সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাজনৈতিক অর্থনীতি অধ্যয়নের (ইংরেজি: The relationship of socialist construction with political economy) সংগে বিরাজমান। আমরা জানি, পুঁজিবাদকে প্রতিস্থাপন করেই আসে সমাজতন্ত্র। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমাজের উৎপাদন সম্পর্কসমূহ রূপ-কাঠামোগত দিক দিয়েই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উৎপাদন-সম্পর্কসমূহ থেকে সামগ্রিকভাবে ভিন্ন। এই নতুন সম্পর্কসমূহকে রাজনৈতিক অর্থনীতি কি অবশ্যই অধ্যয়ন করবে? স্বভাবতই একে তা করতে হবে। লেনিন দেখিয়ে দিয়েছেন যে, রাজনৈতিক অর্থনীতি হলো “সামাজিক-উৎপাদনের বিকাশমান ঐতিহাসিক পদ্ধতিসমূহের বিজ্ঞান”। কার্ল মার্কস-এর ঘনিষ্ঠতম সহযোদ্ধা ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস উল্লেখ করেছেন,
“ব্যাপকতম অর্থে, রাজনৈতিক অর্থনীতি হলো মানব সমাজের জীবন-ধারণার্থে প্রয়োজনীয় বস্তুগত সামগ্রীসমূহের উৎপাদন ও বিনিময় নিয়ন্ত্রণকারী বিধি-বিধানের বিজ্ঞান।”[১]
ফলত, কেবলমাত্র পুঁজিবাদই নয়, বরং যেসব যুগ তার পূর্বে এসেছিল, এবং যে সমাজব্যবস্থা পুঁজিবাদের স্থলাভিষিক্ত হতে আসছে, সেগুলোও রাজনৈতিক অর্থনীতিকে অবশ্যই অধ্যয়ন করতে হবে।
এর অর্থ কি এই যে, সামাজিক-উৎপাদনের সকল ব্যবস্থায় একই নিয়মাবলী প্রচলিত থাকে? না, তা মোটেই নয়। বিপরীতপক্ষে সামাজিক উৎপাদনের প্রত্যেক ব্যবস্থারই রয়েছে তার নিজস্ব বিশেষ নিয়মাবলী। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যেসব নিয়ম প্রচলিত থাকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেগুলো তাদের কার্যকারিতা ও তাৎপর্য হারিয়ে ফেলে।
যখন ভূমণ্ডলের একটি অংশে সাফল্যের সাথে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলা হচ্ছে, তখন সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক রূপ-কাঠামো এবং পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের আমলকে অধ্যয়ন করারও সুবিপুল বাস্তব গুরুত্ব সুস্পষ্ট।
আমাদের কাছে, তত্ত্ব এক অন্ধ মতবাদ নয়, অর্থাৎ, নিষ্প্রাণ এক ধর্মীয় মতবাদ নয়, বরং তা হলো কর্মের পথ-নির্দেশক। বিপ্লবী সংগ্রামে তত্ত্বের এক সুবিপুল গুরুত্ব রয়েছে। লেনিন অসংখ্যবার গুরুত্ব আরোপ করেছেন; বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া একটি নিপীড়িত শ্রেণির, ইতিহাসের সবচেয়ে বিপ্লবী শ্রেণীর বিশ্বব্যাপ্ত সর্ববৃহৎ মুক্তি আন্দোলন অসম্ভব। কমরেড জোসেফ স্তালিন বলেন,
“আপনারা জানেন যে, একটি তত্ত্ব যখন সাচ্চা তত্ত্ব হয়, তখন বাস্তব সংগ্রামরত শ্রমিকদের তা প্রদান করে দিশা নির্ণয়ের ক্ষমতা, উদ্দেশ্যের স্পষ্টতা, তাদের কর্মের ক্ষেত্রে আস্থা, আমাদের লক্ষ্যের সাফল্য অর্জনে বিশ্বাস। আমাদের সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণের লক্ষ্য সাধনের জন্যে এই সবকিছুরই রয়েছে অপরিমেয় গুরুত্ব এবং অবশ্যই তা থাকবে।”[২]
রাজনৈতিক অর্থনীতি কেবল পুঁজিবাদের বিকাশ ও অবক্ষয়কে নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মাবলী সম্পর্কেই নয়, বরং পুঁজিবাদের ধ্বংসাবশেষ থেকে উত্থিত নতুন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মাবলী সম্পর্কেও এক স্পষ্ট ও যথাযথ উপলব্ধি দান করবে। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি কেবল ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদী বিশ্বের প্রতিকৃতির উপরই নয়, বরং সোভিয়েত ইউনিয়নে নির্মাণাধীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতিকৃতির উপরও উজ্জ্বল আলোক-রশ্মি নিক্ষেপ করছে।
এটা স্পষ্ট যে, কেবলমাত্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অধ্যয়নের সংকীর্ণ সীমার মধ্যে রাজনৈতিক অর্থনীতিকে কৃত্রিমভাবে সীমাবদ্ধ রাখার প্রচেষ্টা সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণের শত্রুদের হাতকেই শক্তিশালী করে। এ ধরনের প্রচেষ্টা অর্থনৈতিক বিনির্মাণের ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের সুবিশাল অভিজ্ঞতার তত্ত্বগত উপলব্ধিতে বাধা দান করছে, যে অভিজ্ঞতা হলো গোটা বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির জন্যে অতীব গুরুত্বের বিষয়। এ ধরনের প্রচেষ্টা অনুশীলন থেকে পিছিয়ে থাকা তত্ত্বের দিকে, অনুশীলন থেকে তত্ত্বকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার দিকে চালিত করে, যা আমাদের শত্রুদের হাতই শক্তিশালী করে। মার্কসবাদের ভাববাদী সংশোধনের অপচেষ্টায় লিপ্ত, সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাসির অন্যতম তাত্ত্বিক হিলফারডিঙের নেতৃত্বে বহু অর্থনীতিবিদ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নিয়ে কেবল বিচার-বিবেচনা করে এমন এক বিজ্ঞান হিসেবেই রাজনৈতিক অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণা পোষণ করেন। লেনিন এসব ধারণার তীব্র বিরুদ্ধাচরণ করেন।[৩]
দুই বিশ্ব – পুঁজিবাদী বিশ্ব আর সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব – এই দুই ধরনের বিশ্ব ব্যবস্থাতেই বর্তমান যুগে রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যয়নের সংগে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক উপলব্ধি করা মানব সমাজের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তথ্যসূত্র
১. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, “এইচ, ই, ডুরিং- এর বিজ্ঞানে বিপ্লব”, পৃঃ ১৩৭, মস্কো, ১৯৩৪।
২. জোসেফ স্তালিন, “সোভিয়েত ইউনিয়নে কৃষি নীতির সমস্যা সম্পর্কে,” রচনাবলী, ইং সং, ১২শ খণ্ড, পৃঃ ১৪৮।
৩. এ লিয়নতিয়েভ, মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, সেরাজুল আনোয়ার অনূদিত, গণপ্রকাশন, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৫, পৃষ্ঠা ৯-১০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।