সুশ্রুত বা সুস্রুত (সংস্কৃত: सुश्रुत) ছিলেন প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসক, যিনি সুশ্রুত সংহিতা গ্রন্থটির মূল লেখক হিসাবে পরিচিত। প্রাচীন ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতে তাকে বিশ্বমিত্রের পুত্র হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা সুশ্রুত সংহিতার বর্তমান সংস্করণের সাথে মিলে যায়। কুঞ্জলাল ভিষগরত্ন মত প্রকাশ করেন এটা বিশ্বাস করা নিরাপদ যে, বিশ্বমিত্র যে গোত্রের ছিলেন, সুশ্রুতও ছিলেন একই গোত্রের।[১]
আয়ুর্বেদ শাস্ত্র, বিশেষ করে শল্যবিদ্যায় ধন্বন্তরি সেই চিকিৎসক হলেন আচার্য সুশ্রুত। ‘প্লাস্টিক সার্জারি’র জনক বলে সারা বিশ্বে আজও যিনি স্বীকৃত, সম্মানিত। এছাড়াও আয়ুর্বেদ যুগের চিকিৎসা শাস্ত্রের সাথে ওতপ্রোতঃ ভাবে জড়িত হয়ে আছে তাঁর রসায়ন সংক্রান্ত কাজ। চরক এবং সুশ্রুতের মাধ্যমে রসায়নের উন্নতি ঘটতে লাগল, শাস্ত্রের অনুষঙ্গ হিসাবে।[২]
আজ থেকে প্রায় ২৬০০ বছর আগেকার কথা। বর্তমান ভারতের এখনকার বারাণসীর কাছাকাছি কোনও একটি জনপদ। একদিন মধ্যরাত্রে এক চিকিৎসকের দরজায় আকস্মিক করাঘাত। সুখ্যাত সেই চিকিৎসক দরজা খুলতেই এক ব্যক্তি একেবারে তার পায়ের উপর এসে পড়ল। অনেকখানি কাটা তার নাক দিয়ে ঝর ঝর করে রক্ত পড়ছে। নিজেকে পর্যটক বলে পরিচয় দিয়ে চিকিৎসার জন্যে কাতর আবেদন জানাল সে। ‘বৎস, উঠে দাঁড়াও, ভয় পেও না’, তাকে অভয় দিলেন আয়ুর্বেদাচার্য, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন শান্ত হয়ে বসো।
সে সময়ে কোনও গুরুতর অপরাধের শাস্তি হিসেবে নাক বা কান কেটে নেওয়া হত। সম্ভবত তেমন কোনও অপরাধের শাস্তিস্বরূপ সুশ্রুতের শরণ-নেওয়া সেই আগন্তুকের নাক কাটা গিয়েছিল। আচার্য সুশ্রুত তাকে একটি মাদুরের ওপরে বসালেন, জল এবং ভেষজ নির্যাস দিয়ে তার মুখ পরিষ্কার করে দিয়ে তাকে এক পাত্র মদ্য পান করালেন। রোগীটি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝিমিয়ে পড়ল। চিকিৎসক এ বার একটি লতা থেকে বড় মাপের একটি পাতা ছিড়ে নিয়ে তার কর্তিত নাকের ওপর বসিয়ে সেই মাপ অনুযায়ী পাতাটি চারপাশ থেকে কেটে নিলেন। এরপর রোগীর গাল থেকে ওই কর্তিত পাতার সমান করে কিছুটা মাংস আগুনে পুড়িয়ে নেওয়া ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে নিয়ে সেটি তার বিকৃত নাকের ওপর বসিয়ে নাকের মতো করেই মুড়ে দিলেন। এবং নিখুঁত সেলাই করে জুড়ে দিলেন সেই নতুন নাক।
তার আগে অবশ্য দুটি সরু নল নাকের অস্থায়ী ছিদ্র হিসেবে স্থাপন করেছিলেন সুশ্রুত। পরবর্তী ধাপে জুড়ে দেওয়া নাকের ওপর প্রয়োজনীয় ভেষজ ওষুধের প্রলেপ দিয়ে তুলো ও কাপড়ের সাহায্যে ভাল করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। গালের যে অংশ থেকে মাংস কেটে নেওয়া হয়েছিল, সেখানেও ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করা হয়েছিল তার আগেই। এরপর রোগীটিকে কিছু ওষুধপত্র দিয়ে, সেগুলি নিয়মিত খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ছেড়ে দিলেন তাকে। এবং কয়েক সপ্তাহ পরে ফের দেখা করতে বললেন।
