ করা হতো তাদের মালিকানাধীন পশুর সংখ্যা দ্বারা।[১]
কিন্তু বিনিময়ের উদ্ভবের পরেও দীর্ঘকাল ধরে স্বাভাবিক-উৎপাদন প্রচলিত ছিল। যে দ্রব্য-উৎপাদন বিনিময়ের উদ্দেশ্যে করা হয় না তাকে বলে স্বাভাবিক-উৎপাদন [natural production]। বিপরীত পক্ষে বাজারে বিক্রয়ের জন্য, বিনিময়ের জন্যে, দ্রব্যের উৎপাদনকে বলা হয় পণ্য-উৎপাদন [commodity production]।
দাসতন্ত্র ও সামন্তবাদের যুগে স্বাভাবিক-উৎপাদনই অধিকতর প্রভাবশালী ছিল। স্বাভাবিক-উৎপাদনের অধিক প্রভাবশীলতার ভিত্তিতেই প্রাক-ধনবাদী শোষণের রূপসমূহ আবির্ভূত ও বিকশিত হয়। কেবল বিনিময়-প্রথার পর্যায়ক্রমিক বিকাশই এসব সামাজিক ব্যবস্থার ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। ক্রমবিকাশের এই স্তর সম্পর্কে এঙ্গেলস যা বলেছেন তা হলো:
“আমরা সবাই জানি, সমাজের আদি স্তরগুলোতে উৎপাদিত-দ্রব্যগুলো উৎপাদকদের নিজেদের দ্বারাই ব্যবহৃত হতো আর এসব উৎপাদকরা কম বা বেশী সাম্যবাদী কমিউনগুলোতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংগঠিত ছিল; কমিউন বহির্ভূতদের সাথে উদ্বৃত্ত উৎপাদিত-দ্রব্যের বিনিময় হলো উৎপাদিত-দ্রব্যের পণ্যে রূপান্তরের ভূমিকা স্বরূপ, আর তা হলো পরবর্তী কালেরই ঘটনা, প্রথমতঃ তা সম্পাদিত হতো কেবলমাত্র বিভিন্ন গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত ভিন্ন ভিন্ন কমিউনের মধ্যে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে কমিউনের অভ্যন্তরেও তা কার্যকর হতে থাকে এবং বড় বা ছোট পারিবারিক গ্রুপে ভেঙ্গে যেতে বস্তুগতভাবে সাহায্য করে। কিন্তু এই ভেঙ্গে যাওয়ার পরেও, বিনিময় পরিচালনাকারী পরিবারগুলোর প্রধানরা শ্রমজীবী কৃষকই থেকে যায়, যারা পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরে তাদের সকল চাহিদা পূরণের জন্যে প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই উৎপাদন করতো এবং তাদের নিজস্ব উদ্বৃত্ত উৎপন্ন-দ্রব্যের বিনিময়ে বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় বস্তু সামগ্রীর এক অতি সামান্য অংশই কেবল যোগাড় করতো। পরিবারের সভ্যরা কেবলমাত্র কষিকর্ম ও পশুপালনেই ব্যাপত থাকতো না, বরং এসব কিছু থেকে প্রাপ্ত উপকরণাদিকে ব্যবহারযোগ্য বস্তুসামগ্রীতেও রূপান্তরিত করতো, কোনো কোনো স্থানে এখনও পরিবারের লোকেরা হস্তচালিত যাতা দিয়ে আটা-ময়দা পেশাই করে, রুটি বানায়, লিনেন ও পশমের সূতা তৈরী করে, রঙ লাগায় ও বয়ন করে, চামড়া পাকা করে, কাঠের ঘর-দোয়ার তৈরী ও মেরামত করে, শ্রমের হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি তৈরী করে, প্রায়শঃই কামার ও সুতারের কাজ করে, যাতে ঐ পরিবার বা পারিবারিক দল, মূলত, স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকে।
“জার্মানীতে এমনকি ঊনবিংশ শতকের এই গোড়ার দিকেও, এই ধরণের একটি পরিবার বিনিময় বা ক্রয়ের মাধ্যমে অন্যদের কাছ থেকে যে মুষ্টিমেয় কিছু জিনিস যোগাড় করতো তার অন্তর্ভূক্ত ছিল প্রধানত হস্তশিল্পীদের উৎপাদিত দ্রব্য, অর্থাৎ, এসব জিনিস কৃষকরা নিজেরা তৈরী করতে একেবারেই যে অসমর্থ ছিল তা নয়, বরং তারা নিজেরা যে সেগুলো উৎপাদন করতো না তা হয় একমাত্র এ কারণেই যে কাঁচামাল তাদের নিকট সহজলভ্য ছিল না, না-হয় কেনা সামগ্রী ছিল বেশ পরিমাণে উত্তম কিংবা অতিমাত্রায় সস্তা।”[২]
