আদিম সাম্যবাদ হচ্ছে শিকার-সংগ্রহকারীদের উপহারের অর্থনীতিকে বর্ণনার উপায়

আদিম সাম্যবাদ বা আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সাম্যবাদ বা আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ (ইংরেজি: Primitive clan communism) হচ্ছে ঐতিহাসিক কাল জুড়ে শিকার-সংগ্রহকারীদের উপহারের অর্থনীতিগুলিকে বর্ণনা করার একটি উপায়, যেখানে সম্পদ ও সম্পত্তি সংগ্রহ ও একত্রিত করা হয় একটি গোষ্ঠীর সমস্ত সদস্যের সাথে এবং সেগুলোকে ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুসারে ভাগ করে নেওয়া হয়।

ক্রমবিকাশের প্রাথমিক স্তরগুলোতে অত্যন্ত কঠিন অবস্থাধীনে মানুষকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে হয়। লাঠি আর পাথর — বহু হাজার বছর ধরে মানুষের সর্বসাকুল্য হাতিয়ার এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রতি পদে অসংখ্য বিপদ তাকে বেষ্টন করে রাখতো। প্রকৃতির ভয়ঙ্কর শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে সে ছিল শক্তিহীন, প্রকৃতির নিয়ম-বিধি সম্পর্কে সে কিছুই জানতো না।

এই পরিস্থিতিতে ছোট ছোট সম্প্রদায়, ছোট ছোট গোত্রে বা গোষ্ঠীতে আবদ্ধ হয়েই মানুষ বসবাস করতো। তারা এক সাথে সবাই মিলে কাজ করতো এবং তাদের যৌথ শ্রমের ফসলও সবাই মিলে এক সাথে ভোগ করতো। মানবজাতির ক্রমবিকাশের এই নিম্ন স্তরগুলোতে কোনো অসমতাই থাকতে পারতো না, কারণ শিকার, পশুপালন বা অতি প্রাথমিক চাষাবাদের দ্বারা কেবলমাত্র কোনো রকমে টিকে থাকার মতো যথেষ্ট দ্রব্যই তারা সংগ্রহ করতে পারতো।[১]

ক্রমবিকাশের প্রথম আমলগুলোতে সকল মানুষই এই ধরনের আদিম গোত্রীয় কমিউন সমাজগুলোতে বসবাস করতো। পৃথিবীর যেসব দূরবর্তী স্থান অধিকতর উন্নত দেশগুলোর প্রভাবের বাইরে থাকতে পেরেছে সেসব স্থানে এমন কি অতি সম্প্রতি কাল পর্যন্ত এ ধরনের আদিম কমিউন সমাজের অস্তত্ব ছিল। যে ইউরোপীয় বুর্জোয়া শ্রেণি পৃথিবীর এসব সকল স্থানই জোর করে দখল করেছে, তাদের চাপে এসব সমাজ-সংগঠনের অবশ্য সর্বব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। অথচ, এক হাজার বা দেড় হাজার বছর পূর্বে এসব ইউরোপীয়দের কারো কারো পূর্ব-পুরুষও এ ধরনের আদিম গোত্রভিত্তিক সমাজে বাস করতো।

এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সমাজে শ্রেণি-বিভক্তির উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত আদিম গোত্র সাম্যবাদ বা Primitive clan communism প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন গোত্র ও জাতির মধ্যে এই ব্যবস্থার বিভিন্ন রূপ বিরাজ করতো। কিন্তু এসব বিভিন্নতা সত্ত্বেও, সমাজ-সংগঠনের প্রধান বৈশিষ্ট্যাবলীর ক্ষেত্রে সকল জাতির ক্রমবিকাশের প্রাথমিক স্তর পরিপূর্ণ সাদৃশ্য প্রদর্শন করে।

সমাজ বিকাশের প্রাথমিক স্তরগুলো, যেখানে আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থা বিরাজমান ছিল, অত্যন্ত ধীরগতির বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছিল। শত শত, এমন কি হাজার হাজার বছর ধরে, জীবন ধারনের অবস্থা কার্যত একরূপ বদলায়নি, কিংবা বদলালেও তা ছিল অত্যন্ত শ্লথগতি সম্পন্ন। মানুষ তার বিকাশের ক্ষেত্রে প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো প্রচণ্ড বাধাবিপত্তি সহকারেই গ্রহণ করে। প্রজন্মের পর প্রজন্মক্রম অতিবাহিত হয়েছে, অথচ সামাজিক অবস্থার কোনো লক্ষণীয় পরিবর্তন সাধিত হয়নি। বাস্তবিক পক্ষে অত্যন্ত ধীর গতিতেই মানুষ তার হাতিয়ারগুলোকে ও কাজের পদ্ধতিকে উৎকর্ষতা দান করতে শিখেছে।

আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থায় সামাজিক সম্পর্ক কিরূপ ছিল? আদিম সাম্যবাদী সম্প্রদায় বা গোত্র স্বভাবত ছিল সংখ্যায় ক্ষুদ্র ও ততকালে বিরাজমান কারিগরী অগ্রগতি দ্বারা একটি বিরাট মানবগোষ্ঠী তার সকল সদস্যের খাদ্যের সংস্থান করার আশা করতে পারতো না। এ ধরনের কোনো সম্প্রদায়ের শ্রম সংগঠন করা হতো কম-বেশী একটি পরিকল্পনা অনুসারে। সম্প্রদায়ের প্রত্যেক সদস্যেরই সুনির্দিষ্ট কাজ থাকতো। উদাহরণস্বরূপ, পুরুষরা শিকার করতো। নারীরা শিশু-সন্তানদের নিয়ে ঘরে থাকতো এবং ভূমি চাষাবাদও করতো। শিকার থেকে ফিরে আসার পর শিকার-লব্ধ পশু-পাখি ঐতিহ্যিক তথা প্রবীণদের প্রতি সম্মান-ভিত্তিক প্রথা অনুযায়ী ভাগাভাগি করা হতো।

“সংখ্যার দিক দিয়ে লোকসংখ্যা ছিল খুবই কম। গোষ্ঠীর (ইংরেজি: Tribe) নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে কেবল তারা একতাবদ্ধ থাকতো। এলাকার পাশেই এক বিরাট বৃত্তাকারে বেষ্টিত রয়েছে শিকারের ভূমি। অন্যান্য গোষ্ঠী থেকে সীমানা-নির্দেশক রেখা গঠন করছে এক নিরপেক্ষ বনাঞ্চল। শ্রম-বিভাগ পুরোপুরি আদিম প্রকৃতির। কাজকর্ম নারী-পুরুষের মধ্যে সরলভাবে বিভক্ত। পুরুষ জাতি যুদ্ধ করতো, শিকারে যেতো, খাদ্যের জন্যে কাঁচামাল ও এসব কাজকর্মের হাতিয়ার-পাতি যোগান দিত। নারী সম্প্রদায় ঘর-বাড়ীর দেখাশোনা করত, আর খাদ্য বস্তু তৈরি করতো; তারা রান্নাবান্না করতো, কাপড় বুনতো ও সেলাই করতো। নারী-পুরুষরা তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রের প্রভু ছিল; পুরুষরা বনের, আর নারীরা ঘরের। নারী-পুরুষ প্রত্যেকে যেসব হাতিয়ার তৈরি করতো সে সবের মালিক ছিল তারা নিজেরাই; পুরুষরা ছিল যুদ্ধাস্ত্র, পশু শিকার ও মাছ ধরার হাতিয়ার-পাতির মালিক, গৃহস্থালী দ্রব্য সামগ্রী ও বাসন-পত্রের মালিক ছিল নারী।[২] গৃহস্থালী জীবন ছিল সাম্যবাদী, বেশ কয়েকটি, আর প্রায়শঃ বহু পরিবার নিয়ে তা গঠিত হতো। যৌথভাবে যাই উৎপাদিত ও ব্যবহৃত হতো তাই বিবেচিত হতো সাধারণ সম্পত্তি হিসেবে: বাড়ীঘর, বাগান, লম্বা নৌকা।”[৩]

