রাসবিহারী বসু (ইংরেজি: Rash Behari Bose, ২৫ মে ১৮৮৬ – ২১ জানুয়ারী ১৯৪৫) ছিলেন আধুনিক বর্বর ব্রিটিশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একজন ভারতীয় বিপ্লবী নেতা। তিনি গদর বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন, পরে সুভাষ চন্দ্র বসুর কাছে ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী হিসাবে এটিকে হস্তান্তর করেন।
ইংরাজ রাজত্বের দোর্দণ্ড প্রতাপ পুলিস কমিশনার চার্লস টেগার্ট বিপ্লবী রাসবিহারী বসু সম্পর্কে লিখেছিলেন।
“…… Expert in make up. Rashbehari Bose could dress up himself either as a Punjabi or as an old Maharashtrian in such a perfect manner that it was impossible to suspect him as one in disguise.
He would have been a great stage actor instead of a revolutionary if he so desired.”
একজন বিচিত্রকর্মা উদ্যমী বিপ্লবীর পক্ষে বিভিন্ন ছদ্মবেশের আড়ালে নিজেকে গোপন করার দক্ষতা নিঃসন্দেহে তার কর্মকুশলতার প্রমাণ।
বস্তুতঃ রাসবিহারী ছিলেন বিপ্লবীর বিপ্লবী। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে।
পবাধীন জাতির স্বাধীনতা ব্যতিরেকে অপর কোনো ধর্ম থাকতে পারে না, স্বামী বিবেকানন্দের এই বাণী পরাধীন ভারতের তরুণ সমাজকে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার প্রেরণা জাগিয়েছিল। বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে তারা দলে দলে দীক্ষা নিয়েছিলেন।
রাসবিহারীর জন্ম ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে মে। তার পিতার নাম বিনোদবিহারী বসু। রাসবিহারীদের আদি নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার সুবলদহ গ্রামে। তার পিতামহ কালীচরণ বসু সেকালের একজন বিখ্যাত লাঠিয়াল ছিলেন। তারই তত্ত্বাবধানে ও শিক্ষায় অল্পবয়সেই রাসবিহারী ব্যায়ামপুষ্ট সুগঠিত দেহের অধিকারী হয়েছিলেন।
বিনোদবিহারী কার্যোপলক্ষে সিমলায় বাস করতেন। তিনি চন্দননগরে ফটক গোড়ায় একটি বাড়ি ক্রয় করে পাকাপাকিভাবে সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। এই সময় তিনি দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করেছিলেন।
সুবলদহ গ্রাম ছেড়ে আসার পরে চন্দননগরে ডুপ্লে কলেজে রাসবিহারীর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। বর্তমানে এই কলেজের নাম কানাইলাল বিদ্যামন্দির। ছাত্র হিসাবে রাসবিহারী ছিলেন মেধাবী। পড়াশোনায় তার ছিল গভীর নিষ্ঠা।
একদিন ইতিহাস ক্লাশে শিক্ষক মশায়ের পড়ানো শুনে রাসবিহারীর মন তার প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠে। ইতিহাসের শিক্ষক বলেছিলেন, মাত্র চোদ্দজন ঘোড়সওয়ার এসে গৌড় রাজের রাজধানী অধিকার করে নিয়েছিল।
রাসবিহারী দাঁড়িয়ে উঠে তৎক্ষণাৎ ইতিহাসের এই বিকৃতির প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, একটি সুরক্ষিত রাজধানী ও রাজপ্রাসাদ মাত্র চোদ্দজন ঘোড়-সওয়ারের পক্ষে কখনওই অধিকার করে নেওয়া সম্ভব নয়। এ তথ্য অসত্য বিকৃত।