এই ছিল প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ শল্যবিদের চিকিৎসা পদ্ধতি। এভাবেই নাক, কান কাটা যাওয়া রোগীদের নতুন অঙ্গ বানিয়ে দিতেন তিনি। আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্মেছিলেন সুশ্রুত। শোনা যায় বিশ্বামিত্র মুনির বংশধর ছিলেন তিনি। বারাণসীতে দেবদাস ধন্বন্তরির কাছে চিকিৎসাবিদ্যা শিখেছিলেন সুশ্রুত। পরে শল্যবিদ্যার পাশাপাশি চিকিৎসার অন্যান্য বিভাগেও পারদর্শিতা লাভ করেন। সুশ্রুতের আগে, বস্তুত খ্রিস্টজন্মের প্রায় চার হাজার বছর আগেও ভারতবর্ষে প্লাস্টিক সার্জারির প্রচলন ছিল। কিন্তু সুশ্রুতই প্রথম এর প্রথাগত পদ্ধতির উদ্ভাবক এবং ব্যাখ্যাকার। সংস্কৃত ভাষায় লেখা তার ‘সুশ্রুতসংহিতা’ শল্যবিদ্যা তথা প্রাচীন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার এক আকর গ্রন্থ। এই গ্রন্থে শল্য চিকিৎসার ১২০ রকমের যন্ত্রপাতির উল্লেখ রয়েছে। যন্ত্রগুলি ব্যবহারের আগে প্রতি বার পুড়িয়ে নেওয়া হত, সম্ভাব্য সংক্রমণ এড়াতে।
সুশ্রুতই সম্ভবত বিশ্বের প্রথম চিকিৎসক, যিনি পেট কেটে সন্তান প্রসব করানোর, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে যার নাম ‘সিজারিয়ান সেকশন’, পরামর্শ দিয়েছিলেন। মূত্রস্থলীতে জমা পাথর বের করা, দেহের ভগ্ন হাড়গোড় জুড়ে দেওয়া, এমনকী চোখের ছানি অপারেশন করতেন সুশ্রুত। আরও লক্ষণীয়, রোগীকে মদ্যপান করিয়ে তাকে আংশিক অবশ করে অস্ত্রোপচার করতেন তিনি। যাকে আধুনিক ‘অ্যানাস্থেসিয়া’ অর্থাৎ চেতনানাশকের আদি পূর্বসূরি বলা যায়। চিকিৎসাবিদ্যার শিক্ষক হিসেবেও অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন সুশ্রুত। প্রথমে লাউ, কুমড়ো, তরমুজ, শসা ইত্যাদি কেটে শিষ্যদের অস্ত্রোপচারের প্রাথমিক পাঠ দিতেন। শারীরসংস্থান বুঝতে মৃতদেহ জলে ডুবিয়ে রেখে পর্বে পর্বে তার পচন ও ক্ষয় পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দিতেন। ছাত্রদের বলতেন, ভাল চিকিৎসক হতে গেলে শল্যবিদ্যা এবং ওষুধপত্র সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞান আবশ্যক। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক বলে স্বীকৃত গ্রিক দার্শনিক হিপোক্রেটিসের লেখা শপথ আজও নিতে হয় ডাক্তারির ছাত্রদের। সুশ্রুত তার প্রায় ১৫০ বছর আগেই তার শিষ্যদের জন্যে এমন শপথ চালু করেন।
ভাল চিকিৎসক হতে গেলে কীভাবে রোগীকে প্রাথমিক পরীক্ষা করতে হবে এবং রোগ নির্ণয় করে তার উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে, সবই বর্ণিত রয়েছে সুশ্রুত সংহিতায়। যক্ষ্মা, ফুসফুসের অসুখ, জ্বর, চর্মরোগ ইত্যাদি সহস্রাধিক রোগের উল্লেখ আছে এই মহাগ্রন্থে। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে সুশ্রুত সংহিতা আরবি ও ফারসিতে অনূদিত হয়। এবং আরবদের মাধ্যমে এক সময়ে এই বিদ্যা পাশ্চাত্যে প্রবেশ করে। উনিশ শতকে ল্যাটিন ও জার্মান ভাষায় এই গ্রন্থের অনুবাদ বেরয়। মাত্রই ১৯০৭ সালে কলকাতায় প্রথম ইংরেজিতে তা অনুবাদ করেছেন কবিরাজ কুঞ্জলাল ভিষগরত্ন।[৩]
প্রাচীন ভারতের রসায়ন
