রবার্ট ওয়েন (১৪ মে, ১৭৭১ – ১৭ নভেম্বর, ১৮৫৮, ইংরেজি: Robert Owen) ছিলেন ইংরেজ সমাজ সংস্কারক, মানবতাবাদী এবং কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র, ট্রেড ইউনিয়ন ও সমবায় আন্দোলনের আদি প্রবক্তাদের একজন। তিনি কারখানার কাজের অবস্থার উন্নতির জন্য চেষ্টা করেছিলেন, পরীক্ষামূলক সমাজতান্ত্রিক সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং শিক্ষার সরকারী নিয়ন্ত্রণসহ শিশু লালন-পালনের জন্য আরও যূথক্রিয়াশীল পদ্ধতির সন্ধান করেছিলেন। [১]
স্কটল্যান্ডের নিউ লানার্ক নামক স্থানে তাঁর একটি কাপড়ের মিল ছিল; সেটিকে তিনি তাঁর সমাজতন্ত্রী ভাবনার পরীক্ষা নিরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে স্থানীয় শ্রমিকদের নিয়ে একটি আদর্শ শিল্পনগরী গড়ে তোলেন; একদিকে তাতে তিনি শ্রমিকদের সর্ববিধ সুযোগসুবিধা দেন, অন্যদিকে তার পিছনে তাঁর মুনাফার লক্ষ্য ছিল সীমিত।[২]
রবার্ট ওয়েনের জন্ম একটি সাধারণ কারিগর পরিবারে। কিশোর বয়স থেকেই ওয়েন নিজের জীবিকা নিজে উপার্জন শুরু করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি বৃহৎ আকারে পুঁজিবাদী শিল্প প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার দায়িত্বও পালন করেন।[৩]
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শোষণ এবং অসঙ্গতির বিষয়ে রবার্ট ওয়েনের গভীর এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল। এক্ষেত্রে তিনি অন্যান্য কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদী চিন্তানায়কদের থেকে পৃথক ছিলেন। শিল্পবিপ্লবে জাত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকদের অমানুষিক শোষণকে ওয়েন তীব্রভাবে সমালোচনা করেন। শ্রমিকদের জন্য তাঁর সহানুভূতি এবং দরদ ছিল আন্তরিক। এই মনোভাব থেকে শোষিত শ্রমিকের মঙ্গলের জন্য তিনি নানা দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার চেষ্টা করেন এবং মানবতাসূচক কারখানা আইনেরও তিনি উৎস ছিলেন।[৩]
রবার্ট ওয়েন বুঝতে পেরেছিলেন এই শোষণের মূলে আছে সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা। ধর্ম এ শোষণকে সমর্থন করে। এ কারণে ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং ধর্ম উভয়েরই তিনি সমালোচনা করেন। বুর্জোয়া বিবাহ প্রথারও তিনি বিরোধী ছিলেন। রবার্ট ওয়েন ছিলেন যুক্তিবাদী এবং নিরীশ্বরবাদী।
মানুষের চরিত্র র্নিধারণে প্রধান ভূমিকা হচ্ছে সমাজ ব্যবস্থার। সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ব্যতীত শোষকের চরিত্র পরিবর্তন করা কিংবা শোষিতকে শোষণমুক্ত স্বাধীন সৃজনশীল মানুষে পরিণত করা সম্ভব নয়। কিন্তু এখানে প্রশ্ন উঠে: সমাজের পরিবর্তন কিভাবে সংঘটিত হবে? বিপ্লবের মাধ্যমে না মহৎ শিক্ষার ফলে? ওয়েন শ্রমিক দরদি হয়েও সামাজিক ব্যবস্থা পরিবর্তনে বিপ্লবের ভূমিকা অনুধাবন করতে পারেননি। তাঁর মতে শিক্ষাই হচ্ছে সামাজিক পরিবর্তন সাধনের মূল উপায়। ধনিক যে শ্রমিককে অন্যায়ভাবে শোষণ করে তার প্রধান কারণ সে তার এই অন্যায় সম্পর্কে অজ্ঞ। মহৎ শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে ন্যায় অন্যায়ের নতুন নীতিবোধ তৈরি করতে হবে। শিক্ষাকে পরিবর্তনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে ওয়েন প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক নতুন ভাব প্রবর্তন করার চেষ্টা করেন।
রবার্ট ওয়েন বিশ্বাস করতেন যে ন্যায্য মজুরি ও শ্রমিকদের কাজের উপযুক্ত সুবিধাদি দিলে পরিণামে সেটা ব্যবসায়ী সাফল্যের পক্ষে সহায়ক হয়। কাজের সঙ্গে সমাজ জীবনেরও চাই সামঞ্জস্য । সেই দৃষ্টিতে নিজের কারখানায় শ্রমিকদের যথোচিত শিক্ষার সংস্থান ও কল্যাণ বিধান করেন। উৎপাদনে ব্যক্তিগত মালিকানার বিরোধী না হলেও বন্টন ও বিনিময়ে তিনি সামাজিক মালিকানার পক্ষপাতী ছিলেন।[২]
১৮১৯ খ্রি তাঁর উদ্যমে কারখানা আইন বিধিবদ্ধ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা রাজ্যে নিউ হারমনি নামে একটি সমবায় সমাজ তথা কমিউনিস্ট উপনিবেশ স্থাপন করেন (১৮২৫)। সেই সঙ্গে তাঁর উদ্যোগে একটি শ্রমিক ইউনিয়নও গঠিত হয়।[২]
শোষণমুক্ত ভবিষ্যৎ জগৎ কল্পনা করে ওয়েন বলেন যে, ভবিষ্যতে কোনো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থাকবে না। মানুষের সমাজ হবে তিন শত থেকে দু হাজার সংখ্যার এক একটি স্বায়ত্বশাসিত জনসমাজের স্বেচ্ছা সম্মেলন। কল্পলৌকিক সমাজবাদী চিন্তানায়কদের মধ্যে ওয়েনের মতো শ্রমিক ও সমবায়ী আন্দোলনের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী চিন্তাবিদের সাক্ষাৎ খুব কমই মিলে। শ্রমিক শ্রেণীর ঐতিহাসিক ভূমিকা যথাযথভাবে অনুধাবনে অক্ষম হলেও রবার্ট ওয়েন সব সময়ই শ্রমিক আন্দোলনের অবিচেক সমর্থক ছিলেন।[৩] কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ওয়েনের সমাজতন্ত্রী ভাবনা ও ক্রিয়াকলাপকে স্ববিরোধী ও কল্পনাপ্রবণ। হিসেবে অভিহিত করেন।
চিত্রের ইতিহাস: লেখায় ব্যবহৃত চিত্রটি রবার্ট ওয়েনের কাল্পনিক রাজ্য ঐকতাননের অংকিত চিত্র, চিত্রকর F. Bate
তথ্যসূত্র:
১. অনুপ সাদি, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮, “রবার্ট ওয়েন কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র, ট্রেড ইউনিয়ন ও সমবায় আন্দোলনের আদি প্রবক্তা”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/robert-owen/
২. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৬১-৬২।
৩. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ৩০০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।