উইলিয়াম সমারসেট মম (ইংরেজি: William Somerset Maugham; ২৫ জানুয়ারী ১৮৭৪ – ১৬ ডিসেম্বর ১৯৬৫) ছিলেন একজন ইংরেজ নাট্যকার, ঔপন্যাসিক এবং ছোট গল্প লেখক। তিনি তার যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এবং ১৯৩০-এর দশকে সর্বাধিক-আয়কারী লেখক ছিলেন।
সমারসেট মম জাতিতে ইংরেজ কিন্তু সাহিত্যিক প্রকৃতিতে ফরাসি বললে—খুব ভুল বোধ হয় করা হয় না। তার সমসাময়িক সাহিত্যিকদের সঙ্গে এক গোত্রে অন্তত তাঁকে একেবারেই ফেলা যায় না। আর্নল্ড বেনেট, ওয়েলস ও গলসওয়ার্দির সঙ্গে একই যুগের হাওয়ায় তিনি নিশ্বাস নিয়েছেন, তবু ইংরেজের শাঁসালো ভারের চেয়ে ফরাসীর উজ্জ্বল ধারই তার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বেশি।
সমারসেট মমের রচনায় আছে সূক্ষ্ম বিদ্রুপের ধার; ঘোরালো অথচ তীব্র শ্লেষের ধার—কখনো সোনার খাদটুকু ধরিয়ে দিয়ে, কখনো খাদের সোনাটাকে বুঝিয়ে দিয়ে—ঈষৎ বাঁকা হাসির। তবু সে-হাসি শুধু বাঁকা নয়, পরম প্রিয়জনকে নিষ্ঠুর অপ্রিয় সত্য শোনাতে বাধ্য হওয়ায় কেমন একটু কুণ্ঠিত ও করুণ।
মমের লেখা পড়তে পড়তে পূর্বসূরীদের কাউকে যদি মনে পড়ে, তাহলে তারা হলেন গি দ্য মোপাসাঁ, দোদে, ফ্লবেয়র। তাঁর রচনার বুনন তেমনি সুক্ষ্ম, সরল, বাহুল্যবর্জিত, কিন্তু সম্পূর্ণ নকসা যেখানে শেষ হয় সেখানকার অপ্রত্যাশিত বিস্ময় একেবারে মর্মে গিয়ে লাগে। এই কঠিন বাক-সংযম, আঙ্গিকের এই বিশুদ্ধ সারল্য ইংরেজি সাহিত্যের ঠিক ধাতস্থ নয়, তাই সমারসেট মমকে তার প্রাপ্য মর্যাদা পাবার জন্য বহুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। পল্লবগ্রাহিতার অপবাদে কোনো কোনো সমালোচক তাঁকে জাতে ঠেলে রাখতে দ্বিধা করেননি। গল্পকারের বিজয়-মালা নিতে তাকে প্রথমে রঙ্গমঞ্চের পাদপ্রদীপের আলোয় নাট্যকার রূপে নিজেকে পরিচিত করতে হয়েছে।
‘ধার’টুকুর দিক দিয়ে মোপাসাঁর সঙ্গে মিল থাকলেও মমকে সেই সুবিখ্যাত ফরাসী ‘সিনিক’এর সাহিত্যিক-বংশধর ভাবলে অত্যন্ত ভুল করা হবে। সুধার পাত্র ভ্রমে গরল মুখে তুলে যাদের সমস্ত মন বিষাক্ত হয়ে যায় ও পৃথিবীর সবকিছুকে যারা তিক্ত অবিশ্বাসের চোখে দেখেন, মম তাদের দলের নন। জীবনের বিষামৃত দুই-ই স্বীকার করবার মতো মনের উদার সরসতা তার আছে।
অস্ত্র চিকিৎসকের ছুরিকার মতো, তার কলমের ডগায় শ্লেষের নির্মমতাই প্রথমে চোখে পড়ে, তার করুণা ও বেদনা থাকে নেপথ্যে। জীবনের কোনো অসুস্থতা, অস্বাভাবিকতা, গ্লানি, ক্লেদ, আত্মপ্রবঞ্চনাকে তিনি দুর্বল ভাবালুতায় ক্ষমা করেননি, মিথ্যাকে কখনো রঙিন করে তোলেননি অলীক স্বপ্নের জাল বুনে।
প্রথম জীবনের ডাক্তারি পড়াশোনা তার একদিক দিয়ে সম্পূর্ণ সার্থক। শুধু দেহের ব্যাধির চিকিৎসায় সন্তুষ্ট থাকবার মতো প্রতিভা অবশ্য তার নয়, কিন্তু বিচক্ষণ চিকিৎসকের তীক্ষ্ণ স্বচ্ছ দৃষ্টি দিয়েই তিনি জীবনের বিচিত্র লীলা পর্যবেক্ষণ করেছেন। সমস্ত বাহ্যিক ভাব ও আবরণ ভেদ কবে ব্যাধি ও বিকৃতির মূলে গিয়ে তার দৃষ্টি পৌঁছেছে। তার শাণিত শ্লেষ নির্ভুলভাবে সমস্ত ছলনার আবরণ ছিন্ন করে দিয়েছে।
কি রাষ্ট্রে সমাজে, কি ব্যক্তিগত জীবনে, মানুষের আত্মপ্রতারণার আর অন্ত নেই। লেখায় সেই আত্মবঞ্চনার খোরাক জুগিয়ে আমাদের দুর্বলতার খোশামুদি যারা করেন, সাহিত্যের বাজারে নগদ খ্যাতির মূল্য তাদের অত্যন্ত সহজেই মেলে। কিন্তু এই সহজ সিদ্ধির পথ মমের নয়। সিনিকের অপবাদ অগ্রাহ্য করে তিনি অবিচলিত ভাবে জীবনের জটিলতার যথার্থ পরিচয় দেবার চেষ্টা করে গেছেন সর্বত্র। আমাদের সমস্ত আত্মবঞ্চনা তার অভ্রান্ত কলমের কাছে যেমন ধরা পড়েছে, আকাশ কুসুমকে সত্য করে তোলার চেষ্টায় আমাদের ব্যর্থতার করুণ মহিমাও তেমনি তার দৃষ্টি এড়ায়নি।
