শাহেরা খাতুনের স্বপ্ন বাসনায় লুকিয়ে ছিল নারী মুক্তির এক মহান আকুতি। সেই স্বপ্নকে সারা জীবন লালন করে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে বিগত ২ জুন ২০২১ তারিখে পরলোক গমন করেছেন। মোবাইল ফোনে দোলন প্রভার কাছে দুঃসংবাদটি শুনে বড়ই ব্যথিত হলাম। বারবার হৃদয় স্মৃতিপটে ভেসে উঠল শাহেরা খাতুনের সাথে আমার প্রথম দিনের সাক্ষাতের কথা।
প্রায় এক যুগ পূর্বের কথা। ২০১০ সনের নভেম্বর মাস। দিনাজপুরে হালকা শীত পড়া শুরু করেছে। শাহেরা খাতুন দোলনকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন ডক্টর তিমির বরণ বসাকের নিকট।
হালকা শীতের পড়ন্ত বিকেলে আমরা তিনজন ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছি। শাহেরা খাতুনের সাথে আমার এই প্রথম পরিচয়। আমি সালাম দিলে উনি বললেন কি নাম তোমার বাবা। আমি উত্তর দিতেই আরও কিছু কথপকোথন শুরু হলো আমাদের। উনার সুগঠন দেহ; বয়স প্রায় পঞ্চান্ন কিংবা ষাট হবে, দেহের গড়ন দেখে ঠাহর করা কঠিন; কিন্তু এক পর্যায়ে কথায় কথায় জানতে পারলাম উনার বয়স এখন একাত্তর বছর চলে। এমন বয়সেও একজন মানুষের দেহের এমন সুগঠন তাও জানতে পারলাম তাঁর আলাপচারিতায় নিয়মনিষ্ঠ প্রাত্যহিক জীবনের কাজকর্মের কথায়।
উনার সিরিয়াল নম্বর একটু দূরে ছিল। ডাক্তার দেখাতে প্রায় রাত নয়টা বেজে গেল। তাই হয়তো সেদিন উনার জীবনের অনেক কথায় আমার শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাল্যকালের অনেক স্মৃতিময় কথাই বললেন। দেশ ভাগের পরে এদেশে স্বামীর সংসারে এসেছেন সেই পশ্চিম বঙ্গের মালদহ থেকে। মালদহ ও মুর্শিদাবাদে ঘোরাঘুরির স্মৃতির কথা, বাল্যকালে পদ্মা ও পাগলা নদীতে সাঁতরানোর কথা, ছোট ও বড় সোনা মসজিদ দেখার কথা, ছোট ডিঙ্গায় নদী ভ্রমণের কাহিনী এমনভাবে বলছিলেন যেন এক গল্পকথক।
এদেশের কথা আমি বলতেই-উনি মুচকি হেসে বললেন তোমাদের কাছে তো বাপু আজ এদেশ ওদেশ কিন্তু আমার কাছে তা মনে হয় না; মনে হয় একই দেশ। দেশ ভাগ হলো কত কি দেখলাম। আবার যুদ্ধ হলো আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ হলাম। দেশ ভাগে কত আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি সেদেশে রয়ে গেল। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকবাহিনীর হাতে কত আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি, পরিচিত জন মারা গেল। সেই শোক-দুঃখের কত স্মৃতি বাপু। আজ কত কি বদলে গেছে, সে-দিনের কথা মনে পড়লে এখনো বুকটা শুকিয়ে যায়।
