উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ (ইংরেজি: William Wordsworth; ৭ এপ্রিল ১৭৭০ – ২৩ এপ্রিল ১৮৫০) ছিলেন ইউরোপের ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক কাব্য আন্দোলনের যুগপুরুষ কবি, যিনি, স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের সাথে, তাদের যৌথ প্রকাশনা লিরিকাল ব্যালাডস (১৭৯৮) দিয়ে ইংরেজি সাহিত্যে রোমান্টিক যুগ চালু করতে সহায়তা করেছিলেন।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের ৭ এপ্রিল ইংল্যান্ডের ক্যাম্বারল্যান্ডের একটি ছোট শহর ককারমাউথে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ এপ্রিল ৮০ বছর বয়সে মারা যান। দীর্ঘজীবনের অধিকারী ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রায় ৫০ বছর কাব্যচর্চায় নিমগ্ন থেকে ইংরেজি সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থের নিরলস কাব্যচর্চার দিকে দৃষ্টি রেখেই বিস্মিত সমালোচকবৃন্দ মন্তব্য করেছিলেন— “Wordsworth is unique in the history of English poetry.”
উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ একদিকে ছিলেন প্রকৃতির কবি, ঐশী চেতনার কবি; অন্য ধারে তার প্রকৃতি চেতনা একটা দার্শনিক প্রত্যয়ে পর্যবশিত হয়েছিল। ওয়ার্ডসওয়ার্থের এই কর্মপ্রচেষ্টার দিকে নজর রেখেই সমালোচকরা তাকে প্রকৃতির মহাকবি ও দার্শনিক, The Highest Priest of Nature প্রভৃতি অভিধায় অভিহিত করেছেন। উনবিংশ শতাব্দীতে নব্য ক্লাসিক সাহিত্যের বিরুদ্ধে যে সমস্ত কবি বিদ্রোহ ঘোষণা করে রোমান্টিকতাবাদের জয়গান গেয়েছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন এই উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি তাঁর কবিতায় প্রাধান্য পায় সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ এবং হাসি-কান্না, গ্রামীণ কৃষকের প্রাত্যহিক জীবনালেখ্য।
উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ রচনাবলী
উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রথম কবিতা ‘অ্যান ইভেনিং ওয়াক’। এটি রচিত হয় ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে। এই একই বছর ডেসক্রিপটিভ স্কেচেস’ নামের আর একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। এটিতে ওয়ার্ডসওয়ার্থের আল্পস্ পর্বতের ভ্রমণকাহিনি এবং সুইজারল্যান্ডের কৃষকদের সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতার বর্ণনা আছে।
১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও তাঁর বন্ধু স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের যুগ্ম সম্পাদনায় ‘লিরিক্যাল ব্যালাডস’ প্রকাশিত হলে বিশ্বসাহিত্যে রোমান্টিক যুগের সূচনা হয়। এখানে কোলরিজের চারটি ও ওয়ার্ডসওয়ার্থের উনিশটি কবিতা স্থান পেয়েছে। কাব্যটি সেসময়কার কবি সাহিত্যিকদের দৃষ্টিভঙ্গীকেই পরিবর্তন করে দেয়। এর ভূমিকায় নতুনযুগের কাব্যের আদর্শ, স্বরূপ, ভাষা এবং আঙ্গিক কেমন হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে ‘লিরিক্যাল ব্যালাডস’ ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবি জীবনের মাইলস্টোন হিসাবে গণ্য।