আদিম সাম্যবাদী অবস্থাধীনে বিনাশ্রমে লব্ধ আয়ের উপর জীবন ধারণকারী কোনো সামাজিক লোক-গোষ্ঠীর স্থান থাকতে পারতো না। আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থার রূপকাঠামোতে মানব সম্প্রদায়ের এক অংশ কর্তৃক অপর অংশের উপর কোনো রূপ শোষণই ছিল না। মানব জাতির ক্রমবিকাশের সেই স্তরে শ্রমের হাতিয়ার ছিল খুবই সরল, ফলত হাতিয়ার-পাতির ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মালিকানার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারতো না? খুব একটা পরিশ্রম ছাড়াই, প্রত্যেকে তার নিজের জন্যে একখানি বর্শা, একখানি প্রস্তর, একখানি তীর ধনুক ইত্যাদি তৈরি করে নিতে সমর্থ ছিল। একই সাথে, জমির উপর কোনো ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। জমি ছিল গোটা সম্প্রদায়ের, গোটা গোত্রের এজমালি (কমিউন্যাল) সম্পত্তি। এমনকি সমাজে শ্রেণিভেদ বিকাশের বহু যুগ পরেও কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে যথাযথভাবে জমির এজমালি মালিকানার এই অবশেষগুলোই সবচেয়ে বেশি স্থিতিশীল বলে প্রমাণিত হয়েছে। সমাজ বিকাশের পরবর্তী স্তরগুলোতে, কৃষকদের উপর শোষণ চালানো, কর সংগ্রহ করা ইত্যাদির সুবিধার্থে শোষক শ্রেণি ও শ্রেণি-রাষ্ট্র কৃষক কমিউনগুলোকে প্রায়শঃই কৃত্রিমভাবে বহাল রাখে। অন্যান্য ক্ষেত্রে, তার বিপরীতে, পুঁজিবাদের অবাধ বিকাশের পথ পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে শাসক শ্রেণি গ্রামাঞ্চলের এজমালি মালিকানা ভিত্তিক জীবনকে ধ্বংস করে দেয়।

এমনকি কৃষি কর্ম প্রাধান্যপূর্ণ হয়ে ওঠার পর, শ্রমের প্রধান রূপ হয়ে ওঠার পরও জমির উপর এজমালি মালিকানা বজায় ছিল। স্বতন্ত্র কৃষক পরিবারগুলোকে চাষাবাদের জন্যে যে জমি দেয়া হতো তা সময়ে সময়ে পুনর্বন্টন করা হতো। এই জমি গ্রামের এজমালি সম্পত্তি হিসেবে থাকতো এবং লটারীর মাধ্যমে বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে প্রায়শই পুনর্বন্টন করা হতো। গো-চারণ ভূমির উপর এজমালি মালিকানা এমনকি আরো দীর্ঘ সময় বহাল ছিল। পুঁজির শাসন প্রতিষ্ঠার পরও গোটা গ্রামের জন্য এজমালি গোচারণ ভূমি কোনক্রমেই দুর্লভ নয়।

এভাবে, সমাজে শ্রেণি বৈষম্যের উদ্ভবের পূর্ব পর্যন্ত আদিম গোত্র সাম্যবাদ বিদ্যমান ছিল। এই সমাজ পদ্ধতিতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও গোত্র বিশেষে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যও বিদ্যমান ছিল। কিন্তু, এসব বিশেষত্ব সত্ত্বেও, সমাজ ব্যবস্থার মৌলিক বৈশিষ্ট্য রীতির ক্ষেত্রে সকল জনগোষ্ঠীর মধ্যেকার বিকাশের প্রাথমিক স্তর সর্বাধিক সাদৃশ্যই বহন করে। 

সাম্যবাদ ও ব্যক্তিমালিকানার বিলুপ্তির ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে, বুর্জোয়া বিজ্ঞানীরা বিষয়গুলোকে এমনভাবে উপস্থিত করার চেষ্টা করে, যেন ব্যক্তিমালিকানা ছাড়া সমাজের অস্তিত্ব আর এমনকি খোদ মানুষের অস্তিত্বও কল্পনা করা যায় না। পুঁজিবাদের দাসানুদাসদের উদ্ভাবিত এই মিথ্যা গল্পকে মানব সমাজের প্রকৃত ইতিহাস সর্বাধিক নিঃসন্দেহেই খন্ডন করে দেয়। প্রকৃতপক্ষে বলতে গেলে, শ্রেণিতে শ্রেণিতে সমাজের বিভক্তির মতোই, ব্যক্তিসম্পত্তিও তুলনামূলকভাবে সমাজ বিকাশের বেশ পরবর্তী স্তরেই উদ্ভূত হয়। ব্যক্তি-সম্পত্তি সম্পর্কে কোনো নিম্নতম ধারণা ছাড়াই মানুষ হাজার হাজার বছর বাস করে এসেছে। 

