শোভারানী দত্ত ছিলেন বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা

শোভারানী দত্ত ও তার মা দু’জনই ছিলেন বিপ্লবী দলের কর্মী। ছোটবেলায় বিভিন্ন স্থানে লেখাপড়া করার পরে তিনি কলকাতা, চট্টগ্রামে রাজনীতি করেছেন। বিপ্লবীদের তিনি আশ্রয় দিতেন। এজন্য জেলে যেতে হয়েছিল। মুক্তি পাবার পরেও রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।

জন্ম ও পরিবার

১৯০৬ সালের জানুয়ারি মাসে শোভারানী দত্ত জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলিকাতা শহরে। জন্ম তার খুলনায়। তার পিতা যতীন্দ্রনাথ দত্ত। ছোটবেলায়ই পিতার মৃত্যু হয়। মাত্য স্বনামধন্য ও একনিষ্ঠ দেশসেবিকা লাবণ্যপ্রভা দত্ত। লাবণ্যপ্রভা দত্ত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভানেত্রী ছিলেন ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। মায়ের কাছেই শোভারানীর দেশপ্রেমের প্রথম শিক্ষা পান। ছোট বয়স থেকেই তিনি যেমন তেজস্বী, তেমনি বুদ্ধিমতী ছিলেন। আর একটি দুলর্ভ বস্তু নিয়েই তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তা হচ্ছে হৃদয়ের প্রাচুর্য।

শিক্ষাজীবন

১৬-১৭ বছর বয়সে ব্রামা গার্লস স্কুল থেকে ট্রেনিং পাস করেন। তারপর বৃন্দাবন চলে যান বিপ্লবী বীর রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ-প্রতিষ্ঠিত ‘প্রেম মহাবিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে। ওখান থেকে পাঞ্জাবের নানা স্থানে তিনি ভ্রমণ করতে থাকেন। এই সময় পাঞ্জাব-কেশরী লালা লাজপৎ রায়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়াতে তিনি মুগ্ধ ও প্রভাবান্বিত হন এবং বিপ্লবের দিকে তার অন্তরের প্রেরণা জাগে।

শোভারানী দত্ত-এর স্বভাব

শোভারানীর মতো অমন একটা দরদী ও পরদুঃখকাতর প্রাণ সররাচর চোখে পড়ে না। তাঁর চরিত্রে আর একটি দিক তাঁর তেজস্বিতা। নিজের তেজস্বিতায় যেন তিনি অন্যের হৃদয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারতেন। তাঁর এমন একটা ব্যক্তিত্ব ছিল যেটা চোখে না-পড়েই পারত না৷ তাঁর কথায়-বার্তায় চাল-চলনে, গ্রীবাভঙ্গিমায় প্রকাশ পেত যেন সিংহিনীর বিক্রম। সব সময় রয়েছে মুখে একটি মধুর হাসি। সেই হাসির মধ্য দিয়ে সহজেই মানুষকে আপন ক’রে নেবার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার। তাঁর অতিথি পরিচর্যার স্নেহকোমল স্পর্শ পান নি এমন লোক বোধ হয় শোভারানীর পরিচিত কেউ ছিলেন না। অকাতরে কত অর্থসাহায্য যে তিনি বিপ্লবীদের করেছেন তার হিসাব কেউ জানে না। সেজেগুজে ছদ্মবেশে গড়ের মাঠে গিয়েও তিনি বহু অর্থ দিয়ে এসেছেন পলাতক বিপ্লবীকে। তাঁর কাছে অর্থ এবং খাদ্য চেয়ে কেউ কোনোদিন ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান নি। নিজের কাছে না থাকলে, নিজে ঋণ করবেন, তবু না দিয়ে থাকতে পারবেন না— এই ছিলেন শোভারানী দত্ত।

ইউটিউবে দেখুন আমার লেনিন তথ্যচিত্র

রাজনীতির প্রতি প্রভাবিত হওয়া

১৯৩০ সালে বিপ্লবী নেতা হরিকুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে কলিকাতায় শোভারানীর পরিচয় হয় এবং তিনি দেশসেবার কাজে গভীরতভাবে উদ্বুদ্ধ হন। এই সালেই তিনি এবং তার মা দেশসেবা ও জনসেবার আদর্শে প্রণোদিত হয়ে ‘আনন্দমঠ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনের সময় ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’ গঠিত হয়। এই সমিতির সম্পাদিকাদের আহ্বানে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে শোভারানী দত্ত আন্দোলন পরিচালনা করে যান। নিজে চলে যেতেন তিনি পিকেটিং করতে ও শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে। তাছাড়া ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’তে যোগ দিয়ে সত্যাগ্রহ করবার জন্য তিনি ও তার মা বহু কর্মী সংগ্রহ করে দিতেন। পরে তাঁর মা লাবণ্যপ্রভা দত্তের সঙ্গে তিনি দক্ষিণ কলিকাতা কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকেন দক্ষতার সঙ্গে।

বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়া

১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন হয়ে যাবার পর অনেক বিপ্লবী পলাতক হয়ে। কলিকাতায় চলে আসেন। ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত তাদের প্রথম আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু অনেককে বেশিদিন একসঙ্গে রাখা নিরাপদ নয় বলে মাঝে মাঝে কাউকে অন্যত্র রাখা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন জীবন ঘোষাল ও আনন্দ গুপ্ত। শোভারাণী এই দুইজনকে কয়েকদিনের জন্য আশ্রয় দিলেন তাঁরই নির্বাচিত বাড়িতে টালিগঞ্জের পুঁটিয়ারিতে। সেটা ছিল তাঁর পরিচিত কর্মী লক্ষ্মীমণি দেবী ও সারদামণি দেবীর বাড়ি। শোভারানীর নির্দেশ তাঁরা নতমস্তকে সানন্দে মেনে চলতেন। পরে জীবন ঘোষাল ও আনন্দ গুপ্তকে সেখান থেকে চন্দননগরে যেখানে চট্টগ্রামের অন্যান্য বিপ্লবীরা ছিলেন সেখানে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৩০ সালের ২৫ আগস্ট ডালহাউসি স্কোয়ারে পুলিস-কমিশনার টেগার্টকে দীনেশ মজুমদার ও অনুজা সেন বোমা দিয়ে আক্রমণ করেন। ডালহাউসি স্কোয়ার বোমার মামলার একজন পলাতক আসামী ছিলেন মনোরঞ্জন রায়। ২৬ আগস্ট শোভারাণী দত্ত তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান এবং তাঁরই গাড়িতে করে তাঁকে পাঠিয়ে দেন পুঁটিয়ারির সেই আশ্রয়ে। শোভারানী দত্তের বাড়িতে তখন উপস্থিত ছিলেন লক্ষ্মীমণি দেবী ও তাঁর শাশুড়ী সারদামণি দেবী।

২৮ আগস্ট মনোরঞ্জন রায় পুটিয়ারির সেই বাড়িতেই গ্রেপ্তার হয়ে যান। ২৯ আগস্ট শোভারানী দত্ত ও লক্ষ্মীমণি দেবী বেহালা থানায় যান যেখানে পুলিস মনোরঞ্জন রায়কে গ্রেপ্তার করে নিয়ে রেখেছিল। সেখান থেকে ফিরবার পথে রাস্তায় ২৯ আগস্টই শোভারানী দত্তকে পুলিস গ্রেপ্তার করে। ডালহাউসি স্কোয়ার বোমার মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত এই সন্দেহে। একই সাথে তাঁর গাড়িও পুলিস আটকে রাখে। কিছুদিন পরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।

শোভারানী দত্ত -এর জেল জীবন

১৯৩০ সালে ৮ মে দার্জিলিং-এ লেবং-এর মাঠে গভর্নর অ্যান্ডারসনের উপর বিপ্লবী আক্রমণ হবার পর উজ্জ্বলা মজুমদার চলে আসেন কলিকাতায় পলাতক অবস্থায়। আশ্রয় নেন তিনি শোভারানী দত্তের বাড়িতে। প্রায় তিন-দিন সেখানে থাকার পর ১৮ মে উজ্জ্বলা ও শোভারানী দুজনে সেই বাড়ি থেকেই গ্রেপ্তার হন। লেবং কেস থেকে মুক্তি পেলেও শোভারানীকে ডেটিনিউ হিসাবে জেলে বন্দী করে রেখে দেওয়া হয়। হাজতে থাকা অবস্থায় খবর পাওয়া যায় শোভারানী পাগল হয়ে গেছেন। গভর্নমেন্ট পাঠিয়ে দেয় তাঁকে রাঁচীর পাগলা গারদে। প্রায় বছরখানেক সেখানে থাকার পর তিনি সুস্থ হন। তখন তাঁকে নিয়ে আসা হয় আবার প্রেসিডেন্সি জেলে। অবশেষে বছর দেড়েক আলমোড়ায় অন্তরীণ করে রাখার পর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় ১৯৩৭ সালে।

তাঁর রুগ্নশয্যায় যেসকল স্বনামধন্য মানুষ এসে তাঁকে স্নেহ আশীর্বাদ বর্ষণ ক’রে গেছেন তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন বিপ্লবী বীর রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ। দীর্ঘদিন রোগযন্ত্রণা ভোগের পর শোভারানীর ক্লান্তদেহের মর্ত্যযাতনার অবসান হয় ১৯৫০ সালের ৯ নভেম্বর।

আরো পড়ুন

তথ্যসূত্র:

১. কমলা দাশগুপ্ত (জানুয়ারি ২০১৫)। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী, অগ্নিযুগ গ্রন্থমালা ৯। কলকাতা: র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন। পৃষ্ঠা ১৫৮-১৬০। আইএসবিএন 978-81-85459-82-0

Leave a Comment

error: Content is protected !!