সুতরাং, দাসতন্ত্রে ও মধ্যযুগেই কেবল নয়, নতুন অবস্থায়ও স্বাভাবিক-উৎপাদন প্রচলিত ছিল। পুঁজিবাদের সূচনাতে পণ্য-উৎপাদন কোনক্রমেই অধিক প্রভাবশালী ছিল না। পুঁজিবাদের ক্রমবিকাশই কেবল স্বাভাবিক-উৎপাদনের ওপর মরণ-আঘাত হানে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়ই কেবল পণ্য-উৎপাদন, বাজারে বিক্রীর জন্য উৎপাদন হয়ে ওঠে উৎপাদনের নির্ধারক, প্রাধান্যপূর্ণ রূপ।
প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজের অভ্যন্তরে, শ্রম-বিভাগের বৃদ্ধির সাথে একত্রেই পণ্য-উৎপাদন প্রথা আরো বেশি মাত্রায় বিকশিত হতে থাকে। এক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যের ঘটনা হলো কৃষিকর্ম থেকে হস্তশিল্পের আলাদা হয়ে পড়া। যেখানে চাষী কৃষক মূলতঃ স্বাভাবিক উৎপাদক হিসেবেই তার ক্ষেত-খামার চালায় সেখানে কারিকরদের সম্পর্কে একই কথা বলা চলে না। হস্তশিল্প খোদ সূচনা থেকেই সুস্পষ্টভাবে পণ্য-উৎপাদন মূলক চরিত্র-বিশিষ্ট। কারিকর যখন এক জোড়া জুতা কিংবা এক প্রস্থ ঘোড়ার জিন-সাজ, লাঙ্গল কিম্বা ঘোড়ার পায়ের নাল, মাটি বা কাঠের বাসন-পত্রাদি তৈরী করে, তখন গোড়া থেকেই সে সেগুলো তৈরী করে বাজারের জন্যে, বিক্রয়ের জন্যে। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পণ্য-উৎপাদনের বিসদৃশে, কারিকর যে সমস্ত শ্রমের যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতো সেগুলোর মালিক ছিল সে নিজে। সাধারণ নিয়মে সে কেবল তার নিজ শ্রমশক্তিই প্রয়োগ করতো। একমাত্র পরবর্তীকালেই, শহর-নগর গড়ে ওঠার সাথে সাথে, কারিকর মাইনা দিয়ে শিক্ষানবিস ও শিক্ষিত কারিকর নিয়োগ করতে শুরু করে। সব শেষে, কারিকর সাধারণত স্থানীয় কাঁচামাল দিয়ে কাজ করতো এবং স্থানীয় বাজারেই তার পণ্য-সামগ্রী বিক্রী করতো। বাজারে বিক্রয়ের জন্যে, অথচ মজুরী-শ্রম ছাড়া যখন দ্রব্যাদি উৎপাদিত হয়, তখন আমরা তাকে বলি সরল পণ্য-উৎপাদন [simple commodity production], পুঁজিবাদী পণ্য-উৎপাদন থেকে যা ভিন্ন। এঙ্গেলস বলেছেন,
“পুঁজিবাদী উৎপাদনের পূর্বে, অর্থাৎ মধ্য যুগে উৎপাদন-যন্ত্রের উপর ও ক্ষুদে কৃষক, মুক্ত মানুষ বা ভূমিদাসদের কৃষিভিত্তিক শিল্প আর শহরের হস্তশিল্পের উপর – শ্রমিকের ব্যক্তিমালিকানার ভিত্তিতে, ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদনই ছিল সাধারণভাবে প্রচলিত। জমি, কৃষি যন্ত্রপাতি, ছোট কারখানা ও তার হাতিয়ারপত্র – এসব শ্রম প্রয়োগের হাতিয়ার ছিল স্বতন্ত্র ব্যক্তিদেরই শ্রমের হাতিয়ার, ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যেই তা প্রস্তুতকৃত, আর সে কারণে স্বভাবতই নিকৃষ্ট, আকারে ছোট ও সীমিত।”[৩]
সরল পণ্য-উৎপাদন ও পুঁজিবাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায় নিহিত? কারিকর, হস্তশিল্পী, ক্ষুদে কৃষক সকলেই নিজেদের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও উৎপাদন-যন্ত্রের মালিক। তারা নিজেরাই কাজ করে, এসব উৎপাদন-যন্ত্রের সহায়তায় তাদের জিনিসপত্র উৎপাদন করে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিষয়টি অন্য রকমের। এখানে কল-কারখানা ও ফ্যাক্টরীর মালিক পুঁজিপতি শ্রেণি আর সেখানে কাজ করে মজুরী-খাটা শ্রমিকরা, যাদের নিজস্ব কোনো উৎপাদন-যন্ত্র নেই। সরল পণ্য-উৎপাদন সব সময়ই পুঁজিবাদের পূর্বানুগামী। সরল পণ্য উৎপাদন ছাড়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উদ্ভূত হতে পারতো না। প্রথমোক্তটি পুঁজিবাদের পথ প্রস্তুত করে দেয়।
