- সৈয়দা নাজনীন আখতার, লেখক ও কবি
মার্কসবাদী তরুণ লেখক অনুপ সাদি। মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্র বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন, বলছেন এবং গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। আমি তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দু’টির আলোকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অবস্থা বিষয়ে আলোচনা করছি।
আমরা জানি ‘সংস্কৃতি’ শব্দটির মর্মমূলে প্রোথিত রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম ইতিহাস দর্শন। সাধারণ মানুষকে স্বার্থান্বেষী চক্র সংস্কৃতির ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন কাল থেকে কালান্তরে এবং রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে বিরোধীপক্ষ করে তুলেছে। রাজনীতি ব্যতিরেকে কোনো জাতি, রাষ্ট্র বা বিশ্বের মুক্তি আসতে পারে না। এখন প্রশ্ন হলো কোন রাজনীতি। উত্তর সুস্থ’ধারার রাজনীতি, সাধারণ মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গল যে রাজনৈতিক দর্শনে উপস্থিত। যে রাজনীতি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে। সমবন্টন ব্যবস্থা যে রাজনৈতিক দর্শনের মূলমন্ত্র।
অনুপ সাদি রাজনৈতিক তত্ত্বদর্শন হিসেবে মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করেছেন। তিনি সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদের মধ্যের সূক্ষ্ম পার্থক্য ও গভীর সাদৃশ্যের সময়োপযোগী ব্যাখ্যা করেছেন। বুর্জোয়া শোষণ, পুঁজির আধিপত্য, প্রলেতারিয়েতের সংগঠন এবং বস্তুগত বন্টন ব্যবস্থার সম্যক চিত্র মানুষের সম্মুখে তুলে ধরেছেন।
বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিকভাবে দেউলে। এই দীনতার বাস্তব চিত্র অঙ্কনের লক্ষে তিনি এদেশের স্বার্থান্বেষী বুদ্ধিজীবিদের কূটকৌশলের দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন নির্মোহ দৃষ্টিতে।
পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অবক্ষয়, ধর্মীয় উন্মাদনা, ধর্মের দাপট, ধর্মের প্রচার প্রসার ও ধর্মান্ধতার-ধর্মীয় আস্ফালনের কারণ কাল মার্কস লেনিনের তত্ত্ব অনুযায়ী সহজ সরল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন।
বাংলাদেশে সমাজ জীর্ণ, রাষ্ট্রব্যবস্থা ভংগুর অর্থাৎ রাষ্ট্রতন্ত্র বিফল, ধর্ম মানবিকতা নৈতিকতাহীন। সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, অপশাসন, শোষণ, ফতোয়া সমাজ রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে।
অনুপ সাদির কয়েকটি বক্তৃতা দেখুন
অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ আজ কলের পুতুল। কল-কারখানা চালাচ্ছে–পেটে ভাতে চলছে। বিদ্রোহ-বিপ্লবের চিন্তা তাদের নেই। বিদ্রোহ না করা ও বিদ্রোহী না হওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ হলো বিচক্ষণ নেতা ও কালপোযোগী নেতৃত্বের অভাব, শ্রমিক শ্রেণির অজ্ঞানতা, ধর্মীয় উন্মাদনা, পারলৌকিক ভয়-ভীতি। উক্ত বিষয়গুলো ব্রিটিশ আমলে ও পাকিস্তান আমলেও সক্রিয় ছিল। তখনো সমাজ ও রাষ্ট্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা ছিল। প্রচার করা হতো সোভিয়েত ইউনিয়নে ধর্ম নেই, নারী-পুরুষ অনৈতিক সম্পর্কে জড়িত। বিয়ে ব্যবস্থা অনুপস্থিত। কার্ল মার্কস, লেনিনের তত্ত্ব ও দর্শন জানলে বুঝলে নাস্তিক হয়ে যায়। সেই সময়ের মানুষ এই মিথ্যাচারের অর্গল ভেঙে বের হতে সক্ষম হয়েছিল। কারণ তখন মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা ভঙ্গুর ছিল। তারা ধর্মের ক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগে তখন অক্ষম ছিল। গত পঞ্চাশ বছরে তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। আমেরিকার মদদপুষ্ট-রাষ্ট্র হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এখন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ধর্মীয় উন্মাদনা-আগ্রাসন কায়েম করতে অর্থ বিনিয়োগ করে।
