মহর্ষি বাল্মীকি সংস্কৃত সাহিত্যের মহাকাব্য রামায়ণের রচয়িতা আদি কবি

বাল্মীকি বা মহর্ষি বাল্মীকি (সংস্কৃত: वाल्मीकि, Vālmīki) সংস্কৃত সাহিত্যের আদি কবি হিসাবে পরিচিত। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতক পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে লেখা মহাকাব্য রামায়ণকে সেটার পাঠ্যের বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে বাল্মিকীর রচিত বলে বিবেচনা করা হয়।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মহাকাব্য রামায়ণ। পারিবারিক জীবনের বাইরে যে এক বিশাল কর্মধারা প্রবহমান, তার নীতি নির্ধারণ করেছে মহাকাব্য মহাভারত। অন্যদিকে রামায়ণ বিধৃত করেছে পারিবারিক জীবনের মহান জীবনাদর্শ।

ঘর মাত্রই হচ্ছে আশ্রম, এই আশ্রমের প্রত্যেক সদস্যের মধ্যে সম্পর্কের আদর্শ কত মহান ও সুন্দর হতে পারে, মহাকাব্য রামায়ণ পাঠে তা জানা যায়।

প্রধানত এই রামায়ণ মহাকাব্যই ভারতীয় পরিবারের অনুকূল আদর্শ হিসেবে গণ্য হয়ে এসেছে। শত শত বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার হিন্দু পারিবারিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে রামায়ণ কাহিনী। এখানেই এই মহাকাব্যের শ্রেষ্ঠত্ব। পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে এই গ্রন্থের তুলনা আছে কেবল কয়েকটি।

মহর্ষি বাল্মীকি একাধাবে এই মহাকাব্যের উল্লেখযোগ্য চরিত্র তথা প্রাণপুরুষ এবং রচয়িতাও। খুবই আশ্চর্যের বিষয় এটা যে এই গ্রন্থে তার জীবন-কাহিনী বিধৃত আছে। শুভ, অশুভ, ভাল ও মন্দ মিশিয়েই মানুষ। কিন্তু শুভবোধ একজন মানুষের জীবনকে কিভাবে আমূল পাল্টে দিতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাল্মীকির জীবন।

কর্মজীবনের শুরুতে তিনি ছিলেন একজন নরঘাতক দস্যু-দস্যু রত্নাকর। এই দস্যু বা ডাকাত জীবন পরিত্যাগ করেই একদিন হয়ে উঠলেন মহর্ষি বাল্মীকি।

অতি প্রাচীনকালে আনুমানিক আড়াই হাজার বছর আগে সুমতি নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। দেবদ্বিজে ভক্তিমান এই ব্রাহ্মণের একমাত্র পুত্রের নাম ছিল রত্নাকর। ব্রাহ্মণসন্তান হলেও রত্নাকর ছিলেন দেবদ্বিজে ভক্তিহীন। ব্রাহ্মণ্য আচার নিষ্ঠা ও শাস্ত্রপাঠে তার কোনো রুচি ছিল না। সর্বোপরি তিনি ছিলেন পিতামাতার অবাধ্য সন্তান। তাই তার পিতাকেই সংসারের সমস্ত দায় বহন করতে হয়েছিল।

সুমতি যেখানে বাস করতেন, সেই অঞ্চলে একসময় ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। পরিবার প্রতিপালন কঠিন হয়ে পড়ায় সুমতি স্ত্রী পুত্র সহ অন্যত্র বাস করবেন বলে গৃহত্যাগ করে বেরিয়ে পড়লেন। নানা দেশ ঘুরে ঘুরে একসময় তারা গভীর জঙ্গলে এসে পৌঁছলেন। ব্রাহ্মণ সুমতি সেখানেই কুটির নির্মাণ করে বসবাস শুরু করলেন।

দীর্ঘদিন অতিক্রান্ত হবার কারণে ততদিনে তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন। কাজকর্মেও শক্তিহীন হয়ে পড়েছেন। ফলে সংসারের তিনটি মানুষের অন্ন সংস্থানে বাধা পড়ল। রত্নাকর উপার্জন করে সংসার চালাবেন সেই ক্ষমতা তার কোথায়? তিনি বিদ্যাহীন, কাজেই বাধ্য হয়েই তাকে ডাকাতি পেশা গ্রহণ করতে হলো। সেই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথিকদের চলার পথ। রত্নাকর দিনভর সেই পথের ধারে বসে থাকেন। বনের পথে কোনো যাত্রী উপস্থিত হলেই তিনি তার সর্বস্ব লুঠ করার পরে হত্যা করেন।