আদিম সাম্যবাদ ধরনের সমাজ ব্যবস্থায় কোনো রাষ্ট্র ছিল না। ব্যক্তি সম্পত্তির উদ্ভব ও শ্রেণিতে শ্রেণিতে সমাজের বিভক্তির সাথে সাথে পরবর্তী সময়েই রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। রাষ্ট্র সম্পর্কিত তার বক্তৃতায় লেনিন নিম্নোক্ত কথাগুলি বলেছেন:

“আদিম সমাজে মানুষ যখন ছোট ছোট পারিবারিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে বসবাস করতো এবং তখনও ছিল ক্রমবিকাশের নিম্নতম স্তরে, এমন এক অবস্থায় যা বর্বরতার সমতুল্য – এমন এক কাল যার সাথে আধুনিক সভ্য মানব সমাজের রয়েছে হাজার হাজার বছরের ব্যবধান – তখন রাষ্ট্রের অস্তিত্বের কোনো চিহ্নই ছিল না। … … 

“কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যখন কোনো রাষ্ট্র ছিল না, যখন সাধারণ বন্ধন, সমাজ নিজে, তার শৃংখলা ও কর্মবিন্যাস বজায় থাকতো রীতি-নীতি ও ঐতিহ্য-প্রথার শক্তি দ্বারা; কিংবা সেই কর্তৃত্ব ও মর্যাদা দ্বারা যা গোষ্ঠীর প্রধানরা কিংবা মেয়েরা ভোগ করতো – সেসব যুগে মেয়েরা যে প্রায়শঃই পুরুষের সমান মর্যাদা লাভ করতো তাই নয়, বরং অনেক সময় তারা এমনকি অধিকতর মর্যাদাও ভোগ করতো – এবং যখন ছিল না শাসন-কার্যে বিশেষজ্ঞ কোনো বিশেষ ধরণের লোক। ইতিহাস দেখিয়ে দেয় যে, যখন ও যেখানেই সমাজে শ্রেণি বিভাগ দেখা দিয়েছে, অর্থাৎ মানুষের মধ্যে এমন একটা বিভক্তি দেখা দিয়েছে, যেখানে তাদের কেউ কেউ অন্যের শ্রম আত্মসাৎ করার মতো অবস্থান স্থায়ীভাবে লাভ করেছে, যেখানে কিছু লোক অন্যদের শোষণ করছে, সেখানেই মানুষের উপর দমন-পীড়নের এক বিশেষ যন্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে।” [৪]

তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, শাসক শ্রেণি ও শোষিত শ্রেণিতে সমাজের বিভক্তি কোনক্রমেই প্রতিটি সমাজ ব্যবস্থার চিরন্তন ও অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য নয়। বিপরীত পক্ষে, আমরা দেখছি যে, শ্রেণি সম্পর্কে, বা শোষণ সম্পর্কে, কিংবা ব্যক্তি-সম্পত্তি সম্পর্কে কোনো কিছু না জেনেই সমাজ অতি দীর্ঘ কাল পর্যন্ত টিকে ছিল।

তথ্যসূত্র

১. এ লিয়নতিয়েভ, মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, সেরাজুল আনোয়ার অনূদিত, গণপ্রকাশন, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৫, পৃষ্ঠা ১৮।

২. বিশেষত আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম তীরভূমি। ব্যানক্রফট-এর রচনা পড়ুন। কুইন শারলেট দ্বীপপুঞ্জের ‘হাইদাদের’ মধ্যে কোনো কোনো গৃহস্থালিতে একই ঘরে প্রায় ৭০০-এর মতো সদস্য একত্রে থাকে। ‘নোটকাদের’ মধ্যে গোটা গোষ্ঠীই এক ঘরে থাকে – এঙ্গেলস।

৩. এঙ্গেলস, “পরিবারের উৎস”, চার্লস, এইচ কার এণ্ড কোং, শিকাগো, ১৯০২, পৃঃ ১৯২-৯৩

৪. লেনিন, “রাষ্ট্র”, সংকলিত রচনাবলী, ২৯শ খণ্ড, মস্কো, ১৯৬৫, পৃঃ ৪৭৪-৭৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!