শাহেরা খাতুন সময়কে ধারণ করেছিলেন নিজের চতুর্দিকে বিরাজিত সময়কে সামনে এগিয়ে নিতে। তিনি যে সময়ে জন্মেছিলেন তখন শহুরে মধ্যবিত্তের বিকাশ যদিও মধ্যগগনে, কিন্তু গ্রামীণ জীবনে তেমন টানাপোড়েন দেখা যায়নি। জমিদারি নৃশংসতার বিরুদ্ধে কৃষকগণের আন্দোলনের চল পুরোমাত্রায় চালু হয়ে গেছে। কৃষক সংগঠনগুলো সারা বাংলায় নিজেদের সংগঠনকে শক্তিশালী করে তুলেছে। কিছুদিন পরেই গোটা বাঙাল মুলুকে শুরু হবে তেভাগা আন্দোলন।
শাহেরা খাতুনের জন্মের সময়ে আধুনিক বর্বর ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে মহান বিপ্লবীগণ প্রায় ত্রিশ বছর ধরে লড়াই চালিয়েছেন। গ্রামীণ কৃষকেরাই ছিলেন এই বর্বরদের সবচেয়ে নিপীড়নের শিকার এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবার বিপ্লবীদের মূল যোগানদাতা। ফলে মালদহ শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দুরের এক গ্রামে জন্ম নেয়া গ্রামীণ বালিকার কাছেও পৌঁছে যায় বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর জীবনের গল্প। তিনি সারা জীবন ধরে পছন্দের যে গান শুনবেন তা হচ্ছে ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’।
দেশভাগের পূর্বে জন্ম নেয়া এই মানুষটি যেন সমগ্র বাংলা ঘুরতে বের হয়েছিলেন। বিহারে গেছেন বহুবার, কিন্তু খোট্টা বলে একটু কৌতুকও করেছেন বিহারীদের। কলকাতার ফুটপাতে খাবার খেতে গিয়ে আমরা বহুবার ভরদুপরে এই বিহারের শ্রমিকদেরকে ডাল-ঝোল-তরকারি ছাড়া খটখটে রুটি খেতে দেখেছি এবং আশ্চর্য হয়েছি। অন্যের সংস্কৃতির ভিন্নতা বুঝতে এবং শ্রদ্ধা করেও আমিও যেন কৌতুক করে হলেও বিষয়টি ভেবে কিছুটা আনন্দ পেয়েছি।
নিজ কথ্য ভাষাকে যেমন ভালোবেসেছিলেন, তেমনি নিজ জগতের বাইরে অন্য একটি জগত আছে সেটি জেনেছিলেন অভিজ্ঞতা থেকে। হিন্দির বিরোধী এই মানুষটি ভাষার ক্ষেত্রে জাতীয়বাদী ছিলেন, কেউ অন্য ভাষা শিখতে চাইলে আগ্রহ দেখিয়েছেন। তিনি আরবি ও উর্দু ভাষা জোর করে শেখানোর বিরোধীতা করেছেন, ভাষার আধিপত্যকে মেনে নেননি, জোর করে ছাত্রদের আরবি শেখানোকে পছন্দ করেননি, কোনো কোনো কোঁকড়া অক্ষরধারীদেরকে নিয়ে কৌতুক করে বলতেন, যারা এই কোঁকড়া অক্ষর পড়ে তাদের মনটাও খুব বাঁকা।
সরল জীবনাচরণে বিশ্বাসী এই মানুষটি প্রদর্শনের ভড়ং এবং কথায় চিঁড়ে ভেজানো মিথ্যাচারকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। একবার ময়মনসিংহ শহরে একটি রাজনৈতিক জনসভায় তিনি অংশ নিলেন। জনসভায় যেসব আশাবাদী চাপাবাজী শোনানো হয়, সেসব সম্পর্কে আমি জানতে চাইলে তিনি সরাসরি আমাকে বলেছিলেন যে, দেশের গদিতে বসলে সব নেতাই এরকম বড় বড় ওয়াদা ভুলে যাবে। দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি যা বুঝে ফেলেছিলেন ১০ মিনিটে, আমাকে তা বুঝতে লেগেছিল অন্তত তিন বছর।
তিনি ভেতরের গুণকে দেখতে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু বাহিরের চাকচিক্যের মোহে নিজেকে বিলীন করেননি। মধ্যবিত্তের ব্যারাম-আরাম-আয়েশে পীড়িত ছিলেন না, কৃষকের চিরন্তন কাজকে উৎপাদনের উপায় হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং কৃষিকে বেঁচে থাকার প্রয়োজন মতো দেখেছিলেন। প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়েছেন, প্রদর্শনকে বর্জন করেছেন এবং পরজীবীতাকে ঘৃণা করেছেন।