মমের জীবনে অভিজ্ঞতার গভীরতা আপাত দৃষ্টিতে যাদের চোখে ধরা পড়ে না, তারাও তার ব্যাপকতায় বিস্মিত না হয়ে পারে না। সমাজ জীবনের বিভিন্ন স্তর থেকে পৃথিবীর দূরদূরান্তরের সমস্ত দেশের জীবনযাত্রা যেন তার নখদর্পণে। মেক্সিকোর গুয়াতেমালা থেকে পলিনেশিয়ার যে কোনো দ্বীপে তার স্বচ্ছল অবাধ গতি। প্রশান্ত মহাসাগরের সুবিশাল পটভূমিকাতেই বেশির ভাগ কাহিনী তার রচিত। মানুষের মন ও চরিত্রের দুর্জ্ঞেয় ও জটিলতার সূত্র নিপুণ হাতে খুলতে খুলতে সামান্য দু’চারটি টানে সেই বর্ণাঢ্য পরিবেশ ফুটিয়ে তোলার মুন্সিয়ানায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
তবু বাইরের প্রকৃতি নয়, মানুষের মনই তার আসল বিষয়বস্তু। বর্ণের বৈচিত্র্যে, রহস্যের নিবিড়তায়, মানুষের মনের কাছে প্রকৃতিকে হার মানিয়ে লজ্জা দেবার জন্যই যেন তিনি তার সবচেয়ে রঙিন জমকালো রূপ বেছে নিয়েছেন।
সমারসেট মমের গল্পগুলি আশ্চর্য, অপরূপ, অসংখ্য চরিত্রের অফুরন্ত এক প্রদর্শনী। কতো বিচিত্র মানুষই না সেখানে ভিড় করে আছে। মমের নিপুণ তুলিকার টানে তাদের প্রত্যেকের প্রচ্ছন্ন রহস্য অপ্রত্যাশিত ভাবে উদঘাটিত।
লেখার ভেতর দিয়ে লেখককে আবিষ্কার করা যদি সম্ভব হয়, তাহলে বলতে পারি, মমকে এই সব চরিত্রের নিয়তির নির্মম নির্বিকার বিধাতা শুধু মনে হয় না। মনে হয়, জীবনের চোরাবালিতে মানুষের ত্রুটিবিচ্যুতি, স্খলন-পতনের নিরপেক্ষ নির্লিপ্ত ইতিহাস রচনা করেই নিজেকে খালাশ মনে করতে তিনি পারেননি, শ্লেষের হাসি দিয়ে ঢাকবার চেষ্টা সত্বেও অসম্পূর্ণ অসহায় মানুষের লাঞ্ছিত সত্তার জন্য মনের নেপথ্যে একটি বিমূঢ় নিরুপায় বেদনাই তার আছে। ‘বৃষ্টি’ গল্পটির গোঁড়া সংকীর্ণচিত্ত পাদ্রী সাহেব অক্ষমতর লেখকের কলমে শুধু আমাদের বিদ্বেষ জাগিয়েই বিদায় নিত হয়তো, কিন্তু প্যাগো-প্যাগোর সমুদ্র-সৈকতে তাকে ঘৃণাভরে ফেলে আসতে আমরা পারি না। সমস্ত বাহ্যিক বিদ্রুপ অতিক্রম করে তার অন্ধ শৃঙ্খলিত মনের চরম লাঞ্ছনা ও হতাশায় মমের প্রচ্ছন্ন সহানুভূতি আমাদেরও স্পর্শ করে।
সমারসেট মম জীবনে নাটক উপন্যাস গল্প লিখেছেন প্রচুর। তাঁর অসংখ্য গল্পগুলো মমের বিশিষ্ট প্রতিভায় সমুজ্জ্বল। পৃথকভাবে কোনোটির পরিচয় দেওয়া নিষ্প্রয়োজন হলেও, একটি বিশেষ কারণে ‘শাস্তির ভরা’ গল্পটি উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়। বিচক্ষণ সমালোচকদের মতে ইংরেজি সাহিত্যে একদিক দিয়ে এমন কৌতুকময় উদ্ভট ও অপর দিক দিয়ে এমন নিদারুণ বিদ্রুপাত্মক কাহিনী কোনোদিন লেখা হয়নি। বিগত যৌবনা শ্রীহীনা ধর্মান্ধ একটি মহিলা, আর অধঃপাতের অতল পঙ্কে নিমগ্ন এক অপদার্থের জীবন নিয়ে নিয়তির পরিহাসের এ-কাহিনী শুধু মমের তির্যক কল্পনাতেই সম্ভব। বর্তমান আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যে সমারসেট মম একটি নিজস্ব বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন।
তথ্যসূত্র
১. প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত, মম-এর গল্প, সিগনেট প্রেস, কলকাতা, প্রথম সংস্করণ আষাঢ় ১৩৫৩, পৃষ্ঠা ভূমিকা সাত-দশ।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।