দস্যু রত্নাকর এইভাবেই বৃদ্ধ পিতামাতার ভরণপোষণ করে চললেন। এইভাবে দীর্ঘদিন পার হলো। জঙ্গলের বাইরে দস্যু রত্নাকরের বিভীষিকা দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ল। এই সময়ে জগতের মঙ্গলের ইচ্ছাতেই বুঝি বিধাতাপুরুষ বেছে নিলেন দস্যু রত্নাকরকে। তাকে দিয়ে রূপায়িত করতে চাইলেন এর মহৎ আদর্শ।

একদিন সপ্তর্ষিগণ বিধাতার নির্দেশে ছদ্মবেশে রত্নাকরের জঙ্গলের পথ দিয়ে তীর্থযাত্রা করলেন। দস্যু ঝোপের আড়ালেই আত্মগোপন করে ছিলেন। তীর্থযাত্রীরা কাছে আসতেই ভয়ানক হাঁক ছেঁড়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, তোমাদের সঙ্গে ধনসম্পদ যা আছে বের করে দাও। আর শেষবারের মত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে নাও। আমি তোমাদের হত্যা করব। দস্যু রত্নাকরের সঙ্গে একবার যার এপথে দেখা হয় সে প্রাণ নিয়ে কখনো ফিরতে পারে না।

সপ্তর্ষিদের মধ্যে ঋষি অত্রি রত্নাকরকে তখন বললেন, হে দস্যু, বধ করবার আগে আমার দুটি কথা শোনো। আমরা তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছি। ধন সামান্যই আমাদের সঙ্গে রয়েছে। এই সামান্য ধনের জন্য তুমি ঋষি হত্যার পাপ কেন করতে চাইছ?

দস্যু রত্নাকর নিষ্টুর হেসে বললেন, ঋষিবর, আমি পাপের ভয়ে ভীত নই। কারণ আমি দস্যু বৃত্তি নিজের জন্য গ্রহণ করিনি। অত্রি জানতে চাইলেন, তবে কার জন্য? রত্নাকর বললেন, আমি পথিকদের মেরে যে ধন লুঠ করি তা দিয়ে বৃদ্ধ পিতামাতা ও স্ত্রী পুত্রের ভরণপোষণ করি। কাজেই এই কাজের পাপের দায় তারাই গ্রহণ করবেন।

ঋষি অত্রি হেসে বললেন, মুর্খ দস্যু, তুমি যে কাজ করছ তার দায় একা তোমারই-তোমার পাপের ভাগ সংসারের আর কেউই গ্রহণ করবেন না। এই কথা শুনে রত্নাকর প্রতিবাদ জানালে অত্রি পুনরায় জানালেন, তুমি আমাদের কোনো গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে তোমার বাড়িতে যাও। সেখানে তোমার পিতামাতা স্ত্রী-পুত্রকে জিজ্ঞাসা করে জেনে এসো, তারা তোমার পাপের ভাগ নিতে রাজি আছেন কিনা।

যদিও রত্নাকর দস্যু, তদুপরি তিনি ধার্মিক ব্রাহ্মণের সন্তান। ধর্মচিন্তা বা ধর্মকর্মের মতি না থাকলেও জন্মগত ভাবে কর্মফলের চিন্তা ও পাপ ভয় সূক্ষ্ম ভাবে হলেও তার মনে বর্তমান ছিল। তিনি চিন্তিত হলেন। পরে ঋষিদের একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে দ্রুত ঘরে ফিরে গেলেন। প্রথমেই তিনি গেলেন বৃদ্ধ পিতার কাছে। জানতে চাইলেন, পিতা, আমি দস্যু বৃত্তির দ্বারা আপনাদের ভরণপোষণ করছি। দস্যুবৃত্তির ফলে আমার যে পাপ হচ্ছে সেই পাপের ভাগ কি আপনি নেবেন?