এই প্রতিবাদের জন্য রাসবিহারীকে শাস্তি পেতে হয়েছিল। বিরক্ত হয়ে রাসবিহারী স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন। চন্দননগরে থাকা কালেই তিনি প্রখ্যাত বিপ্লবী নেতা চারু রায়ের সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তার ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠেছিল ভারতের স্বাধীনতা। রাসবিহারীকে কলকাতায় নিয়ে এসে মর্টন কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়।
এখানে পড়াশোনা করবার সময়েই একদিন এক অদ্ভুত কান্ড করে বসেন তিনি। সেইকালে বাঙালীদের সেনাবাহিনীতে নেওয়া হতো না। যুদ্ধবিদ্যা শিখবেন বলে রাসবিহারী অভিভাবকদের অনুমতি না নিয়েই গিয়েছিলেন সৈন্যবিভাগে ভর্তি হতে। তার স্বপ্ন ছিল শিবাজীর মত সৈনা দল গঠন করে ইংরাজদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। দেশকে বিদেশী শাসন থেকে মুক্ত করবেন।
সৈন্যবিভাগে ভর্তি হওয়ার জন্য তিনি নিজেকে অবাঙ্গালী বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। ধরা পড়ে গিয়ে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল তাঁকে।
এরপর পিতা বিনোদবিহারী পুত্রকে নিজের কর্মস্থল সিমলায় নিয়ে যান। কিন্তু রাসবিহারী আর পড়াশুনা করতে রাজি হলেন না। বিনোদবিহারী তাকে সিমলার সরকারী প্রেসে কপি হোল্ডারের কাজে ঢুকিয়ে দেন। এখানে কাজ করবার সময় রাসবিহারী ইংরাজি ভাষা ও সেই সঙ্গে টাইপ রাইটিং ও শর্টহ্যান্ড শিক্ষা করেন।
এই সময় কিছু সরকারী গোপন নথিপত্র প্রেসে ছাপা হচ্ছিল। রাসবিহারী সেই গোপন তথ্যের কিছু অংশ স্থানীয় একটি ইংরাজি সংবাদপত্রের দপ্তরে পাচার করে দেন।
সরকারী গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সরকারি মহলে খুব হৈচৈ শুরু হলো। বিনোদবিহারী তার পুত্রকে বিলক্ষণ জানতেন। তিনি প্রেসের কাজ থেকে রাসবিহারীকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলেন।
অল্প কিছুদিন পরেই নিজের উদ্যোগে দেরাদুনের বনবিভাগে একটি চাকরি জোগাড় করে নিলেন রাসবিহারী। | এই কাজ পাওয়ার পর থেকেই বিপ্লবী রাসবিহারীর সত্তা জেগে উঠল। তিনি উত্তর ভারতে বিপ্লবী সংগঠন করার কাজে মনোযোগ দিলেন।
এই সময়ে বাল্যবন্ধু ও বিশিষ্ট বিপ্লবকর্মী শ্রীশচন্দ্র ঘোষ ও প্রবর্তক সংঘের প্রতিষ্ঠাতা মতিলাল রায়ের মাধ্যমে মহাবিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের (বাঘা যতীন) সঙ্গে তার পরিচয় হয়। বাঘা যতীন সেই সময় বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তার পরামর্শক্রমে রাসবিহারী উত্তর ভারতে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার দায়িত্ব নিলেন।
