সাবিত্রী দেবী ও তার ছেলে রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী যুগান্তর দলের কর্মী ছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনে অংশ না নিলেও নানাভাবে সাহায্য, সহযোগিতা করেছেন। এজন্য কারাদণ্ড হয়েছে। জেলে অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর করুন কাহিনী এখনও বিপ্লবী মহলের দেয়ালে লেপ্টে আছে।
সাবিত্রী দেবী-এর রাজনৈতিক কাজ
সাবিত্রী দেবী ১৮৮৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার স্বামীর নাম নবীন চক্রবর্তী। যখন বিপ্লবী কাজে যুক্ত হন তখন তিনি বিধবা ছিলেন। চট্টগ্রামে ধলঘাট নামক গ্রামে তিনি থাকতেন। সাবিত্রী দেবী ও তাঁর ছেলে রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী আশ্রয় দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের নেতা বিপ্লবী সূর্য সেনকে অর্থাৎ মাস্টারদাকে। মাস্টারদার অনুগত কর্মী নির্মল সেন, অপূর্ব সেন এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার তখন সেখানেই আত্মগোপন করে ছিলেন।
১৯৩২ সালের ১২ জুন রাতে মিলিটারি এসে হঠাৎ সেই বাড়ি ঘিরে ফেলে। মিলিটারি ও বিপ্লবী উভয়পক্ষে বেধেছিল তুমুল সংগ্রাম। বিপ্লবীদের গুলীতে ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের প্রাণহীন দেহ ভূলুণ্ঠিত হয়। নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন মিলিটারির গুলীতে নিহত হন। সেই দারুণ গোলমালের মধ্যে মাস্টারদা প্রীতিলতাকে নিয়ে অন্তর্ধান হন।
গ্রেপ্তার ও কারাদণ্ড
বিপ্লবী বীর সূর্য সেন ও তাঁর অনুবর্তীদের আশ্রয় দেবার অপরাধে সাবিত্রী দেবী তাঁর একমাত্র ছেলে রামকৃষ্ণ চক্রবর্তীর প্রতি চার বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়। তাঁদের তৃতীয় শ্রেণীর বন্দীরূপে জেলে রেখে দেওয়া হয়। তাঁদের মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যায়। জেলের সুপারিনটেন্ডেন্ট তখন কাটারিয়া— যেন নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার একটা প্রতিমূর্তি। রামকৃষ্ণ যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে জেল-হাসপাতালে নামমাত্র চিকিৎসাধীন রইলেন। তাঁর শীর্ণ পা-দুখানিতে লোহার ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে দেওয়া আছে। লোহার ডাণ্ডা বহন করছেন যক্ষ্মারোগী শুয়ে-শুয়েও। রোগের অসহ্য যাতনা ও কাশির যন্ত্রণার সঙ্গে বেজে চলেছে পায়ের শৃঙ্খল। বোধ করি ইংরেজ শাসনের চরম বর্বরতার এক পৈশাচিক পরিচয় পেয়েছিল সেদিন মেদিনীপুর জেলের হাসপাতাল। সুপারিনটেন্ডেন্ট কাটারিয়া ছিলেন ডাক্তারও। তিনি ডাক্তারি কতখানি করেছেন সে-পরিচয় জানি না, কিন্তু তাঁর নির্যাতনের এক চরম রূপ ছাপ রেখে গেছে হাসপাতালের যক্ষ্মারোগীর প্রতিটি নিশ্বাসে। ঐ জেলেরই ফিমেল-ইয়ার্ডে মা সাবিত্রী দেবী অসুস্থ পুত্রকে একবার দেখবার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আকুল আবেদন জানিয়ে বৃথাই মাথা কুটে মরেছেন, অনুমতি মেলে নি।
ইউটিউবে দেখুন আমার লেনিন তথ্যচিত্র
ছেলের মৃত্যু
একদিন মেদিনীপুর জেলের সিপাইদল কোনো ছুতোয় বিপ্লবীদের একদলকে আক্রমণ করে। প্রতিরোধ করতে গিয়ে বিপ্লবী অমূল্য সেন দু-চারজন সিপাইকে ধরাশায়ী করেন। তখন সিপাইদল তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর মাথা ও হাত ভেঙে দেয়। সংকটাপন্ন ও অজ্ঞান অবস্থায় তাকে আনা হয় জেল-হাসপাতালে। বহুক্ষণ পরে যখন তার জ্ঞান ফিরে এল, তিনি দেখলেন তার পাশে স্নেহকাতর উদ্বেগাকুল দৃষ্টি নিয়ে বসে আছেন দুর্বল রুগ্ন রামকৃষ্ণ। ডাণ্ডাবেড়ির ভারে তিনি সোজা হয়ে দাড়াতে পারছেন না। অতিক্ষীণ স্বরে মমতার সঙ্গে তাকে সান্ত্বনা-বাক্য