বিপরীতক্রমে, সরল পণ্য-উৎপাদনের ক্রমবিকাশ অপরিহার্য রূপে পুঁজিবাদের দিকে পরিচালিত হয়। ক্ষুদ্রায়তন পণ্য-উৎপাদন পুঁজির জন্ম দেয়।
মার্কসবাদের অন্যতম একটি অপব্যাখ্যা হলো পুঁজিবাদের ঐতিহাসিক পূর্বসূরী হিসেবে সরল পণ্য-উৎপাদনের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার অপচেষ্টা। মার্কসবাদের এই বিকৃতির রাজনৈতিক তাৎপর্য অত্যন্ত স্পষ্ট। প্রকৃত ঘটনা হলো এই যে, এমনকি বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদের অধিকতর প্রতিপত্তির আমলেও পূর্ববর্তী ব্যবস্থার বহু নিদর্শন এখনও টিকে আছে, অর্থাৎ সরল পণ্য-উৎপাদনের বিপুল সংখ্যক উপাদান লক্ষ-কোটি ক্ষুদে কৃষক, কারিকর ও হস্তশিল্পী এখনও টিকে আছে। আপাতদৃষ্টিতে স্বাধীন, কিন্তু পুঁজিবাদের অসহনীয় জোয়ালের অধীনে যন্ত্রণাকাতর, এসব ব্যাপক সংখ্যক ক্ষুদে পণ্য-উৎপাদক এমন এক মজুদ বাহিনী গঠন করছে যা থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য সংগ্রামে সর্বহারা শ্রেণি তার মিত্র খুঁজে পায়। সরল পণ্য-উৎপাদনের ভূমিকা ও তাৎপর্যের বিকৃতি সাধন সর্বহারা বিপ্লবের মিত্র হিসেবে মৌলিক কৃষক জনগণের ভূমিকার প্রতি অস্বীকৃতির ভিত্তি রচনা করে। প্রতিবিপ্লবী ট্রটস্কিবাদী তত্ত্বের মূলেই রয়েছে এই বিকৃতি।
এক ধরনের চীনা দেয়াল দিয়ে পুঁজিবাদ থেকে সরল পণ্য-উৎপাদনকে আলাদা করার প্রচেষ্টাও মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বের কম স্থূল বিকৃতি নয়। লেনিন নিয়তই এই বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন যে, ক্ষুদে পণ্য-উৎপাদন প্রতি দিন, প্রতি ঘন্টা, প্রতি মূহূর্তেই পুঁজিবাদের জন্ম দেয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থায় এই নীতির প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন সেইসব দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদীদের তুলে ধরা মতামতের দিকেই ঠেলে দেয়, যারা গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদন চিরস্থায়ী করে রাখার পক্ষে ওকালতি করে, এবং তা বৃহদায়তন সামাজিক উৎপাদনের নীতিমালার ভিত্তিতে গ্রামাঞ্চলের সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের আবশ্যকতা সম্পর্কে উপলব্ধি হীনতার দিকেই চালিত করে।
তথ্যসূত্র
১. এ লিয়নতিয়েভ, মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, সেরাজুল আনোয়ার অনূদিত, গণপ্রকাশন, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৫, পৃষ্ঠা ২৬-২৯।
২. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস “পুঁজি” গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডের ক্রোড়পত্র, জার্মান সংস্করণ, ১৮৯৫।
৩. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, “এন্টি-ডুরিং”, পৃঃ ৩০১
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।