উৎপাদনের পুঁজিবাদী পদ্ধতি হচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদন ও বণ্টনের পদ্ধতি

কার্ল মার্কসের রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনা এবং পরবর্তী মার্কসীয় বিশ্লেষণে, উৎপাদনের পুঁজিবাদী পদ্ধতি (ইংরেজি: Capitalist mode of production) দিয়ে পুঁজিবাদী সমাজের মধ্যে উৎপাদন এবং বণ্টনকে সংগঠিত করার পদ্ধতিগুলিকে বোঝায়। সামন্ত-ভূমিদাস প্রথার অভ্যন্তরেই পুঁজিবাদের উদ্ভব। পুঁজির সবচেয়ে প্রাচীন রূপ হলো ব্যবসায়ী ও মহাজনী পুঁজি [commercial and usurer capital]। পুরানো স্বাভাবিক অর্থনীতির মধ্যে যতই বিনিময়-প্রথার বিকাশ ঘটতে থাকে, ততই বণিকেরা আরো অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে। বণিক-পুঁজিপতিরা ভূমিদাস-মালিক সামন্ত-জমিদারদের সব ধরনের বিলাস-দ্রব্য সরবরাহ করতে থাকে এবং সেই সূত্রে বেশ মুনাফা কামাতে থাকে। ভূমিদাসদের শুষে-নিংড়ে জমিদাররা যে খাজনা আদায় করতো তার একটি অংশ এভাবে ব্যবসায়ী পুঁজির প্রতিনিধি বণিকদের পকেটে গিয়ে জমা হতো। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটার সাথে সাথে মহাজনী কারবারও বিকাশ লাভ করে। জমিদার, রাজা, শাসকবর্গ – এসব মহাপ্রভুদের ক্রমবর্ধমান হারে বেশী বেশী টাকার দরকার হয়ে পড়লো। উন্মত্ত ভোগ-বিলাস ও অপচয় আর বিরামহীন যুদ্ধ-বিবাদ বিপুল পরিমাণ টাকা গ্রাস করলো। এভাবে মহাজনদের তৎপরতার ভিত্তি তৈরি হলো। চড়া সুদে সামন্ত-প্রভুদের টাকা দিয়ে, কুসিদজীবী মহাজনেরা ভূমিদাসদের শ্রম নিংড়ে আদায়কৃত করের এক বিরাট অংশ গ্রাস করতে লাগলো।[১]

সামন্তবাদী সমাজ জীবনে দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করে ব্যবসায়ী ও মহাজনী পুঁজি অপ্রতিহতভাবে এই সমাজের অবক্ষয় ঘটায় এবং তার ভিত্তি দুর্বল করে দেয়। ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধির সাথে সাথে জমিদার শ্রেণি কর্তৃক ভূমিদাসদের উপর শোষণ অব্যাহতভাবে প্রবল হতে থাকে। মাত্রাতিরিক্ত শোষণ ভূমিদাস-প্রথার ভিত্তি কৃষক-অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়। কৃষক-অর্থনীতি হয়ে পড়ে শক্তিহীন, জমিদারদের বিপুল আয় যোগাতে অসমর্থ হয়ে কৃষককূলও হয়ে পড়ে নিঃস্ব, ক্ষুধার রাজ্যে নিপতিত। একই সাথে মহাজনী পুঁজি সামন্ত জমিদারীগুলোকে আষ্টেপৃষ্ঠে গ্রাস করে, দলে-পিষে তার প্রাণবায়ু নির্গত করে দেয়। ভূমিদাস প্রথার অবক্ষয় পুঁজিবাদী উৎপাদনের উত্থানের পথ তৈরি করে দেয়।

ব্যবসায়ী-পুঁজি প্রথম দিকে কেবল ব্যবসা-বাণিজ্যেই নিয়োজিত ছিল। কারিগর ও ভূমিদাসদের দ্বারা যোগানকৃত উৎপন্ন-দ্রব্য এবং সাথে সাথে দূরের দেশগুলো থেকে আমদানীকৃত দ্রব্যাদি দিয়েই ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের বৃদ্ধির সাথে সাথে উৎপন্ন দ্রব্য-সামগ্রীর এসব উৎস অপ্রতুল প্রতিপন্ন হয়। ক্ষুদ্রায়তন হস্তশিল্পজাত উৎপাদন কেবল সীমিত পণ্য-সামগ্রীই সরবরাহ করতে পারতো, স্থানীয় বাজারের জন্যেই যা নিছক যথেষ্ট। যখন অধিক দূরবর্তী বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রচলন শুরু হলো তখন উৎপাদনের পুঁজিবাদী পদ্ধতি সম্প্রসারণ করার আবশ্যকতা দেখা দিল।