বাংলাদেশের এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী লেখক কবি সাহিত্যিক রাজনীতিক শিক্ষক ছাত্র-জনতা সেই অর্থের মোহে মোহাচ্ছন্ন। ফলে সমাজ থেকে, রাষ্ট্র থেকে মানবতা, সমবন্টনের চাহিদা, সমঅধিকারের আকাঙ্খা দূরিভূত। অর্থ এবং অজ্ঞানতা মানুষকে উন্নত জীবনের প্রগতির পথ থেকে বহুদূর সরিয়ে নিতে সমর্থ হয়েছে।
কিন্তু পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আশির দশক পর্যন্ত এসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় আত্মনিয়োগ করতেন প্রগতিশীল লেখক, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক। তারা জনমানসে বুনে যেতেন ইহজাগতিক চেতনার বীজ, মানবতার বেছন। আজকের মতো ধর্মীয় উন্মাদনা-কালেমা, রোজা, নামাজ-তসবিহ পাঠ, হজ্ব যাকাতের প্রদর্শন সেদিন ছিল না। আস্তিক-নাস্তিকের চর্চা ছিল না। যারা ধর্মচর্চা করতেন, তারা নীরবে করতেন। কাউকে আঘাত করতেন না। কারোর অসুবিধা হোক এমন কাজ করতেন না। সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করতো মানুষের জন্য ধর্ম ও ধর্মের জন্য মানুষ নয়।
সে সময় ধর্মকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল ছিল। জাতীয়তাবাদী দলগুলো ধর্মকে সেই অর্থে রাজনীতিতে ব্যবহার করতো। এখন জাতীয়তাবাদী দলগুলো সাম্রাজ্যবাদীদের সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করছে।
ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনা ও কর্মকাণ্ডে সাম্যবাদীগণ দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করেন। তাঁরা জানেন একুশ শতকে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদ ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করে তাদের শোষণকে অব্যাহত রেখেছে। ফলে সাম্যবাদীগণ তাঁদের রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে ধর্মকে বাইরে রাখেন। কেননা তারা শ্রেণি সংগ্রামকে আঁকড়ে ধরে রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্ধারণ করে থাকেন। আর এই কারণেই অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের ইউরোপের মতো একুশ শতকেও ধর্মের বিরুদ্ধে হঠকারি নাস্তিক্যবাদীদের লড়াইটিকে মার্কসবাদীরা ধিক্কার দিয়েছেন।[১]
পৃথিবীর সবকিছুর মালিক মানুষ। মানুষ সকল কিছু সৃষ্টি করেছে। ধর্ম-সমাজ, রাষ্ট্র-রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি। ধর্ম ও সংস্কৃতি অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ব্যতিরেকে টিকে থাকতে পারে না। বুর্জোয়ারা এই তত্ত্ব তথ্য প্রলেতারিয়েত শ্রেণির সম্মুখে উপস্থাপন করে না কখনো।
সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য প্রয়োজন শ্রেণিসংগ্রাম ও সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠা। এর জন্য সাম্যবাদ কী ও সমাজতন্ত্র কী তা সাধারণ মানুষের কাছে সহজভাবে তুলে ধরা দরকার। সাম্যবাদকে মধ্যবিত্তের হলরুমে কাঁচের জানালা দরজা এঁটে বন্ধ করে না রাখা।