আমি বললাম আপনি যেভাবে গল্প শোনাতে পারেন গ্রামের তো অনেকে আপনার নিকট গল্প শুনতে আসে। এবার আরেকটু মুচকি হেসে বললেন শুধু কি গল্প, ওরা গীতও গাইতে আসে, নকশি কাথায় ফুল তোলা শিখতে আসে। উনার কথায় জানলাম প্রায় দু’তিনশ গীত উনি জানেন। বাংলার বিভিন্ন ঋতুর প্রাক্কালের গীত, বিয়ের গীত, বিরহের গীত ইত্যাদি আর গাঁয়ের গীত গাওয়ার দলের উনি মধ্যমনি। বললাম, তাহলে তো ভালই আনন্দ করে দল বেধে আসর বসিয়ে গীত গাওয়া হয়। বললেন গ্রামগঞ্জে আমাদের মেয়েদের কি সে স্বাধীধনতা আছেরে বাবা। ছোটকালে দেখতাম বর্ষা কালে, শীত কালে পিঠা বানাতে বানাতে দাদী চাচিমারা গীত ধরত; আর বিয়েতে তো মাস ধরেই গীত গাওয়ার ধুম লেগে থাকতো। এখন সে কাল আর নাই। আমরা শুধু বিয়েতে একটু আধটু গাই।
পিঠার কথা উঠতে কত রকমের পিঠা বানানো যায় তা বলে গেলেন। বাহারী ফুল তোলা নঁকশি কাঁথার বাহারী নাম বললেন; সেসব নাম আজ আমার তেমনটা মনে নেই। এক পর্যায়ে একটি কথার দরুণ কিছু ভেষজ উদ্ভিদের গুনাগুনের কথা বললেন; নীমপাতা, বেল পাতা, থানকুনি পাতা, পদ্ম, লালপদ্ম, কচি ডালিম, পাথরকুচি কোনটা কিভাবে খেলে কি ওষুধি কাজ করে।
গ্রামের দরিদ্র ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার কাজে কিছুটা সহযোগিতাও করেন। উনার কথায় বুঝতে পারলাম ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার গুরুত্বের কথা। বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে দেখলাম অনেক বেশি আগ্রহী। তাঁর কথায় মেয়েরা শিক্ষিত হলে জীবনটা উপভোগ করতে পারে, মর্যাদা পায়, মানুষ হতে পারে। কিন্তু মেয়েরা শিক্ষিত হতে না পারলে চার দেওয়ালের গৃহেই পুরো জীবটা কেটে যায়।
উনার সিরিয়ালের ডাক পড়ল। ডাক্তারের রুমে প্রবেশ করলেন। সেদিন ডাক্তার উনাকে তেমন কোন টেস্ট দেননি; প্রেশার মেপে প্রেশারের ঔষুধ দিয়েছিলেন। সেই ঔষুধেই নাকি পরবর্তী দীর্ঘ নয়-দশ বছর সুস্থ ছিলেন তাঁর নিয়মনিষ্ঠ স্বভাবের জোরে।
শাহেরা খাতুনের একটি স্বপ্ন কথা আমার হৃদয়-মনে গভীরভাবে আঁচ কেটেছে ওই যে ‘‘মেয়েরা শিক্ষিত হতে না পারলে চার দেওয়ালের গৃহেই পুরো জীবনটা কেটে যায়’’। শাহেরা খাতুনের মত আমাদের গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে শত শত নারীরই মনে এমন হৃদয় বাসনা আর স্বপ্নের ঝুড়ি যে নারীরা শিক্ষিত হোক, নারীদের মর্যাদাপূর্ণ জীবন হোক আর তাঁদের জীবন চার দেওয়ালের বেড়াজাল ভেদ করে উপভোগের ও বিজয়ের হোক।
শাহেরা খাতুনের বিদেহী আত্মা পরকালে সুখে থাক। হয়তো কোনো একদিন এমনি সরলমনা লক্ষ কোটি শাহেরা খাতুন চার দেওয়ালের বেঁড়াজাল ভেদ করে বিজয়ের ঝাণ্ডা নিয়ে এগিয়ে যাবে প্রগতির পথে।
ফুলকিবাজ ডট কমে অতিথি লেখক হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, কলাম, অনুবাদ, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লেখায় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন পূরবী সম্মানিত, ইভান অরক্ষিত, রনো সরকার, দিল আফরোজ, অনাবিলা অনা এবং রণজিৎ মল্লিক। এছাড়াও আরো অনেকের লেখা এখানে প্রকাশ করা হয়।