ইতিমধ্যে চাকরিতে পদোন্নতি হয়েছে। সেই সঙ্গে চন্দননগরে চারু রায়ের বিপ্লবী সমিতি সুহৃদ সম্মেলনেও যাতায়াত বৃদ্ধি পেয়েছে। একবার দেরাদুনে ফেবার সময় সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন যুবক বসন্ত বিশ্বাসকে।
বোমা তৈরিতে দক্ষ বসন্তকে তিনি নির্দিষ্ট একটি পরিকল্পনার জন্য গোপনে প্রস্তুত করে তুলতে লাগলেন। রাসবিহারীর সঙ্গে ইতিমধ্যেই কাশীর শচীন সান্যাল, পাঞ্জাবের গদর পার্টির নেতা হরদয়াল, মারাঠী যুবক বিষ্ণু গণেশ পিংলে প্রভৃতি বিপ্লবী নেতার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল। তাঁরা সকলেই রাসবিহারীকে উত্তর ভারতের নেতৃপদে স্বীকার করে নিলেন। তারা তার নির্দেশ মতই কাজ করে চললেন।
পিংলের তত্ত্বাবধানে অল্প সময়ের মধ্যেই উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে লাহোর অমৃতসর, মিরাট, দিল্লী, বোম্বাই (মুম্বই) এবং মাদ্রাজে (চেন্নাই) বিপ্লবী কেন্দ্র স্থাপিত হলো এবং সর্বত্র রাসবিহারীর নেতৃত্ব স্বীকৃত হলো।
রাসবিহারীর বিচক্ষণতায় পুলিসের গোয়েন্দা বাহিনীর অনুরূপ গুপ্তচর বাহিনী বিপ্লবী দলেও সৃষ্টি হলো। তিনি সরকারি কর্মচারীদের সহায়তায় পুলিস বিভাগেও নিজস্ব গুপ্তচর নিয়োগ করতে সক্ষম হলেন।
এযাবৎকাল কলকাতা ছিল সমগ্র ভারতের রাজধানী। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীতে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পাকা ব্যবস্থা হয়ে গেল। এই উপলক্ষে ২৫শে ডিসেম্বর চাদনি চকের রাস্তা ধরে বিরাট শোভাযাত্রা সহকারে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ দিল্লিতে প্রবেশ করবেন ঘোষণা করা হলো। বাসবিহারী পরিকল্পনা ছকে ফেললেন। হাতির পিঠে দিল্লিতে প্রবেশের মুখেই হার্ডিঞ্জকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে হবে। ইংরাজকে এভাবে একটি শক্ত আঘাত করে বুঝিয়ে দিতে হবে ভারতে তাদের দিন শেষ হয়ে এসেছে।
নির্দিষ্ট দিনে রাসবিহারী নীরবকর্মী আমীর চাদের সহায়তায় বসন্ত বিশ্বাসকে বোরখা পরিয়ে চাদনিচকে মেয়েদের দলে মিশিয়ে রাখলেন।
যথাসময়ে ভাইসরয়ের শোভাযাত্রায় বসন্তের ছোঁড়া বোমা ফাটল। হার্ডিঞ্জ বোমার আঘাতে আহত হলেন। ভিড়, হৈ-হট্টগোল, জনতার দৌড়াদৌড়ির মধ্যে বসন্ত ও রাসবিহারী সাবলীলভাবে গা-ঢাকা দিলেন। রাসবিহারী নির্বিঘ্নে কর্মস্থল দেরাদুনে ফিরে গেলেন। তিনি ছিলেন সরকারি কর্মচারী এবং তাঁর চালচলন কথাবার্তা ছিল সমস্ত সন্দেহের ঊর্ধ্বে।
বিপ্লবীদের ধরবার জন্য ইতিমধ্যে আধুনিক বর্বর সন্ত্রাসবাদী ইংরাজ সরকার চারদিকে ধরপাকড় শুরু করেছে। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে গোয়েন্দার দল। তাদের অনুসন্ধানের ফলে জানা গেল চাদনিচকের বোমা বিস্ফোরণের নায়ক হলো দেরাদুনের বনবিভাগের কর্মচারী রাসবিহারী বোস।
রাসবিহারী বিপদের আঁচ আগেই পেয়ে গিয়েছিলেন। তিনি রাতারাতি লাহোরে পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করলেন। আর ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন।
