হবস বা টমাস হবস (ইংরেজি: Thomas Hobbes, ৫ এপ্রিল, ১৫৮৮- ৪ ডিসেম্বর, ১৬৭৯) আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা ও রাষ্ট্রদর্শনের বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিকের ভূমিকা গ্রহণ করেন। Professor Dunning বলেছেন, “ইংল্যান্ডবাসীদের মধ্যে হবসই সর্বপ্রথম এমন রাজনৈতিক দর্শন ব্যবস্থা উপস্থাপন করেন, যা ইতিহাসে অন্যতম মহান ব্যবস্থা বলে গণ্য হতে পারে”। তার বিভিন্ন রচনা এটাই প্রমাণ করে যে, তিনি প্রথম শ্রেণির রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লেভিয়েথান’ (Leviathan) ইতিহাসে অমর গ্রন্থ। ১৬৪২ থেকে ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত ইংল্যান্ডের রাজনীতিতে চরম সংকটকালীন পরিস্থিতি বিরাজ করেছে, যার অন্যতম দর্শক ছিলেন হবস। এ ধরনের পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করার পর তিনি সভ্য জীবনের প্রধানতম শর্ত হিসেবে একটি শক্তিশালী ও স্থায়ী সরকারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। আর এজন্য যা একান্ত প্রয়োজন তা হলো জনগনের শর্তহীন আনুগত্য।
টমাস হবসের জীবন বৃত্তান্ত
টমাস হবস ফরাসি দার্শনিক তথা বুদ্ধিজীবী ডেকার্টের সমসাময়িক। টমাস হবস ১৫৮৮ সালের ৫ এপ্রিল ইংল্যণ্ডের Malmesbury এর এক ধর্মযাজক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কথিত আছে, স্পেনীয় নৌবাহিনী যে সময় ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে, সে সময় হবসের গর্ভধারিণী মাতা ভয়ে ভীত হয়ে জন্মের নির্ধারিত সময়ের আগেই হবসকে প্রসব করেন। এ কারণে পণ্ডিতগণের মতে, সমকালীন পরিবেশ ও পরিস্থিতি তার উপর বেশ আছর করেছিল।
হবস খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৬০৮ সালে হবস মাত্র ২০ বছর বয়সে অক্সফোর্ড হতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। অতঃপর তিনি ইংল্যান্ডের অন্যতম অভিজাত ও প্রসিদ্ধ কেভেনডিস পরিবারের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন।
হবস ফরাসি ও ইতালীয় ভাষায় শিক্ষকতা করেন। তিনি প্রথমে কেভেনডিসের এবং আর্ল অব ডিভেনশায়ারের পুত্রের সাথে সমগ্র ইউরোপ পরিভ্রমণ করেন। ফ্রান্সে ভ্রমণকালে তিনি ডেকার্টের সাথে পরে ফ্লোরেন্সে গ্যালিলিওর সাথে পরিচিত হন এবং তাদের চিন্তাধারায় বিশেষভাবে প্রভাবিত হন।
হবস ১৬৩১ সালের দিকে পুনরায় ইউরোপ ভ্রমণে যান এবং ১৬৩৭ সালে দেশে ফিরে আসেন। এ সময় তার দেশে গৃহযুদ্ধ চলছিল। তিনি খুব বলিষ্ঠ ছিলেন। কথিত আছে যে, তিনি ৭০ বছর বয়সেও দিব্যি টেনিস খেলতেন। ১৬৬৯ সালের ৪ ডিসেম্বর তিনি ইংল্যান্ডে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
টমাস হবস প্রকাশিত রচনাবলি ও অনুসৃত পদ্ধতি
১. মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি ‘The Media of Europides’ গ্রন্থখানি গ্রিক হতে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন।
২. ১৬৫৫ সালে তিনি গতির যান্ত্রিক ও জড়বাদী ব্যাখ্যা সমন্বিত ‘Decorpore’ রচনা করেন।
৩. মানবপ্রকৃতির উপর ‘Homine’ গ্রন্থখানি ১৬৫৮ সালে রচনা করেন।
৪. মানব দেহ ও শরীর তত্ত্বের উপর ‘Deceive’ গ্রন্থটি উপরিউক্ত গ্রন্থখানি প্রণয়নের অব্যবহিত পরই প্রণয়ন করেন।
৫. রাজার চরম কর্তৃত্ব সমর্থন করে ১৬৪০ সালে ‘The Elements of Laws’ গ্রন্থখানি প্রণয়ন করেন। এ গ্রন্থে রাজার পক্ষাবলম্বন এবং পার্লামেন্টের বিরোধিতা করেন। এছাড়া এতে উপযোগবাদ সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে।
হবসের যুগশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘Leviathan’ ১৬৫১ সালে প্রণীত ও প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে হবস পদার্থবিদ্যা ও মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এছাড়া এতে নৈতিকতা ও রাজনৈতিক তত্ত্বও গুরুত্বসহকারে বিশ্লেষিত হয়েছে।
লেভিয়াথান সম্পর্কে Prof Oaskeshott মন্তব্য করেছেন এই বলে যে, “Hobbes’ Leviathan is the greatest perhaps the soul masterpiece of Political Philosophy in the English language.”