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ ১৭৯৯ থেকে ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তাঁর আত্মজীবনিমূলক কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য প্রিলুউড’ রচনা করেন। এটি ওয়ার্ডসওয়ার্থের সৃষ্টিশীল সময়ের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। এখানে মোট ১৪টি সর্গ আছে। দীর্ঘ ছয় বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় অতীত স্মৃতি রোমন্থণের এই কাব্যটিকে বলা হয়— ‘Memmory Recollect in Tranquility’. কাব্যটির মূল লক্ষ্য ছিল— ‘Self Examination and Self Expression’ বা আত্মসমীক্ষা ও আত্মবিশ্লেষণ।
উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের আর একটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো ‘লুসি গ্রুপ অব পোয়েমস। ওয়ার্ডসওয়ার্থের সমগ্র কাব্যসম্ভারে প্রেমের কবিতার যে অভাব লক্ষ্য করা যায় তা কিছুটা পূর্ণ করেছে এই কাব্যটি। তবে এখানে তথাকথিত Passionate love বা আবেগপ্রবণ ভালোবাসাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এখানে প্রকৃতির সঙ্গে লুসি একাত্ম হয়ে গেছেন যে প্রকৃতির মত সরল ও নিপাপ। এই কাব্যে লুসির কোন সংলাপ নেই কেবল লুসিকে কেন্দ্র করে কবির আবেগ ও উচ্ছাস প্রকাশিত হয়েছে। লুসি বিষয়ক কবিতার সংখ্যা ছয়টি। এসব কবিতায় দেখানো হয়েছে লুসি প্রকৃতির প্রতীক এবং একই সঙ্গে বিশুদ্ধ প্রেমের প্রতীক। এক নির্জন কুটিরে একাকী সে বসবাস করে। প্রেমিক কবি অশ্বারোহণ করে সেখানে গিয়ে লুসির সাথে মিলিত হন। সমগ্রকাব্যে লুসির শারীরিক সৌন্দর্যের কোন বর্ণনা নেই। কবি চন্দ্রালোকে লুসিকে প্রত্যক্ষ করেন, আবার কালো মেঘে চাঁদের আলো নিভে গেলে লুসির মৃত্যুর আশঙ্কায় কবি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। কোন কোন সমালোচক মনে করেন লুসির চরিত্রে ওয়ার্ডসওয়ার্থের স্নায়বিক রোগগ্রস্থ বোন ডরোথির বাস্তব ছায়া প্রতিফলিত হয়েছে। তবে এ বিষয়ে এখনও বিতর্ক আছে।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের একটি বিশিষ্ট চতুর্দশপদী কবিতার সংকলন ‘একলেসিয়াস্টিক্যাল সনেট’। এতে মোট ১৩২টি সনেট রয়েছে। এগুলির বিষয়বস্তু ধর্মীয় অনুভূতি ও দার্শনিক তত্ত্ব। অবশ্য সমগ্র জীবনে ওয়ার্ডসওয়ার্থ তিন শতাধিকেরও বেশি সনেট রচনা করেছেন। এর মধ্যে প্রকৃতি, স্বদেশ ও মানব জীবনভিত্তিক সনেটের সংখ্যাও কম নয়। সনেটগুলি ছাড়াও আর যে সকল কবিতায় ওয়ার্ডসওয়ার্থ সারা পৃথিবীতে খ্যাতিলাভ করেছেন সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘লাইনস্ কম্পোস্ট অব ফিউ মাইলস্ অ্যাবাভ টিনটার্ন অ্যাবে’, ‘লন্ডন’, ‘ওড টু ডিউটি’, ‘দ্য ফাউন্টেন’, ‘দ্য সলিটারি রিপার’, ‘দ্য টু এপ্রিল মর্নিং’, ‘টু এ স্কাইলার্ক’, ‘টু দ্য কাকু’, ‘টু দ্য ডাইসি’, ‘সেপ্টেম্বর’, ‘দ্য এক্সারসন’, ‘লাউডামিয়া প্রভৃতি।
কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের চারটি কবিতার আলোচনা দেখুন ইউটিউব থেকে
রোমান্টিক কবি বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল ওয়ার্ডসওয়ার্থ
উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ রোমান্টিক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন সেজন্য তিনি আদ্যোন্ত রোমান্টিক। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কবিতায় রোমান্টিকতার নানা বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে। যে সমস্ত বৈশিষ্ট্যের জন্য ওয়ার্ডসওয়ার্থকে রোমান্টিক পট পরিবর্তনের প্রথম কবি হিসাবে ধরা হয় সেগুলি হলো—