বিশ শতকের গ্রামীণ আর দশজন নারীর মতো তারও কোনো অলসতা ছিল না। এমন এক জলজ এলাকায় তার জন্ম হয়েছিল, যেখানে প্রধান ফসল ছিল বোরো ধান, জয়া ধান এবং ডাল জাতীয় শস্য। ফলে শ্রম করেই ফসল তুলতে হবে, এই নীতিতে সারা জীবন বিশ্বাসী ছিলেন। পরজীবীদেরকে ঘৃণা করতেন অন্তরের গভীর কোটর থেকে, তাই সবাইকে কাজ করতে উৎসাহী করেছেন। শাহেরা খাতুন নিজ সময়কে ধারণ ও বিশ্লেষণ করার পদ্ধতিটি শিখেছিলেন সূর্য ও ঋতু নির্ভর ফসল ফলানোর পদ্ধতি ও শৃঙ্খলা থেকেই।
পারিবারিক কাজগুলো করেছেন জীবনের তাগিদ থেকে, যেই জীবন স্বার্থপরতার বেড়াজালে বন্দি ছিল না। দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী কাজের সমন্বয় করতে পেরেছেন দক্ষ হাতে। ঘরকন্নার কাজে ঢিলেমি ছিল না যা তাঁকে প্রতিদিন বাঁচিয়ে রাখত। একই সাথে দশ পনের বছর পরে ফল পাওয়া যাবে এমন কাজ করেছেন যত্ন নিয়ে। পাঁচটা গাছ রেখে দিয়েছেন, দশ বছর পরে পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছেন, সেই টাকা দিয়ে বড় একটা কাজ করে ফেলেছেন। এরকম দীর্ঘ মেয়াদি কাজ করেছেন, যা তাৎক্ষণিক লাভালাভের হিসেব ছাড়াই করেছেন।
শাহেরা খাতুন যে উদার চিত্তের অধিকারী ছিলেন সেই উদারতার ভাণ্ডার হতে কোনো অভাবী ফেরত যায়নি। তিনি অন্যকে পরামর্শ দিয়েছেন নিজের মতো করে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। আমরা বুঝতে পারি এই ব্যস্ততার যুগে সুপরামর্শ দেবার লোকের যখন খুব অভাব, তখন বিনামূল্যে যদি কেউ হাজার টাকার পরামর্শ দেয় তবে সেটা নেহায়েত কম নয়। সমাজে যখন উপকার করার লোকের অভাব থাকে তখন সামান্য উপকারও অসামান্য হয়ে দেখা দিতে পারে।
১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশে অভাব ছিল প্রচণ্ড। সেই অভাবের দিনগুলোর মধ্যে আশির দশকের আমি নিজেই প্রত্যক্ষদর্শী। ইরি ধান আবাদ শুরু হবার আগে গ্রামে খাদ্যাভাব ছিল নিত্য দিনের সমস্যা। যখন আমাদের নিজেদের পড়ালেখার খরচ চালাতে পিতামাতার দুরবস্থা, তখনও দেখেছি, মা গভীর রাত্রে গোপনে কোনো এক গামলায় করে একটু খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন কোনো এক প্রতিবেশীর বাড়িতে, যে বাড়িতে সেদিন সারাদিন কিছু রান্না হয়নি। বড় হবার পর বুঝেছি, কোন বাড়িতে অভাব থাকে, এই খবর মা ঠিকই পেতেন, যদিও আমি সেই খবর পেতাম না।
দয়া করা সাধারণভাবে সব মানুষেরই স্বভাব। তবু নির্দয় মানুষও এই সমাজে বিস্তর দেখা যায়। টমাস হবস অনুমোদিত আধুনিক সমাজ তো নিষ্ঠুরতা আর নির্দয়তা নিয়েই গঠিত। এরকম এক সমাজে থেকেই ক্ষুধার্ত, শোকার্ত ও বেদনার্তকে দয়া দেখানো তার প্রত্যেক দিনের কাজ ছিল। এই দয়ার রূপভেদও তিনি করতেন, আর্থিক দয়া দেখিয়েছেন যারা সত্যিকারের অভাবী তাদেরকেই। নিরীহ মানুষ অত্যাচারিত হলে নিরীহদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন সব সময়। মেয়েদের গায়ে হাত তোলা ছিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এক সাধারণ ব্যারাম। এই ব্যারামের বিরুদ্ধে তার সাধারণ ঘৃণা ছিল এবং তিনি সকল সময়ে নিরীহ নারীর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