অনুপ সাদি সাম্যবাদ সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন। সাম্যবাদ অর্থ কোনো গাণিতিক সাম্য নয়। মানসিক কায়িক শ্রমের ফসল হিসেবে সমাজের যে উৎপন্ন সম্পদ সৃষ্টি হয় তা যাতে সমপরিমাণ শ্রমের সাথে সম্পর্কিত হয় তাই হচ্ছে সাম্যবাদ। জন্মগত, অবস্থানগত, রাজনৈতিক ক্ষমতাগত প্রভৃতি যে সমস্ত বৈষম্য বর্তমান তা যাতে যোগ্যতার সাথে সম্পর্কিত হয় সেটাই হচ্ছে সাম্যবাদ। প্রতিভা, দক্ষতা, কর্মক্ষমতা প্রভৃতিতে অবশ্যই মানুষ মানুষে তারতম্য থাকে। এসব হচ্ছে যোগ্যতা, সুযোগ ও চেষ্টার ফল এবং বিশেষ প্রক্রিয়ায় অর্জিত। এগুলো প্রাকৃতিক কোনো বৈষম্য নয়, স্বাভাবিক, অথচ দীর্ঘদিন তেমন দেখাটাই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
এই দেখার বিষয়টা যে পরিবারে, যে সমাজে ও রাষ্ট্রে যত প্রবল সেই সমাজ ও রাষ্ট্রে শোষণ তত তীব্রতর। এরা ভাগ্য নির্ভর, ধর্ম নির্ভর। আর এই নির্ভরতার ফলে সমাজে ধর্ম ও শোষণ জগদ্বল পাথর হয়ে চেপে বসে আছে। মানুষ হারিয়ে ফেলছে তার অপার সম্ভাবনা। পুঁজিবাদ তার টুঁটি চেপে ধরেছে। প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে স্বার্থবাদী সমাজ ও রাষ্ট্র। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের পক্ষে সক্রিয় স্বার্থান্বেষী চক্র। যেই চক্র নিজেদের কুকর্ম ও শোষণকে আড়াল করতে ধর্ম ও অপসংস্কৃতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। মানুষ পতঙ্গের মতো ঝাঁপ দিচ্ছে পুঁজির অনলে, ধর্মের পালকে। বদলে গেছে উন্নত জীবনের ধ্যান-ধারনা, আশা-আকাঙ্খা। এখন উন্নত জীবন হলো যে কোনো উপায়ে কাড়ি কাড়ি অর্থ উপার্জন, বাড়ি-গাড়ির মালিক হওয়া, ধর্মের ধ্বজাধারী হওয়া। সময় বুঝে পাপ স্খলনের জন্য তীর্থস্থানে যাওয়া। অপরাজনীতি ও অপসংস্কৃতির রোষানল থেকে বাঁচতে প্রয়োজন সাম্যবাদী রাষ্ট্র ও সমাজ।
আরো পড়ুন
- জাগো বাহে, কোনঠে সবাই
- সাহিত্য প্রসঙ্গে গ্রন্থ সম্পর্কে একটি আলোচনা
- সমাজতন্ত্র ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অবস্থা
- অনুপ সাদি মার্কসবাদের একজন সবিশেষ কর্মি
- অনুপ সাদি, নিবেদিতপ্রাণ একজন চিন্তক নিয়ে কথকতা
- শব্দ শ্রমিক অনুপ সাদি
- অনুপ সাদির দুই দশকের কাজকর্ম
- অনুপ সাদি অবিরাম চলেন সমাজবিজ্ঞান ও প্রকৃতিবিজ্ঞানের অঙ্গনে
- অনুপ সাদি একজন সংগ্রামী কলমযোদ্ধা
- নিজকথায় লোককথায় হুমায়ুন আজাদ গ্রন্থের আলোচনা
- বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা হচ্ছে অনুপ সাদি সম্পাদিত গণতন্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ
তথ্যসূত্র:
১. অনুপ সাদি, মার্কসবাদ, ভাষাপ্রকাশ, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, পৃ: ১১৩।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: অনুপ সাদি সম্পর্কিত এই মূল্যায়নটি এনামূল হক পলাশ সম্পাদিত সাহিত্যের ছোট কাগজ অন্তরাশ্রম-এর অনুপ সাদি সংখ্যা, সংখ্যা ৪, পৃষ্ঠা ৪৩-৪৫, ময়মনসিংহ থেকে ৩০ নভেম্বর ২০২২ তারিখে প্রকাশিত এবং সেখান থেকে ফুলকিবাজ.কমে প্রকাশ করা হলো।
ফুলকিবাজ ডট কমে অতিথি লেখক হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, কলাম, অনুবাদ, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লেখায় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন পূরবী সম্মানিত, ইভান অরক্ষিত, রনো সরকার, দিল আফরোজ, অনাবিলা অনা এবং রণজিৎ মল্লিক। এছাড়াও আরো অনেকের লেখা এখানে প্রকাশ করা হয়।