টমাস হিল গ্রীন ছিলেন উনিশ শতকের ইংল্যাণ্ডের শিক্ষাবিদ এবং দার্শনিক

টমাস হিল গ্রীন বা টি. এইচ. গ্রীন (ইংরেজি: Thomas Hill Green; ৭ এপ্রিল ১৮৩৬ – ১৫ মার্চ ১৮৮২ খ্রি.) ছিলেন ঊনবিংশ শতকের ইংল্যান্ডের একজন প্রখ্যাত দার্শনিক, রাজনৈতিক আমূল বিপ্লবী ও মদ্যপানবর্জন সংস্কারক এবং ব্রিটিশ ভাববাদী আন্দোলনের সদস্য। টি. এইচ. গ্রীন ও তাঁর সমকালের এবং একই চিন্তার অধিকারী দার্শনিক ব্রাডলে এবং বোসাঙ্কোয়েটকে সাধারণত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নব্য ভাববাদী বলে আখ্যায়িত করা হয়।[১]

সমস্ত ব্রিটিশ ভাববাদীদের মতো গ্রিনও ফ্রিডরিখ হেগেলের অধিবিদ্যামূলক ইতিহাসবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি সামাজিক উদারনীতিবাদ দর্শনের পেছনের অন্যতম চিন্তাবিদ ছিলেন। গ্রীনের রচনাবলীর মধ্যে নীতিশাস্ত্রের উপর ‘প্রলেগোমেনা টু এথিক্স’ এবং রাজনীতির উপর ‘প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল অবলিগেশন’ বিশেষভাবে পরিচিত।

ব্যক্তিজীবনে টমাস হিল গ্রীন

১৮৩৬ সালে ইংল্যান্ডের এক সাধারণ যাজক পরিবারে টমাস হীল গ্রীন (৭ এপ্রিল ১৮৩৬ – ১৫ মার্চ ১৮৮২ খ্রি.) জন্ম নেন। অক্সফোর্ডেই কাটে তাঁর সারাটা জীবন। ১৮৫৫ সালে তিনি অক্সফোর্ডের ব্যালিয়ল কলেজের স্নাতক সদস্য হন এবং ১৮৬০ সালে তাঁর ফেলো নির্বাচিত হন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে মূলত দর্শনে শিক্ষকতার জীবন শুরু করেছিলেন – প্রথম কলেজের শিক্ষক হিসাবে, তারপরে ১৮৭৮ সাল থেকে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি হোয়াইটস প্রফেসর অফ মরাল ফিলোসফি পদে।

শিক্ষকতার বাইরে সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে গ্রীনের বিচরণ ছিল। অক্সফোর্ড টাউন কাউন্সিল, অক্সফোর্ড স্কুল বোর্ড এবং মাধ্যমিক শিক্ষা বিষয়ক কমিটিতে তিনি সদস্য ছিলেন। এ ভাবে নৈতিক দর্শনের শিক্ষকতার পাশাপাশি জনজীবনে বিচরণ গ্রীনের চেতনায় মানব প্রকৃতির যথার্থ উপলব্ধি সৃষ্টিতে সহায়ক হয়।[২]

টি. এইচ. গ্রীনের অবদান

ফরাসি বিপ্লবোত্তর কালে পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে যেসব আর্থিক ও রাষ্ট্রিক সমস্যার উদ্ভব হয় গ্রীন এবং তাঁর সঙ্গীরা তাকে তাঁদের নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার চেষ্টা করেন। এই বিচারের বৈশিষ্ট্য এই যে, এঁরা এ্যারিস্টটল এবং প্লেটোর মতো, রাষ্ট্রকে যেমন একটি নৈতিক সংস্থা বলে বিবেচনা করেন, তেমনি রাষ্ট্র বনাম ব্যক্তিরূপে গোড়ার দিকে যেখানে ব্যক্তির নিরঙ্কুশ সার্বভৌমিকতা এবং ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্রের কোনোরূপ হস্তক্ষেপ না করার উপর জোর ছিল, সেখানে ঊনবিংশ শতকের অবস্থাতে এই তাত্ত্বিকেরা রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি যে একটি যৌথ সংস্থা, তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।[৩]

গ্রীন এবং তাঁর সঙ্গীদের মতে ব্যক্তি বাদে যেমন রাষ্ট্র নয়, রাষ্ট্র বাদেও তেমনি ব্যক্তি নয়। উভয়ই নৈতিক সত্তা। এবং নৈতিক সত্তার আসল বিচার সে কি করে, তার চাইতে কি তার করা উচিত তথা তার লক্ষ্য দ্বারা নির্ধারিত হয়। ব্যক্তির লক্ষ্য নৈতিক প্রাণী হিসাবে অধিকতর উত্তম প্রাণী হিসাবে বিকাশ লাভ করা। এ বিকাশ ব্যক্তি এককভাবে সাধন করতে পারে না। নৈতিকতার বোধটিই হচ্ছে একটি সামাজিক বোধ। সমাজ-শূন্য কোনো ব্যক্তি কাল্পনিক ব্যক্তি, বাস্তব অস্তিত্ব নয়।

ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কে গঠিত যে রাষ্ট্র, সে রাষ্ট্রের উন্নতি, ব্যক্তির উন্নতি বাদে সাধিত হতে পারে না, যেমন, ব্যক্তির উন্নতি রাষ্ট্রের উন্নতি বাদে সাধিত হতে পারে না। তাই রাষ্ট্রের উন্নতির মাধ্যমে ব্যক্তির উন্নতি অর্জন করা। এই অবস্থাটিকে প্রকাশ করে গ্রীন বলেছেন, রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তির সম্মতি বা ‘উইল’, শক্তি তথা ফোর্স নয়। রাষ্ট্রের লক্ষ্য হবে ব্যক্তির জীবনে এমন বাস্তব অবস্থা তৈরি করা যে বাস্তব অবস্থায় ব্যক্তি নৈতিক প্রাণী হিসাবে যা তার করা উচিত সে তাই করতে পারে। এই প্রসঙ্গে গ্রীন ‘পজিটিভ’ এবং ‘নেগেটিভ’ ফ্রিডম – তথা বাস্তব স্বাধীনতা এবং অবাস্তব স্বাধীনতার ধারণাটি তৈরি করেন।

গ্রিন বিদ্যমান পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার সমালোচনা করে দেখান যে অন্নহীন ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে কোনো নৈতিক বা স্বাধীন ব্যক্তি বলা যায় না। ক্ষুধার্ত ব্যক্তি অপরের খাদ্য দ্রব্য ‘চুরি’ করলে তাকে অপরাধী বলে বিচার করা চলে না। কারণ, বুভুক্ষু ব্যক্তির যেখানে চুরি করে খাদ্য সংগ্রহ করা ব্যতীত উপায় নেই, সেখানে তার এমন বাধ্যতামূলক কার্যকে স্বাধীন ইচ্ছানুযায়ী কৃত কার্য বলা চলে না।

আসলে আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজের তথাকথিত স্বাধীনতা হচ্ছে প্রধানত এরূপ অসহায় ব্যক্তির জন্য অবাস্তব বা নেগেটিভ স্বাধীনতা। এরূপ অসহায় ব্যক্তি প্রাচীনকালে শেকলে আবদ্ধ থাকত, বর্তমানে সমাজের এমন দাসরা ক্ষুধার শিকলে আবদ্ধ। এরা পুরো নাগরিক বা ‘সিটিজেন’ নয় এদেরকে বলা উচিত “ডেনিজেন” বা অ-নাগরিক। ধনতান্ত্রিক সমাজের অসঙ্গতির এরূপ তাত্ত্বিক জোরালো সমালোচনার মধ্যে ঊনিশ শতকে ক্রমবর্ধমানরূপে প্রচারিত সমাজতান্ত্রিক ভাবের প্রকাশ পাওয়া যায়।

গ্রীনের মতে, পুঁজিবাদী সমাজের অসংগতির কারণে, রাষ্ট্রকে নিষ্ক্রিয় থাকলে চলবে না। কোনো ব্যক্তি যেন তার অবাধ প্রতিযোগিতার অধিকার ব্যবহার করে ব্যক্তিগত সম্পত্তির একচেটিয়া মালিকানার মাধ্যমে সামাজিক সম্পদের অপব্যবহার দ্বারা অসংখ্য ব্যক্তিকে মানবেতর প্রাণীতে পর্যবসিত করতে না পারে, রাষ্ট্রকে তা দেখতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। এরূপ বিচারে গ্রীন সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন হলেও তিনি পুরোপুরি সমাজতান্ত্রিক ছিলেন না।

টমাস হিল গ্রীন একদিকে যেমন ব্যক্তিবাদী তথা ব্যক্তির উন্নতিকে রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য বলেছেন, অপরদিকে তেমনি ব্যক্তিগত সম্পত্তির সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন, কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তির পুরো বিলোপের সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বকে সমর্থন করেন নি। এ কারণে তাঁর এবং তাঁর সঙ্গী চিন্তাবিদদের চিন্তাকে ‘ব্যক্তিবাদ তথা উদারনীতিবাদের ভাববাদী সংশোধন’ বা ‘আইডিয়ালিস্ট রিভিশন অব লিবারেলিজম’ বলে অভিহিত করা হয়।

তথ্যসূত্র:

১. অনুপ সাদি, “টমাস হিল গ্রীন ছিলেন উনিশ শতকের ইংল্যাণ্ডের শিক্ষাবিদ এবং দার্শনিক” ২৪ মে ২০১৯, রোদ্দুরে, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/thomas-hill-green/
২. হাসানুজ্জামান চৌধুরী, মো আব্দুর রশীদ, এ এমদাদুল হক ও অন্যান্য; রাষ্ট্রবিজ্ঞান দ্বিতীয় খণ্ড, রাষ্ট্রচিন্তা, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ত্রয়োদশ প্রকাশ, ২০২০, পৃষ্ঠা ১৪৫-১৪৮।
৩. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; পঞ্চম সংস্করণ জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৮৭-১৮৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!