শিবনাথ শাস্ত্রী (ইংরেজি: Shibnath Shastri; ৩১ জানুয়ারী ১৮৪৭ – ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯১৯) ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্য সাধক, সমাজসেবীও রাজনৈতিক সংগঠক। উনবিংশ শতকের মধ্যভাগে সেই যুগের তরুণ সমাজ নতুন চেতনা ও নতুন আবেগে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। একদিকে স্বদেশপ্রেম ও অন্যদিকে পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী ভাবধারা এই দুইয়ের সমন্বয়ে সনাতনপন্থী সমাজে প্রবল পরিবর্তনের ঢেউ জাগিয়ে তুলেছিল। শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন সেই ঢেউয়ের সৃষ্টি ও পরিণতি ছিলেন শাস্ত্রী মহাশয়।
তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জানুয়ারী, চব্বিশ পরগনা জেলার মজিলপুরে। তার পিতার নাম হরানন্দ ভট্টাচার্য। প্রথমে সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল ও পরে সংস্কৃত কলেজে শিক্ষা লাভ করেন। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃতে এম. এ. পাশ করে শাস্ত্রী উপাধি লাভ করেন।
উনিশ শতকের যুক্তিবাদী ভাব আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল ব্রাহ্মধর্ম। কলেজে অধ্যয়নকালে শিবনাথও যুক্ত হলেন ব্রাহ্মসমাজ ও সামাজিক সংস্কারমূলক কাজে। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে এবং বিধবাবিবাহের পক্ষে এই সময় তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন।
জন্মেছিলেন গোঁড়া হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে। কিন্তু সেকালের হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কার ও আচার সর্বস্ব তথাকথিত ধর্মের প্রতি তিনি ক্রমেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। অচিরেই ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে উপবীত ত্যাগ করেন এবং মূর্তিপূজার সঙ্গে চিরতরে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এর ফলে তাকে পিতার বিরাগভাজন হতে হয়েছিল।
কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে যে সংস্কার আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল তার প্রধান লক্ষ ছিল শিক্ষা, সুলভ সাহিত্য ও কারিগরী বিদ্যার প্রচার এবং মদ্যপান নিবারণ। শিবনাথ কেশবচন্দ্রের Indian Reforms Association-এ যোগ দেন এবং মদ না গরল নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন।
তিনি কেশবচন্দ্রের নারীমুক্তি আন্দোলনেরও একজন প্রধান সহযোগী ছিলেন। এই আন্দোলনের ফলেই পরবর্তী সময়ে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মেয়েদের ন্যূনতম বিবাহের বয়স চোদ্দ আইনসিদ্ধ হয়েছিল।
মহিলাদের উচ্চ শিক্ষার প্রশ্নে কেশবচন্দ্রের সঙ্গে মতভেদ ঘটলে তিনি কয়েকজন তরুণকে নিয়ে একটি বৈপ্লবিক সমিতি গঠন করেন। সমিতির গঠনতন্ত্র রচিত হয়েছিল জাতীয়তা মূলক ও সমাজ সংস্কারমূলক শিক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার পরিকল্পনাকে সামনে রেখে। এই গুপ্ত সমিতিতে যোগ দিয়েছিলেন আনন্দমোহন বসু, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
গুপ্ত সমিতির প্রধান কর্মসূচী ছিল জাতিভেদ প্রথা অস্বীকার, সরকারী চাকরি অস্বীকার, সারা ভারতে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংহতি এবং সাম্য প্রতিষ্ঠা, সমাজে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি। ঘোড়ায় চড়া ও বন্দুক চালনা শিক্ষাও কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই সময় শিবনাথ যুগান্তর নামে একটি সামাজিক উপন্যাস প্রকাশ করেন। এই নামানুসারেই পরবর্তীকালে অর্থাৎ ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার নামকরণ হয়েছিল।
১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে শিবনাথ প্রথমে ভবানীপুরে সাউথ সুবার্বন স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে যোগদান করেন। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে এই কাজ ছেড়ে হেয়ার স্কুলে সংস্কৃত শিক্ষকরূপে যোগ দেন। কিন্তু সামাজিক সংস্কার মূলক কাজ ও ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অচিরেই সরকারি চাকুরিতে বিরাগ জন্মে। এছাড়া গুপ্ত সমিতির কাজে যে কর্মসূচী গৃহীত হয়েছিল তার জন্যও চাকরি ত্যাগ করা জরুরী হয়ে পড়েছিল। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি চাকরি ত্যাগ করেন।
কেশবচন্দ্রের সঙ্গে মতবিরোধের পর শিবনাথের নেতৃত্বে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় এই বছরই। তাঁর মাধ্যমে তিনি সর্বশক্তি নিয়ে সমাজ সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন।
শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আনন্দমোহন বসুর সঙ্গে একযোগে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে সিটি স্কুল স্থাপন করেন। এছাড়া গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠিত করবার জন্য স্টুডেন্টস সোসাইটি নামে একটি গণতান্ত্রিক ছাত্র প্রতিষ্ঠান তার নেতৃত্বে গঠিত হয়।
কিশোরদের জন্য ভারতে প্রথম মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ থেকে। এই পত্রিকার নাম ছিল সখা। এই পত্রিকা ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে শিবনাথের উৎসাহ ও উদ্যোগেই প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে শিবনাথ শাস্ত্রী ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারের উদ্দেশ্যে ছয় মাসের জন্য বিলেত গিয়েছিলেন। ইংরাজ চরিত্রের জাত্যাভিমান, নিয়মানুবর্তিতা ও বিবিধ সদগুণ তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। এই সকল গুণাবলীর প্রতি লক্ষ রেখে তিনি তার প্রতিষ্ঠিত সাধনা শ্রমের কর্মপ্রণালী প্রস্তুত করেছিলেন।
সমাজসংস্কারক শিবনাথের প্রধান পরিচয় কবি, সাহিত্যিকও সাংবাদিকরূপে। তাঁর বিখ্যাত তথ্যমূলক গ্রন্থ আত্মচরিত এবং রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ। প্রবন্ধকার রূপে তিনি প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর রচিত অন্যান্য গ্রন্থ হচ্ছে হিমাদ্রিকুসুম, নির্বাসিতের বিলাপ, নয়নতারা, বিধবার ছেলে, ধর্মজীবন, রামমোহন রায়, History of Brahmo Samaj, Men I have seen প্রভৃতি।
শিবনাথ রচিত মেজবৌ উপন্যাসের ইংরাজি অনুবাদ ইংলন্ডের Indian National journal-এ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত মুকুল পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করতেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর শিবনাথ লোকান্তরিত হন।
তথ্যসূত্র
১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৮১-৮৩।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।