সাবের আলী ছিলেন বিশ শতকের সাতারু, ক্রীড়া ও শিক্ষানুরাগী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

মো. সাবের আলী বা সাবার আলী (২৫ আগস্ট ১৯২৮ – ২১ ডিসেম্বর ১৯৯২) ছিলেন বিশ শতকের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাতারু, ক্রীড়াবিদ, সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী বাঙালি। গম্ভীরা ও আলকাপ গানের এই শিল্পী সংস্কৃতি ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বহুবিধ অবদান রেখেছেন। তিনি যৌবনে দক্ষ সাতারু এবং ক্রীড়ানুরাগী হিসেবে নবাবগঞ্জ, মালদহ, পুর্ণিয়া, কাটিহার, কিশানগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও ও অবিভক্ত দিনাজপুর জেলায় সুনাম অর্জন করেন। পেশাগত জীবনে ব্যবসায়ী ও কৃষক সাবের আলী জীবনের শেষদিকে শিক্ষা ও সমাজসেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন।

মো. সাবের আলী ১৯২৮ সালের ২৫ আগস্ট তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের মালদহ জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ এলাকার (বর্তমানে শিবগঞ্জ উপজেলা) বাগডাঙ্গা গ্রামে এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম তাহের উদ্দীন এবং মাতার নাম আসমা খাতুন। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মেজো। তার স্ত্রীর নাম শাহেরা খাতুন। তিনি তিন পুত্র সন্তান ও এক কন্যা সন্তানের জনক। তার বড় সন্তান লেখক ও অধ্যাপক মো. আবদুল ওদুদ, দ্বিতীয় সন্তান ব্যবসায়ী বানি ইসরাইল ও ছোট সন্তান লেখক ও অধ্যাপক অনুপ সাদি এবং একমাত্র কন্যা সুফিয়া খাতুন গৃহিণী।

শৈশব

সাবের আলী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মক্তবে লেখাপড়া করে বাল্য জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি শৈশবেই গম্ভীরা গান ও আলকাপ গানের সাথে পরিচিত হন। আলকাপ ও গম্ভীরা গানের দলের সদস্য হিসেবে তিনি এসব গান গাইতে ও নাচতে পারতেন। মহররমের সময় তিনি বিভিন্ন গ্রামে তার ছোট চাচা মাহির উদ্দিনের সংগে ঝাণ্ডির গান গাইতে এবং লাঠি ও ছোরাখেলার প্রদর্শনী করতে বিভিন্ন স্থানে যেতেন। তাদের এই দলটিকে পরিচালনা করতেন এমাজউদ্দিন কাপুড়িয়া নামে তার একজন আত্মীয়। এসব গান ও খেলার প্রদর্শনীতে অংশ নিতে তিনি দলীয় সদস্য হিসেবে মালদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কিষণগঞ্জ, কাটিহার ও অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন জায়গায় দেশ ভাগের পূর্বে ও পরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সর্বশেষ তিনি ঐতিহ্যবাহী হরিপুরের মেলায় ১৯৬৮ সালের দিকেও লাঠিখেলায় অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি ভাওয়াইয়া, মুর্শিদী ও মারফতি গান গাইতে পারতেন।

শৈশবে তিনি ভালো মানের সাতারু এবং দক্ষ ডুবুরী ছিলেন। পাগলা, মহানন্দা এবং পদ্মানদীর খুব কাছাকাছি অঞ্চলে বড় হবার কারণে তিনি দক্ষ সাতারু হিসেবে বেড়ে ওঠেছিলেন। কৈশোর ও তারুণ্যে তিনি সাঁতারে সকলকেই পরাজিত করতে পারতেন এবং সেই দক্ষতা উনিশ শতকের ষাটের দশক পর্যন্ত ধরে রেখেছিলেন। পানিতে ডুবে যাওয়া মানুষকে উদ্ধারে তিনি খুবই দক্ষ ছিলেন। চাপাইনবাবগঞ্জের পাগলা, দক্ষিণ দিনাজপুরের পুনর্ভবা এবং ঠাকুরগাঁওয়ের গন্দর নদীতে এবং এতদঞ্চলের স্থানীয় পুকুরে ডুবে যাওয়া মানুষ ও লাশ উদ্ধারে তাঁর দক্ষতা বহুলভাবে প্রশংসিত ছিল।

অভিবাসনকালীন সাবের আলী

১৯৪০ পরবর্তীতে মহানন্দা নদী গর্ভে যখন জমিজায়গা বিলীন হয়ে যাচ্ছিল তখন স্বপরিবারে কিছু জমি বিক্রি করে দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটরে কারদাহা থানার নওগাঁ নানী বাড়ী ও সুখদেবপুর নিজ গ্রামের বাড়ীর অংশসহ চল্লিশ বিঘা জমিতে কৃষি কাজ শুরু করেন। কিন্তু ১৯৪৫ সালে পিতা তাহের উদ্দীন দুরারোগ্য ব্যাধিতে মারা যাবার প্রেক্ষিতে এবং দেশভাগের কারণে শিক্ষিত মুসলমানেরা পূর্ব পাকিস্তানে আসা শুরু করলে তিনিও সপরিবারে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন।