অনুসৃত পদ্ধতি:
ক. বৈজ্ঞানিক কতুবাদ: হবস সোফিয়া ভেনীর মতো ইতিহাস, জন বোডিনের মতো বাইবেলের সাহায্যে তার দর্শন আলোচনা করেন নি। তিনি বিজ্ঞানী না হয়েও বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদে আস্থাশীল ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, পৃথিবীতে প্রাকৃতিক ও সামাজিক যেসব ঘটনা ঘটুক না কেন তার মূলে কাজ করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ। তিনি বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ হিসেবে গণিত ও জ্যামিতির প্রতি প্রাধান্য দিয়েছেন।
হবস বস্তুবাদকে তিনটি স্তরে বিভক্ত করেছেন। প্রথম স্তরে পৃথিবী ও অন্যান্য গৃহ ইত্যাদি জড় পদার্থ। দ্বিতীয় পর্বে গণিত, জ্যামিতি ও যন্ত্রবিদ্যা এবং তৃতীয় পর্বে সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা। বলতে কি, হবস ‘লেভিয়াথান’ গ্রন্থখানিতে জ্যামিতিক পদ্ধতির প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
খ. আরোহ পদ্ধতি: তিনি আরোহ পদ্ধতি বিরোধী ছিলেন। তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতাকেই সকল জ্ঞানের প্রধান উৎস বলে বিশ্বাস করতেন। তিনি বলতেন, পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সবই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণু দ্বারা গঠিত। তিনি বিজ্ঞানের গতিতত্ত্বের কথা বলেছেন। পৃথিবীর পরমাণুগুলো গতিশীল, স্থির নয় এবং এগুলো গাণিতিক নিশ্চয়তা ও জ্যামিতিক নির্ভুলতা আবর্তিত।
এ তত্ত্ব কেবল জড় জগতেই নয়, মানব সমাজেও যথার্থভাবে প্রয়োগযোগ্য। মানুষের আবেগ ও অনুভূতির আকর্ষণ ও বিকর্ষণ এ প্রেক্ষিতেই ঘটে থাকে। মানুষ সর্বদা আনন্দ ও সুখ পেতে এবং দুঃখ ও কষ্টকে পরিহার করতে চায়। এটি তার ফলশ্রুতি ছাড়া কিছুই নয়।
অধ্যাপক সেবাইনের মতে, “হবসই হচ্ছেন বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের আদি গুরু। তিনি বিশ্বের সংঘটিত সকল ঘটনাকে কার্যকারণ তত্ত্বের সাহায্যে বিশ্লেষণে প্রয়াস পেয়েছেন।” তিনি মনে করতেন, “The world as an endless chain of cause and effect.” হবস প্রতিটি মানুষকে এক একটি অণু (Unit) হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
তথ্যসূত্র
১. ড. রবিউল ইসলাম, মীর মোশাররফ হোসেন ও অন্যান্য, রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি, গ্রন্থ কুটির ঢাকা, পুনর্মুদ্রণ সেপ্টেম্বর ২০১৯, পৃষ্ঠা ৩৮৬-৩৮৭।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।