দুটি আলাদা আলাদা সূত্র থেকে রসায়নের উদ্ভব। যথা—(১) মৃৎশিল্প, কাঁচ শিল্প, ধাতু শিল্প সংক্রান্ত কারিগরি বিদ্যা এবং (২) চিকিৎসাবিদ্যা। ভারতবর্ষে এই দুটি বিদ্যাই অত্যন্ত প্রাচীন। তাই বলা যায় ভারতের রসায়ন বিদ্যাও প্রাচীন। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার মৃৎশিল্পীরাই হলেন প্রাচীন ভারতের প্রথম রাসায়নিক। এরপরই আসে আয়ুর্বেদ যুগ। ফলে চিকিৎসা শাস্ত্রের সাথে ওতপ্রোতঃ ভাবে জড়িত হলো রসায়ন। রসায়নের উন্নতি ঘটতে লাগল, শাস্ত্রের অনুষঙ্গ হিসাবে। চিকিৎসাবিদ্যাকে অবলম্বন করেই ভারতীয়দের রসায়ন জ্ঞান ধীরে ধীরে উন্নত হতে থাকে।
সুশ্রুত ও চরকের রসায়ন
চরক ও সুশ্রুত উভয়েই সোনা, রূপা, তামা, সিসা, টিন, লোহা এই ছটি ধাতুর সাহায্যে কয়েকপ্রকার ক্ষার, লবণ ও পানীয় ও কয়েকটি রাসায়নিক তৈরি করতেন। অর্থাৎ মৌলিক ও যৌগিক পদার্থ সম্পর্কে তাদের স্পষ্ট জ্ঞান ছিল। তাঁরা জানতেন যে, এই মৌলিক পদার্থের উৎস ছিল পঞ্চভূত অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম।
লবণ: চরক পাঁচ প্রকার লবণের উল্লেখ করেছেন। যথা— সৌর্বল বা শোরা, সৈন্ধব বা খনিজ লবণ, বিট বা কৃষ্ণ লবণ, সামুদ্র বা সামুদ্রিক লবণ এবং উদ্ভিদ বা উদ্ভিজ্জ লবণ। তুতে, মোমছাল, হরিতাল, গন্ধক প্রভৃতিতেও খনিজ লবণ আছে। চামড়ার রোগের জন্য ভেষজের সাথে এসব খনিজ লবণ মিশিয়ে ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন চরক।
ক্ষার ও ক্ষার ও তার তৈরির পদ্ধতি চরক ও সুশ্রুত সংহিতায় বিশদে উল্লেখ আছে। যথা— “পলাশের নতুন অংশটিকে প্রথমে টুকরা করে কেটে পুড়িয়ে ছাই করতে হবে। ঐ ছাইটিকে চার ছয় গুণ জলে ভালো করে গুলে কাপড়ের ছাঁকনিতে একুশবার হেঁকে নিলে ক্ষার প্রস্তুত হবে। সাধারণত এভাবে পটাশ কার্বনেট তৈরি হয়। তবে, এ বিষয়ে সুশ্রুতের বর্ণনা অনেক বিশদ। ক্ষারের গুণ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, কাটা ছেড়ার সমস্ত রকম ওষুধের বা অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ। ক্ষারকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা—মৃদু ক্ষার, মধ্যম ক্ষার ও তীক্ষ ক্ষার। সুশ্রুত আবার সবক্ষার (পটাশ কার্বনেট) ও সার্জিকাক্ষার (সোডিয়াম কার্বনেট) এই দু’প্রকার ক্ষারের উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে সোহাগাও ক্ষারের অন্তর্ভুক্ত।[৪]
আলোকচিত্রের ইতিহাস: লেখায় ব্যবহৃত ছবিটি বিশ্বরূপ গাঙ্গুলী ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধীন বিজ্ঞান এক্সপ্লোরেশন হল কলকাতা থেকে তুলেছেন। ছবিতে সুশ্রুত চিকিৎসা করছেন তা দেখা যাচ্ছে।
তথ্যসূত্র
১. Bhishagratna, Kunjalal (1907). An English Translation of the Sushruta Samhita, based on Original Sanskrit Text. Calcutta: Calcutta. pp. ii(introduction).
২. অনুপ সাদি, ১৮ জুলাই ২০২০, “আচার্য সুশ্রুত ছিলেন প্রাচীন ভারতীয় শল্য চিকিৎসার অগ্রদূত”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/sushruta/
৩. বিমল বসু, বিজ্ঞানে অগ্রপথিক, অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ মে ২০১৬, পৃষ্ঠা ২৩-২৫।
৪. প্রীতা ভট্টাচার্য, “পঞ্চম থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও রসায়নের উন্মেষ”, নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, এপ্রিল ২০০৭, পৃষ্ঠা ১৬-১৭।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।