সত্যজিৎ রায় (ইংরেজি: Satyajit Ray; ২ মে ১৯২১ – ২৩ এপ্রিল ১৯৯২) ছিলেন সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পীও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার। তাঁর জন্ম হয় ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২ মে ময়মনসিংহের মসুয়ার জমিদার বংশে। তাঁর পিতা বাংলা শিশু সাহিত্যে খেয়াল রসের স্রষ্টা সুকুমার রায়, মাতা সুপ্রভাদেবী। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের মতই সংস্কৃতি ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ অবদানের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
এই বংশেরই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন শিশু সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী ও যন্ত্রকুশলী। সত্যজিৎ ছিলেন তারই পৌত্র। মাত্র আড়াই বছর বয়সে পিতৃহারা হন, মাতা সুপ্রভাদেবীর সঙ্গে সত্যজিৎ ছয় বছর বয়স থেকে মামার বাড়িতে থাকেন। মায়ের কাছেই পড়াশুনা আরম্ভ। সংসারেব প্রয়োজনে সুপ্রভাদেবীকে এক সময়ে বিদ্যাসাগর বাণীভবন বিদ্যাশ্রমে সেলাইয়ের কাজও করতে হয়েছিল।
অস্কার পুরস্কারে সম্মানিত চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ জীবনের প্রথম টকি ছবি দেখেন ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে। ছবির নাম টার্জান দ্য এপম্যান। এর আগে নির্বাক ছায়াছবি যা দেখেছিলেন তার মধ্যে বেন হুর, কাউন্ট অব মন্টিক্রিস্টো, থিফ অব বাগদাদ, আঙ্কল টমস কেবিন প্রভৃতির নাম পরিণত বয়সেও তার মনে ছিল।
দশ বছর বয়সে বালিগঞ্জ হাইস্কুলে ফিফথ ক্লাসে অর্থাৎ এখনকার মতে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হন। এখান থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে বি.এ. পাশ করেন ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে।
বাবা এবং ঠাকুরদার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রেই শিল্প-সাহিত্যের প্রতিভা লাভ করেছিলেন সত্যজিৎ। স্কুলে থাকতে বাড়ির সংগ্রহের রেকর্ড শুনে পাশ্চাত্য সঙ্গীতে দীক্ষিত হয়ে যান ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান হিসেবে। এর পাশাপাশি ব্রহ্মসঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত ও ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের প্রতিও অনুরাগ জন্মেছিল।
চিত্রশিল্পের চর্চা বাল্যবয়স থেকেই ছিল। বি.এ পাশকরার পর শিল্প শিক্ষার জন্য ভর্তি হন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে। কিন্তু আধুনিক মনা সত্যজিতের পক্ষে এখানকার পরিবেশ মনঃপুত না হওয়ায় শিক্ষা অসমাপ্ত রেখেই কলকাতায় চলে আসেন।
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে তিনি ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন কোম্পানি ডিজে কিমারসংস্থায় জুনিয়র ভিসুয়ালাইজার হিসেবে যোগ দেন। এই সময়েই তিনি সিগনেট প্রেস প্রকাশন সংস্থার বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। ছোটদের পত্রিকা মৌচাকেও তার প্রথম আঁকা ইলাস্ট্রেশন প্রকাশিত হয়।
অক্ষরলিপিতেও এই সময় তিনি দক্ষতা অর্জন করেন। পরবর্তীকালে অক্ষরলিপিতে রোমান টাইপ সিরিজ তার বিশেষ অবদান বলে স্বীকৃত হয়। কয়েক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানের আর্ট ডিরেক্টরের পদে উন্নীত হন। তার প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালীর সাফল্যের পর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে এই চাকরিতে ইস্তফা দেন।
সত্যজিৎ রায় পরিচালিত পথের পাঁচালীর প্রথম প্রদর্শনী হয় নিউইয়র্কে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে। কলকাতায় মুক্তি পায় সেই বছরেই ২৬শে আগস্ট। ছবিটি সেই বছরই রাষ্ট্রপতির স্বর্ণ ও রৌপ্য পদক পায়। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট-এর প্রশংসাপত্র লাভ করে। এরপর ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পথের পাঁচালী বিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্রোৎসবে পুরস্কৃত ও সম্মানিত হয়েছে।
এরপর থেকে চলচ্চিত্রকার সত্যজিতের জয়যাত্রা শুরু হয়। তাঁর পরিচালিত প্রায় সবকটি ছবিতেই তার সৃজনশীল প্রতিভার বিস্ময়কর প্রকাশ ঘটেছে যা ভারতীয় অন্য কোনো ছবিতে ছিল দুর্লভ। বস্তুত সত্যজিৎ ভারতীয় চলচ্চিত্রের গোত্রান্তর ঘটিয়েছিলেন। তার পরিচালিত উল্লেখযোগ্য ছবি অপরাজিত, অপুর সংসার, জলসাঘর, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অভিযান, মহানগর, চারুলতা এবং শেষ দিককার ঘরেবাইরে, গণশত্রু, শাখা প্রশাখা, আগন্তুক প্রভৃতি।
১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে পরিচালনা করেন প্রথম হিন্দি ছবি শতরঞ্জকে খিলাড়ি। তার তৈরি তথ্যচিত্র হলো রবীন্দ্রনাথ, সিকিম, সুকুমার রায়, বালা, ইনার আই প্রভৃতি। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সত্যজিৎ রায় তার পিতামহ ও পিতার প্রিয় সন্দেশ পত্রিকা নতুন করে প্রকাশ শুরু করেন। সম্পাদনা ও অলঙ্করণের পাশাপাশি নিজেও লেখা শুরু করেন। এভাবেই একে একে সৃষ্টি হয় ফেলুদা, তপশে, জটায়ু, প্রফেসর শঙ্কুর মত বাঙালি শিশু-কিশোরদের প্রিয় কিছু সাহিত্যচরিত্র।
লিয়রের ছড়া অবলম্বনে পাপাঙ্গুল তার প্রথম রচনা। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহী আংটি প্রকাশিত হয়। সেই থেকে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নয়না রহস্য তার সর্বশেষ বই প্রকাশিত হয়। সাহিত্যের আসরেও গল্প বলার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের জন্য অল্পসময়ের মধ্যেই সত্যজিৎ প্রশংসা ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তাঁর রচিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই প্রোফেসর শঙ্কুর কাণ্ডকারখানা, সোনার কেল্লা, বাক্স রহস্য, জয়বাবা ফেলুনাথ, গোরস্থানে সাবধান, যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে, তারিণী খুড়োর কীর্তিকলাপ, দার্জিলিং জমজমাট প্রভৃতি। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রাফেসর শঙ্কু বছরের শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্য গ্রন্থরূপে আকাদেমি পুরস্কার লাভ করে।
সাহিত্যিক হিসেবে এছাড়াও তিনি আরও সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন। চলচ্চিত্রকার হিসেবে সত্যজিৎ দেশেরও বিদেশের বহু পুরস্কারও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি. লিট উপাধি লাভ করেন। বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম সম্মান এবং ভারত সরকারের ভারতরত্ন উপাধিতে ভূষিত হন।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া মিতেরা কলকাতায় এসে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান লেজিঁয় দ’র-এর স্বর্ণপদক প্রদান করেন। সিনেমা শিল্পের সর্বোচ্চ পুরস্কার অস্কার লাভ করেন ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায় কলকাতায় পরলোক গমন করেন।
তথ্যসূত্র
১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৭৫-৭৭।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা উনিশটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।