নিরীহ নারী ছাড়াও তিনি যে কোনো নিরীহ ব্যক্তি বিপদে পড়লে বা নিপীড়নের শিকার হলে তিনি নিরীহ ব্যক্তির পক্ষেই থেকেছেন। এমনকি তার নিজ সন্তানদের ভেতর অসুস্থ ও নিরীহ মেজ ছেলের অনেক ভুল কাজের পক্ষে কথা বলেছেন এই কারণে যে, সে অসুস্থ। এই সমাজে দুর্বলের পক্ষে থাকাটাই যেখানে অনেক ধৈর্যের ব্যাপার সেখানে, দুর্বল হবার কারণে তার ভুল কাজকে তিনি এই বলে সমর্থন দিতেন যে, দুর্বল না হলে হয়ত সে সেসব ভুল কাজ করত না।
১৯৮০’র দশক বা তার পূর্বে গ্রামে বাড়ি পুড়ে সম্পদহানি হওয়া ফিবাৎসরিক ঘটনা ছিল। এরকম ঘটনায় তিনি টাকা পয়সা বা খাদ্যদ্রব্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন, যখন সেটা পারেননি তখন হয়ত ঘর মেরাতের দুটি গাছ অনায়াসে দিয়েছেন। ২০১৭ সালে মার্চ মাসে এলাকায় বাড়ী পুড়লে সহায়তা করেন। সারা জীবন গ্রামীণ পরিবেশে তিনি বাড়ি তৈরির সামগ্রী দিয়ে সহায়তা করেছেন।
শাহেরা খাতুন নামের পরোপকারী এই মানুষটি নিজের সময়কে ধারণ করেও কথায় ও কাজে প্রগতিশীল ছিলেন, উন্নতির জন্য চেষ্টা করেছেন, তবে সেই উন্নতি কখনোই কেবল নিজের পরিবারের উন্নতির জন্য ছিল না। আশপাশের সকলকে নিয়েই এগিয়ে যেতে চেয়েছেন, সবার সাথে মিশেছেন, তবে এই সম্পর্ক কখনোই তাঁকে অতিরিক্ত কৌশলী করেনি। সদিচ্ছা আর সততাকে সঙ্গে করে তিনি তার কাজকে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়েছেন।
তাঁকে ব্যস্ততা ও লোভ কখনোই গ্রাস করতে পারেননি। ২০০০ সালের পরে বাংলাদেশে মধ্যবিত্তদের ভেতর যে ব্যস্ততা, হুড়োহুড়ি ও হাহাকার দেখি, সেরকম তাড়াহুড়া তার ভেতরে কখনো দেখিনি। বিশ্বজয়ী বীর হবার তার আকাঙ্ক্ষা ছিল না, ধনসম্পদ গরিমায় মত্ত কোনো নারী হবার ইচ্ছা তার ছিল না। তার ইচ্ছা ছিল এমন এক পরিবেশ যেখানে কেউ ক্ষমতাদর্পী নিপীড়ক হবে না। সবাই ভালোভাবে খেয়ে পরে বেঁচে থাকবে, নিজেদের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে চর্চা করবে, নিজেদের গুণের বিকাশ ঘটাবে এবং জ্ঞানকে চর্চার মাধ্যমে কাজে লাগাবে।
তিনি বদলে যাওয়ার বিরোধীতা করেননি, নতুন ভাবে জীবনধারনের বিরোধীতা করেননি। নতুন বিষয়গুলোকে আগ্রহ নিয়েই গ্রহণ ও পর্যবেক্ষণ করেছেন। তার মতামত জোর করে কারো উপর চাপিয়ে দিতে দেখা যায়নি, সবাইকে নিজ বুদ্ধি অনুসারে কাজ করতে, নিজ মেধাকে কাজে লাগাতে উৎসাহ দিতেন। নিজের মতকে আর পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলে যাচাই করে নিতে চেয়েছেন।
তিনি ঘুরতে পছন্দ করেছেন, নিজে বিভিন্ন জায়গায় পরিভ্রমণের জন্য উদগ্রীব থাকতেন। বিভিন্ন জেলায় ঘুরেছেন। যেসব স্থান দেখেছেন সেগুলোর কাহিনী বলতে পছন্দ করতেন। ঘুরতে পছন্দ করলেও সবার একটি দেশ থাকবে সেটা চাইতেন, কারণ দেশহীন মানুষের কষ্ট তিনি জানতেন। ১৯৭১ সালে পশ্চিমবঙ্গে থাকাকালীন অভাবের সময় তিনি বলতেন, ‘দেশ দেশ আপন দেশ, খাই খোকসা তাও বেশ’। স্বদেশের প্রতি মায়া ও নির্ভরতা তাঁকে করেছিল স্বদেশপ্রেমী।
জীবনের শেষ বছরগুলোতে, নির্দিষ্টভাবে বললে ২০১৭ সাল থেকে তাঁকে অতিরিক্ত বিজ্ঞানমনস্ক হতে দেখেছি। রক্তশূন্যতা দেখা দিলে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার খেয়েছেন। এছাড়াও তিনি মনে করতেন ওষুধ খেলেই ভালো হয়ে যাব, রক্ত পেলেই সুস্থ হয়ে যাব। খুব বেশি উচ্চ রক্তচাপ সত্ত্বেও রক্ত গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর আর সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বেঁচে ফেরা সম্ভব হয়নি।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।