সাবের আলী পরিবারসমেত ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার হরিপুর থানার দামোল গ্রামে প্রথম জঙ্গল উচ্ছেদ করে বসতি স্থাপন করেন। অত্যন্ত পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল ও অধ্যবসায়ী হবার কারণে তিনি কৃষিকাজেও দ্রুত সফলতার মুখ দেখেন। ১৯৪৯-৫০ সালের দিকে তার পরিবারের লোকজনের সহায়তায় এবং তার মা আসমা খাতুনের ঐকান্তিক ইচ্ছাতে বীরগড় দারুল উলুম খারেজী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা এই মাদ্রাসায় ৫ বিঘা জমি দান করেন।

সাংগঠনিক দক্ষতা

সাবের আলী বাড়ীর পাশের মুন্সিগঞ্জ হাটের সম্প্রসারণে ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাড়ীর পাশে একটি মসজিদ এবং বাড়িতে বৈঠকখানা তৈরি করেন যা সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিলো। রাজনৈতিকভাবে সচেতন এই মানুষটি কৃষক প্রজা পার্টির অনুরাগী ছিলেন এবং গানের দল গড়তে গিয়ে যে সাংগঠনিক দক্ষতা অর্জন করেন তা কৃষি, ব্যবসা ও শিক্ষা সম্প্রসারণে কাজে লাগান।

তিনি ১৯৪৮ সনের দ্বিতীয় ভাগে আলহাজ্ব নূর হেসেনের প্রথম কন্যা শাহেরা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পঞ্চাশের দশকজুড়ে দম্পতিদ্বয় মাতা আসমা খাতুনের প্রেরণায় বীরগড় মাদ্রাসার বহু ছাত্র শিক্ষকদের সাহায্য সহযোগিতা ও অনুদান দিতে গিয়ে শিক্ষানুরাগী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে নিজগ্রামে শিহিপুর মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে অবদান রাখেন।  তাদের বাড়িতে জায়গীর হিসেবে থেকে বহু ছাত্র লেখাপড়া করেছেন।

পেশাগত জীবনে সাবের আলী

দুর্ভাগ্যবশত দম্পতিদ্বয় থ্যালাসেমিয়ার বাহক হওয়ায় তাদের বড় সন্তান লুৎফর রহমান ১৯৬৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত বড় সন্তান লুৎফর ১৫ বছর জীবিত ছিলেন। সাবের আলী বড় ছেলেকে নিয়ে বিভিন্ন প্রকার ভোজ্য তৈল, পেট্রোলিয়ামজাত তৈল, বেকারী আইটেম, দেশী-বিদেশী ফল এবং ধান চাউলের পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই ব্যবসা পঞ্চাশ-ষাটের দশকে চালিয়ে আর্থিক উন্নতি লাভ করেন এবং প্রয়োজনীয় ভূসম্পত্তির মালিক হন।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে পুনরায় বালুরঘাটের সুখদেবপুর গ্রামে গমন করেন এবং সেখানেও কর্মী এই মানুষটি দুই বছর স্বল্প পরিসরে সন্তানদের নিয়ে ব্যবসা করেছেন। ১৯৭৩ সালের দিকে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। বাংলাদেশকালীন ১৯৭৪-৭৫ সালের দুর্ভিক্ষ-মঙ্গায় জমি ও অলংকার বিক্রি করে খেতে হয়েছে। যুদ্ধ পরবর্তী অভাবের সময়ে বড় আকারে ব্যবসা করা তার দ্বারা সম্ভব না হলেও স্বল্প পরিসরে আশির দশকেও ব্যবসা চালিয়ে গেছেন এবং কৃষিকাজ করেছেন।

সাবের আলীর অদম্য ইচ্ছা ছিল প্রতিটি সন্তানকে শিক্ষিত করে তোলা। তার চারটি সন্তানকেই তিনি বীরগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রণহাট্টা চৌরঙ্গী উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করিয়েছেন। বড় সন্তান আবদুল ওদুদের উচ্চশিক্ষা ও অন্যান্য সন্তানদের শিক্ষার ব্যয় নির্বাহ করার সমস্যা ও ব্যবসায়িক মন্দায় তার স্বচ্ছলতা কমতে থাকে। তদুপরি তিনি আশপাশের স্কুল ও মাদ্রাসার সকল শিক্ষকদেরকে সহমর্মিতার বন্ধনে জড়িয়ে রেখেছিলেন।

১৯৯০ পরবর্তী সময়ে তার আর্থিক মানসিক চাপ বাড়তে থাকে। ১৯৯২ সালে তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন এবং প্রায় পনের দিন হরিপুর হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। ম্যালেরিয়া থেকে তিনি পুরোপুরি আরোগ্য হননি। পরবর্তীতে প্রোস্টেট সমস্যা ও ভাইরাসজনিত সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ছয় মাস রোগ ভোগের পর ১৯৯২ সালের ২১ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার দামোল গ্রামের নিজ বাড়িতে রাত সাড়ে আটটায় মারা যান।

Leave a Comment

error: Content is protected !!