বলে ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে, পায়ের ডাণ্ডা অতিকষ্টে টেনে নিয়ে নিজের শয্যায় চলে গেলেন মৃত্যুপথযাত্রী রামকৃষ্ণ। অমূল্য সেন বেঁচে উঠেছিলেন। কিন্তু রামকৃষ্ণের দিন ফুরিয়ে এসেছিল। দীপ নিবে গেল, কিন্তু ডাণ্ডাবেড়ি তার দেহ থেকে অপসৃত হ’ল না। জীবিতকালে মায়ের সঙ্গে শেষ দেখা তার হয় নি একই জেলে থাকা সত্ত্বেও। মৃত পুত্রকে দেখাবার জন্য বিধবা মা সাবিত্রী দেবীকে মেয়েদের ‘ডিগ্রী’ থেকে এবার নিয়ে আসা হল। যক্ষ্মারোগাক্রান্ত একমাত্র পুত্রের শবদেহে তখনো বাঁধা রয়েছে ইংরেজের প্রবল পরাক্রমের চিহ্ন ডাণ্ডাবেড়ি। বুঝি এমন-সব দুর্লভ রত্নদের মনে করেই কবি লিখেছিলেন—
“তোমার শঙ্খ ধুলায় পড়ে
কেমন করে সইব,
বাতাস আলো গেল মরে
একি রে দুর্দৈব!”
জেল পরবর্তী সময়
মুক্তি পাবার পরও সাবিত্রী দেবীকে পুলিস রেহাই দেয় নি। অনেক কষ্ট ও নির্যাতন তাকে প্রতি পদে সইতে হয়। মাস্টারদার প্রতি সাবিত্রী দেবীর অটুট শ্রদ্ধাই ছিল তার মনোবলের পাথেয়। তারই পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি বাকী জীবনে তার অনমনীয় দৃঢ়তার মধ্য দিয়ে। সমস্ত পীড়ন তিনি নীরবে সহ্য করে গেছেন।
স্বাধীন ভারতের ভিত্তি যারা একদিন আপন জীবন বলি দিয়ে গেঁথে গেছেন তাদের পশ্চাতে ছিলেন এই-সব সাবিত্রী দেবী ও রামকৃষ্ণ চক্রবর্তীর মতো কত নীরব ও সর্বংসহা সেবিকা ও সেবক। তারাও নিজেদের ভবিষ্যৎ ভাবেন নি, দুঃখকে চিরজীবনের পাথেয় করে নিয়ে শহীদদের এগিয়ে চলার রাস্তা তৈরি করে চলেছিলেন। জাতির জীবন-সমুদ্রের তলায় কত অমূল্য মণিমাণিক্য এমনি করে ছড়িয়ে আছে, আমরা তার কতটুকু খবর রাখি!
আরো পড়ুন
- শান্তিসুধা ঘোষ ছিলেন যুগান্তর দলের বিপ্লবী
- শোভারানী দত্ত ছিলেন বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা
- সাবিত্রী দেবী ছিলেন যুগান্তর দলের বিপ্লবী
- মায়া ঘোষ ছিলেন বিপ্লবী দলের নেত্রী
- বিমলপ্রতিভা দেবী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কর্মী
- বনলতা সেন (চক্রবর্তী) ছিলেন অনুশীলন সমিতির নেত্রী
- বনলতা দাশগুপ্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের তরুণ বিপ্লবী
- নির্মলা রায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন বিপ্লবী
- সুষমা রায় ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী কর্মী
- ছায়া গুহ ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের বিপ্লবী নেত্রী
- কমলা দাশগুপ্ত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলের বিপ্লবী নেতৃত্ব
- কমলা চট্টোপাধ্যায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী
- ঊষা মুখার্জী ছিলেন অনুশীলন দলের বিপ্লবী
- পারুল মুখার্জী ছিলেন অনুশীলন দলের বিপ্লবী
- উমা সেন ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী নারী বিপ্লবী
তথ্যসূত্র:
১. কমলা দাশগুপ্ত (জানুয়ারি ২০১৫)। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী, অগ্নিযুগ গ্রন্থমালা ৯। কলকাতা: র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন। পৃষ্ঠা ১৪৭-১৪৮। আইএসবিএন 978-81-85459-82-0
দোলন প্রভা বাংলাদেশের একজন কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও উইকিপিডিয়ান। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। তার জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯ তারিখে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার রেলওয়ে নিউ কলোনিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বাংলাদেশের আনন্দমোহন কলেজ থেকে এমএ সম্পন্ন করেছেন। তিনি ফুলকিবাজ এবং রোদ্দুরে ডটকমের সম্পাদক।