মার্কসবাদী শ্রেণি তত্ত্ব বা মার্কসীয় শ্রেণি মতবাদ (ইংরেজি: Marxist class theory) হচ্ছে কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস প্রণীত সামাজিক শ্রেণি সংক্রান্ত মার্কসবাদী বিশ্ববীক্ষা। মার্কসবাদীরা মনে করে উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশের একটি বিশেষ স্তরে শ্রেণির জন্ম হয়েছিল। উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তনের সাথে সাথে শ্রেণির মধ্যেও পরিবর্তন ঘটে। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে প্রতিটি মানুষই একটি শ্রেণির সদস্য হিসেবে বসবাস করে। নির্ধারিত হয় বিভিন্ন শ্রেণি। অর্থাৎ ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থায় সামগ্রিক শ্রম সংগঠনে মানুষের ভূমিকা, তার প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট সম্পদে মানুষের অধিকারের পার্থক্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণি নির্ধারিত হয়। যেমন- বুর্জোয়া শ্রেণি, যারা মিল-কারখানার মালিক এবং শ্রমিক শ্রেণি যারা মজুরির বিনিময়ে সেসব কারখানায় কাজ করেন। মানুষের চিন্তাধারার উপর শ্রেণির ছাপ অনিবার্য।[১]
পুঁজিবাদের দাসানুদাসরা সর্বশক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, শ্রেণিতে শ্রেণিতে সমাজের বিভক্তি অবশ্যম্ভাবী। শোষক ও শোষিতের অস্তিত্ব যেন চিরন্তন এবং যে কোনো সমাজের টিকে থাকার প্রয়োজনীয় শর্ত – এভাবেই বিষয়াবলীকে বর্ণনা করাটা টাকার থলির পূজারীদের পক্ষে জরুরি।
সেই সুপ্রাচীন রোম নগরীতে, যখন শোষিতরা তাদের প্রভুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল তখন শাসক শ্রেণির জনৈক পূজারী রূপকথার এক গল্প ফেঁদেছিল, যেখানে সে সমাজকে একজন ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে তুলনা করে, যেমন, কোন ব্যক্তির মধ্যে, অনুমেয় রূপে, কাজ করার জন্যে রয়েছে হাত, আর খাদ্য গ্রহণের জন্যে পেট, ঠিক তেমনি সমাজের মধ্যেও এমন কিছু লোক থাকতে হবে, যারা সমস্ত কাজকর্ম করবে এবং অন্যান্য কিছু লোক থাকবে যারা মজুরের শ্রমের ফসল আত্মসাৎ করবে। প্রকৃতপক্ষে, শোষক শ্রেণিসমূহের শাসনের পরবর্তী সকল সমর্থকরাই, মানুষ কর্তৃক মানুষের উপর শোষণমূলক ব্যবস্থার ধ্বংসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে, এই হীন রূপকথার চেয়ে অধিক কিছু বলেনি।[২]
বাস্তবে এটা সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, কোনো প্রকার শ্রেণিভেদ, শ্রেণিশাসন বা শোষণ ছাড়াই মানবজাতি বহু হাজার বছর ধরে বসবাস করেছে। এটা সুবিদিত যে, অগণনীয় কাল পূর্বে প্রাণীজগৎ থেকে মানুষের বিবর্তন ঘটে। মানুষ কখনোই নিজে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বসবাস করেনি, বরং সব সময় দলবদ্ধ হয়েই বসবাস করেছে। মানব জাতির ক্রমবিকাশের প্রথম স্তরগুলোতে এইসব দল ছিল ছোট ছোট। এই দলগুলোর স্বতন্ত্র সদস্যরা কোন ঘটনার দ্বারা জোটবদ্ধ হয়? এটা সুস্পষ্ট যে, যা তাদের জোটবদ্ধ করে তা হলো টিকে থাকার জন্য তাদের সাধারণ সংগ্রাম, খাদ্য সংগ্রহের জন্য তাদের সাধারণ শ্রম।
মানব সভ্যতার প্রথম দিকে আদিম সাম্যবাদী সমাজে শ্রেণি ছিল না। তখন মানুষের মধ্যে শোষণ-নিপীড়নও চলত না। রাশিয়ার কমিউনিস্ট নেতা লেনিন লিখেছেন, মানুষ মানুষকে শোষণ শুরু করার আগে সমাজ ছিল বংশ পরম্পরা, পারিবারিক দল, যখন মানুষ আত্মীয়তার সম্পর্কের ভিত্তিতে একসাথে জোটবদ্ধভাবে বসবাস করত। গোষ্ঠীর প্রবীণদের এমনকি কোথাও কোথাও নারীদের কর্তৃত্বে সমাজ পরিচালিত হতো। ঐসব সমাজের উৎপাদনের উপকরণ হাতিয়ারগুলো ছিল সমাজের অধিকারে–যা দিয়ে হিংস্র পশুর বিরুদ্ধে তারা আত্মরক্ষা করত।
এক পর্যায়ে সেই আদিম সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা ভাঙ্গনের পর থেকেই শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশ হয়। আরো নির্দিষ্টভাবে বলা যায়, উৎপাদনের উপকরণগুলোর উপর ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথেই শ্রেণি বিভাগ দেখা দিল এবং শ্রেণির উদ্ভব হলো। যা পরবর্তিতে দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ এবং পুঁজিবাদী সমাজে বিকশিত হয়েছিল।
তথ্যসূত্র
১. রায়হান আকবর, রাজনীতির ভাষা পরিচয়, আন্দোলন প্রকাশনা, ঢাকা, জুন ২০২০, পৃষ্ঠা ৫।
২. এ লিয়নতিয়েভ, মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, সেরাজুল আনোয়ার অনূদিত, গণপ্রকাশন, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৫, পৃষ্ঠা ১৮।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।