পুত্রের কথা শুনে বৃদ্ধ পিতা সুমতি বললেন; পুত্র, বৃদ্ধ পিতার ভরণপোষণ করা প্রত্যেক পুত্রেরই কর্তব্য। তুমি আমার পুত্র। তোমার কাছ থেকে আমি সেবা নিতে পারি। কিন্তু তোমার পাপ আমি গ্রহণ করতে পারি না।

পিতার কথা শুনে রত্নাকর ব্যথিত হলেন। তিনি এবারে গেলেন স্ত্রীর কাছে। সেখানেও একই উত্তর পেলেন। এরপর মায়ের কাছে এবং পুত্রের কাছে জিজ্ঞেস করেও জানতে পারলেন, তাঁর পাপ তারা কেউই গ্রহণ করতে রাজি নয়। এবারে দস্যু রত্নাকরের অন্তরের দৃষ্টি খুলে গেল।

দস্যু রত্নাকর দেখলেন সংসারে তিনি একান্তই একা। যাদের মুখের খাদ্য সংস্থানের জন্য তিনি দিনের পর দিন পাপ কাজ করে চলেছেন, তারা কেউই তার পাপের দায় গ্রহণ করতে রাজি নয়। সংসারে তার সমব্যথী কেউ নেই।

রত্নাকর সেই মুহূর্তেই ঘর ছাড়লেন। ছুটে এলেন গাছতলায় ঋষিদের কাছে। তাদের বাঁধন খুলে দিয়ে তিনি ঋষি অত্রির পায়ে লুটিয়ে পড়ে কাতরভাবে তার পাপমুক্তির উপায় জানতে চাইলেন।

মহর্ষি তাকে আশ্বস্ত করলেন, বললেন একমাত্র পবিত্র রাম নামেই তোমার পাপ দূর হতে পারে। এরপর তিনি রত্নাকরকে একাগ্রচিত্তে রাম নাম জপ করতে উপদেশ দিলেন। ঋষিরা চলে গেলেন নিজেদের পথে। রত্নাকর বসলেন রাম নাম জপ করতে। পাপভয়ে কাতর তার হৃদয়। আজ ব্যাকুল হয়ে উঠেছে আত্মশুদ্ধির তাগিদে। এরপর দিনের পর দিন কেটে গেল। রত্নাকর সেই যে গাছতলায় আসন করে বসেছেন, ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে এক ভাবেই নিমগ্ন হয়ে আছেন। নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে উচ্চারণ করে চলেছেন পবিত্র রাম নাম।

একসময় রত্নাকরের চারপাশে আগাছা গজিয়ে উঠল। সমস্ত শরীর বল্মীক বা উইপোকার মাটিতে ঢেকে গেল। ঋষি অত্রির কাছ থেকে মন্ত্রদীক্ষা লাভের পর সাধনার দীর্ঘ সময়ে রত্নাকরের দেহ বল্মীকে আচ্ছাদিত হয়েছিল বলে তার নাম হয় বাল্মীকি।

রত্নাকর রাম নাম জপ করে আত্মজ্ঞান লাভ করে হলেন মহা ঋষি। বল্মীক আস্তরণের মতই নৃশংস দস্যুর সমস্ত পরিচয় ঝরে গিয়ে এক নতুন কলেবর নিয়ে নতুন পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ হলো রত্নাকরের।

ঋষি বাল্মীকি আশ্রম স্থাপন করলেন তমসা নদীর তীরে। অন্যান্য ঋষিদের মতই তিনিও হলেন আশ্রমবাসী। ঋষি ভরদ্বাজ ছিলেন তার শিষ্য। একদিন দেবর্ষি নারদ এলেন বাল্মীকির সঙ্গে ধর্মালাপ করতে। সেই সময় বাল্মীকি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে দেবর্ষি, ত্রিভুবনের কোনো খবর আপনার অগোচর নয়, আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে জানান সম্প্রতি পৃথিবীতে গুণবান, বীর্যবান, ধর্মজ্ঞ, সত্যবাদী আদর্শ পুরুষ কে আছেন।

তাপস শ্রেষ্ঠ নারদ বললেন, হে ঋষিবর, বহুগুণে গুণান্বিত যে শ্রেষ্ঠ পুরুষের কথা আপনি জানতে চাইছেন, তেমন চরিত্র আজকের দিনে দুর্লভ। তবে ইক্ষবাকু বংশের দশরথের পুত্র রাম বর্তমানে পৃথিবীতে রয়েছেন। আমি তার কাহিনী আপনাকে শোনাচ্ছি।