কিন্তু কেবলমাত্র পুঁজিই উৎপাদনের পুঁজিবাদী পদ্ধতি সম্প্রসারণ করতে পারতো। ক্ষুদ্রায়তন পণ্য উৎপাদন এক্ষেত্রে ছিল ক্ষমতাহীন; এর সম্ভাবনাসমূহ ছিল নিতান্তই সংকীর্ণ গণ্ডীতে আবদ্ধ । তখন ক্ষুদ্রায়তন-উৎপাদন থেকে পুঁজিবাদী উৎপাদনে উত্তরণ ঘটলো, যা প্রাক-পুঁজিবাদী শোষণ পদ্ধতিসমূহ ধ্বংস করে দিল কেবলমাত্র সেগুলোর স্থানে মানুষ কর্তৃক মানুষকে শোষণের সর্বশেষ রূপ পুঁজিবাদী শোষণকে অভিষিক্ত করার জন্যে। ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদন থেকে পুঁজিবাদে এই উত্তরণ সম্পর্কে লেনিন নিম্নোক্ত বর্ণনা দিয়েছেন:

“পুরানো অবস্থাধীনে দেশের সকল সম্পদই বাস্তবত উৎপাদিত হতো ক্ষুদে-উৎপাদকদের দ্বারা, যারা ছিল জনসংখ্যার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। জনসাধারণ গ্রামাঞ্চলে স্থায়ী জীবন যাপন করতো, তাদের বেশীর ভাগ উৎপাদনই হতো হয় তাদের নিজেদের ভোগের জন্য, না হয় পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহের ছোট ছোট হাটের জন্য, নিকটবর্তী অন্যান্য বাজারের সাথে যেগুলোর যোগাযোগ ছিল খুবই কম। খোদ এই ক্ষুদে-উৎপাদকরা আবার জমিদারদের জন্যও কাজ করতো, যারা মূলত তাদের নিজেদের ভোগের জন্য জিনিসপত্র তৈরি করতে এদের বাধ্য করতো। গৃহে উৎপাদিত কাঁচামাল কারিকরদের নিকট দেয়া হতো নানা জিনিস তৈরি করার জন্য, যে কারিগররা গ্রামেই বাস করতো তবে কাজ পাওয়ার জন্যে মাঝে মাঝে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত।

“তবে ভূমিদাস-কৃষকদের মুক্তি অর্জনের পর, ব্যাপক জনগণের জীবন ধারণের এইসব অবস্থার এক পরিপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয় ও ক্ষুদে কারিকর প্রতিষ্ঠানের স্থলে আসতে শুরু করে বড় বড় কারখানা, যেগুলো অসাধারণ দ্রুততার সঙ্গে বাড়তে থাকে। ক্ষুদে-উৎপাদকদের এগুলো উচ্ছেদ করে দেয়, তাদের পরিণত করে মজুরী-শ্রমিকে, আর লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে বাধ্য করে একত্রে কাজ করতে, উৎপাদন করে বিপুল পরিমাণ পণ্য-সামগ্রী যেগুলো সারা রাশিয়া জুড়ে বিক্রী করা হয়। … … …  

“বৃহদায়তন উৎপাদন সর্বত্রই ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদনের স্থলাভিষিক্ত হয়, আর এসব বৃহদায়তন উৎপাদনে ব্যাপক শ্রমিক সাধারণ পুঁজিপতিদের দ্বারা মজুরীর বদলে কর্মরত নিছক ভাড়াখাটা ব্যক্তিতে পরিণত হয়, যে পুঁজিপতিরা হলো বিরাট পুঁজির মালিক, যারা বিরাটাকারের কারখানা নির্মাণ করে, যারা বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল ক্রয় করে, এবং একত্রীভূত মজুরদের বিপুলায়তন উৎপাদনের সমস্ত মুনাফাই নিজেদের পকেটস্থ করে। উৎপাদন হয়ে পড়ে পুঁজিবাদী উৎপাদন, আর তা সকল ক্ষুদে-উৎপাদকদের উপর নির্দয় ও নির্মম চাপ প্রয়োগ করে, ভেঙে দেয় গ্রামদেশে তাদের স্থিতিশীল জীবন, বাধ্য করে তাদের সাধারণ অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে, পুঁজিপতিদের নিকট তাদের শ্রমশক্তি বিক্রী করতে। জনসংখ্যার এক ক্রমবর্ধমান অংশই চিরদিনের জন্যে গ্রামাঞ্চল থেকে, আর কৃষিকর্ম থেকে, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং জড়ো হয় শহর, কারখানা এবং শিল্প এলাকা ও বসতিতে, সৃষ্টি হয় বিশেষ ধরনের বিত্তহীন শ্রেণির মানুষ, মজুরী-খাটা সর্বহারা শ্রমিকের শ্রেণি, যারা বেঁচে থাকে কেবল তাদের শ্রমশক্তি বিক্রী করেই।”[২]

তথ্যসূত্র

১. এ লিয়নতিয়েভ, মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, সেরাজুল আনোয়ার অনূদিত, গণপ্রকাশন, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৫, পৃষ্ঠা ২৯-৩০।

২. ভি আই লেনিন, “সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জন্য কর্মসূচীর খসড়া ও ব্যাখ্যা”, সংকলিত রচনাবলী, ২য় খন্ড, ইংরেজি সংস্করণ, মস্কো, ১৯৬৫, পৃঃ ৯৯-১০০

Leave a Comment

error: Content is protected !!