প্রথমত:
সব রোমান্টিক কবিদের মত ওয়ার্ডসওয়ার্থ ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক। তিনি প্রকৃতিকে এক জীবন্ত সত্তারূপে উপলব্ধি করেছিলেন। আর ঐ সত্তার মধ্যে ওয়ার্ডসওয়ার্থ ঐশ্বরিক সত্তাকে আবিস্কার করেন।
দ্বিতীয়ত:
ওয়ার্ডসওয়ার্থ বিশ্বাস করতেন যে প্রকৃতির সান্নিধ্যে মানব হৃদয়ে যথার্থ আনন্দ ও প্রশান্তি আসে। এই প্রকৃতিই যন্ত্রণাদগ্ধ মানবজীবনকে শ্বাশত আনন্দে ভরিয়ে তুলতে পারেন। সুতরাং তাঁর কাছে দুঃখ ও গ্লানিময় মানব জীবনের পাশে প্রকৃতিই একমাত্র আরোগ্য নিকেতন বলে মনে হয়েছিল।
তৃতীয়ত:
ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর কবিতায় প্রকৃতিকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে, তাঁর মনে হয়েছিল মানুষের জীবন প্রকৃতির নৈতিক প্রভাব রয়েছে। তিনি মনে করতেন প্রকৃতি হল মানুষের শিক্ষক, সেবিকা, রক্ষক এবং স্নেহময়ী জননী; প্রকৃতি কখনও মানুষকে প্রতাড়িত করেনা, বিশেষত যে মানুষ তাকে ভালোবাসে। ‘টিনটার্ন অ্যাবে’ কবিতায় তিনি লিখেছেন- “Knowing the nature ever did beauty the heart that love her.”
চতুর্থত:
ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রকৃতি সৌন্দর্যময়ী, স্নেহময়ী, শান্ত ও সমাহিত। তিনি মনে করতেন প্রকৃতির মধ্যে মানুষ ও ঐশীশক্তির যথার্থ মিলন ঘটতে পারে। প্রকৃতির সাহায্য ব্যতিরেকে মানুষের শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়না; মানুষ মহৎ হয়ে ওঠেনা। এ ব্যাপারে ওয়ার্ডসওয়ার্থের জীবনদৃষ্টিভঙ্গীর সাথে উপনিষদের সঙ্গে প্রজ্ঞাবান ঋষিদের জীবনদর্শনের গভীর সাদৃশ্য আছে।
উপসংহার
সর্বোপরি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ রোমান্টিক কাব্য আন্দোলনের যে অগ্রপুরুষ ছিলেন তার প্রমাণ পরবর্তীকালের বিশ্বসাহিত্যের প্রচুর রোমান্টিক কবিদের কাব্যে তাঁর প্রভাব পড়েছে। বাঙ্গালী গীতিকবিরাও ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেননি। আধুনিক বাংলা কাব্যের প্রথম কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্য ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রভাব তো পড়েছিল; পরবর্তীকালে বিহারীলাল চক্রবর্তীর নেতৃত্বে বাংলা গীতিকাব্যের জয়যাত্রা শুরু হলে সে সময়কার কবিদের কবিতাতেও ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রভাব পড়েছে। বিহারীলালের ‘সঙ্গীত শতক’, ‘নিসর্গ সন্দর্শণ’ ‘সারদামঙ্গল’ প্রভৃতি কাব্যে ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রভাব অত্যন্ত ব্যপক। রবীন্দ্রনাথও কাব্যজীবনে ওয়ার্ডসওয়ার্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনিও ওয়ার্ডসওয়ার্থের মত প্রকৃতির সাথে মানবাত্মার একাত্ম অনুভব করেছেন ‘বসুন্ধরা’, ‘সমুদ্রের প্রতি’, ‘যেতে নাহি দিব’ প্রভৃতির মত অসংখ্য কবিতায়। ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘প্রিলুউড’ কাব্যের চতুর্থ স্তবকের সাথে রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। সুতরাং ওয়ার্ডসওয়ার্থ যে একজন বড়মাপের রোমান্টিক কবি ছিলেন এ সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।