এরপর নারদ অযোধ্যার রাজা রামচন্দ্রের জীবন কাহিনী বর্ণনা করলেন। রাজা রামচন্দ্র ছিলেন ঋষি বাল্মীকিরই প্রায় সমসাময়িক। তার রাজধানী অযোধ্যার দক্ষিণে গঙ্গা। গঙ্গার উপকূল ধরে বিশাল অরণ্য। সেই অরণ্যের মধ্য দিয়ে কুলুকুলু রবে প্রবাহিত হয়েছে তমসা।

এই তমসার তীরেই ঋষির মনোরম আশ্রম। নারদ রামচরিত বর্ণনা করে দেবলোকে চলে গেলে বাল্মীকি তমসা নদীতে চললেন অবগাহন স্নান করতে। তাঁর মন জুড়ে রয়েছে রাম চরিত্রের মাধুর্য। শিষ্য ভরদ্বাজ গুরুর বল্কল নিয়ে চললেন সঙ্গে। নিবিড় বনপথ ধরে তারা যখন নদীর দিকে যাচ্ছেন সেই সময় একজোড়া ক্রৌঞ্চ বা কেঁচ বক গাছের শাখায় মনের সুখে বিহার করছিল।

এক ব্যাধ জঙ্গলের আড়াল থেকে দেখতে পেয়ে ক্রৌঞ্চটিকে তীরবিদ্ধ করল। মার্টিতে পড়ে পাখিটি মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। ক্রোঞ্চী সঙ্গীর অবস্থা দেখে করুণ স্বরে চিৎকার করতে লাগল।

এই দৃশ্য দেখে বাল্মীকির হৃদয়ে যুগপৎ ক্রোধ ও করুণার উদয় হলো। শোকার্ত ক্রৌঞ্চীর বেদনায় আবিষ্ট ঋষির মনপ্রাণ মথিত করে মুখ দিয়ে সেই মুহূর্তে তাঁর নিজেরই অজান্তে বেরিয়ে এলো ছন্দবদ্ধ ভাষা:

মা নিষাদ ! প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম।।

হে নিষাদ, এই জঘন্য কাজের জন্য তুই চিরকাল সমাজে নিন্দিত হয়ে থাকবি। বাল্মীকি নিজেই নিজের কথা শুনে বিস্মিত হয়ে গেলেন। এমন ছন্দবদ্ধ শোকগাথা কি করে তিনি আবৃত্তি করলেন। বিস্মিত ঋষি শিষ্য ভরদ্বাজকে তখন বললেন, হে ভরদ্বাজ আমার মুখ দিয়ে এই যে ছন্দবদ্ধ সুললিত বাণী নির্গত হলো, তা শোক থেকে উৎসারিত তাই এ শ্লোক নামে খ্যাত হবে।

ঋষি বাল্মীকির মুখনিঃসৃত এই ছন্দবদ্ধ সুললিত কথাই আদি শ্লোক। রামের বৃত্তান্ত এই শ্লোকবদ্ধ কথায় রচনা করেছিলেন বলে বাল্মীকিকে বলা হয় আদিকবি। শিষ্য ভরদ্বাজের সঙ্গে বাল্মীকি যখন কথা বলছেন সেই সময় সেখানে প্রজাপতি ব্রহ্মা উপস্থিত হলেন। তিনি বাল্মীকিকে বললেন, হে ঋষিবর, আজ আমার ইচ্ছায় তোমার মুখ দিয়ে এই শ্লোক নির্গত হলো। তুমি নারদের কাছে যে রাম জীবনী শুনেছ, তা শ্লোকবদ্ধ করে প্রচার কর।

এরপর বাল্মীকি ব্রহ্মার আদেশে রামকাহিনী লিখতে বসলেন। প্রায় চব্বিশ হাজার শ্লোকে অনুষ্টুপ ছন্দে লিখিত হলো সেই কাহিনী। কালে তাই রামায়ণ নামে খ্যাত হলো।

তথ্যসূত্র

১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৪-৯।

Leave a Comment

error: Content is protected !!