প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, পরের বারে যেন ইংরাজ সরকারকে জোর ধাক্কা দেওয়া যায়। ইতিমধ্যে খবর এলো ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ১৭ মে লরেন্স গার্ডেনে ইংরাজ রাজপুরুষদের একটি জরুরী সভা বসবে।
এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না রাসবিহারী। ইংরাজ রাজপুরুষদের নির্মম অত্যাচারে সাধারণ মানুষ জর্জরিত। এবারে সব কজনকে একসঙ্গে খতম করার পরিকল্পনা নিতে হবে।
যথাসময়ে বসন্ত বিশ্বাসকে টাইম বোমা দিয়ে সার্কিট হাউসে পাঠিয়ে দিলেন। বসন্ত নিখুঁতভাবে রাস্তার ওপর বোমা পেতে রাখল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে অসময়েই বোমাটি বিস্ফোরিত হয়ে সাইকেল আরোহী এক দারোয়ান মারা গেল। বসন্তু পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও পরে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায়।
পুলিশ এবারে আরো তৎপর হয়ে উঠল। তারা মরিয়া হয়ে রাসবিহারীকে খুঁজে বেড়াতে লাগল। সারাদেশে রাসবিহারীর নামে পোস্টার ছড়িয়ে দেওয়া হলো। যে কেউ এই রাজদ্রোহী বিপ্লবীকে পুলিসের হাতে ধরিয়ে দেবে কিংবা তার অবস্থানের সংবাদ দিতে পারবে তাকে ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।
আত্মগোপন করে থাকলেও রাসবিহারী নিপুণ ছদ্মবেশের আড়াল নিয়ে নির্ভয়ে জনতার মধ্যে ঘুরে বেড়াতেন। নানা সময়ে নানা বেশ নিতেন তিনি।
ইংরাজি বা বাংলা ছাড়াও হিন্দি, গুরুমুখী, মারাঠি, গুজরাতি ও উর্দু ভাষায় চোস্ত ছিলেন তিনি। ফলে বেশ পাল্টে পুলিসের চোখে ধুলো দিতে তার কোনো অসুবিধা হতো না। এজন্য তাকে বিস্তর ছদ্মনাম গ্রহণ করতে হয়েছিল।
বিপ্লবী সহকর্মীরাও অনেকেই রাসবিহারীর আসল নাম জানতেন না। পাঞ্জাবে ও উত্তর ভারতে অধিকাংশ স্থানে তিনি দরবারা সিং ও সতীশচন্দ্র নামে পরিচিত ছিলেন।
তার একটি ছদ্মবেশের কথা শুনলেই বোঝা যাবে এ ব্যাপারে রাসবিহারীর দক্ষতা কি পর্যায়ের ছিল। একবার কলকাতায় পুলিশ গোপন সূত্রে খবর পেল রাসবিহারী বেলেঘাটায় একটি ঘাঁটিতে আসবেন।
বিপ্লবীদের এই ঘাঁটি আগে থেকেই পুলিসের নজরে ছিল। এবারে সেখানে নিচ্ছিদ্র জাল পাতা হলো। যাতে পুলিসের হাত এড়িয়ে একটি মাছিরও পালাবার উপায় না থাকে।
যথাসময়ে রাসবিহারীর সন্ধানে বিপ্লবীদের ঘাঁটি ও আশপাশের অঞ্চলে পুলিসের চিরুণী তল্লাসী শুরু হলো। পুলিস হন্যে হয়ে খুঁজল, কিন্তু কোথায় রাসবিহারী। অথচ পাকা খবর ছিল তিনি ঘাঁটিতে প্রবেশ করেছেন।
ব্যর্থ হয়ে পুলিশ বাহিনী ফিরে গেল সেই সময় তাদের অনেকেরই চোখে পড়ল রাস্তার পাশের একটি বাড়ির বারান্দায় বসে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বৃদ্ধ আপন মনে বেহালা বাজিয়ে চলেছে। ঝানু গোয়েন্দা কর্তাদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়নি যে এই শ্মশ্রুধারী বৃদ্ধ বেহালা বাদক বিপ্লবী রাসবিহারী। মহাবিপ্লবী রাসবিহারী এমনি সুকৌশলে অসংখ্যবার পুলিসকে বোকা বানিয়েছেন।
ভারতবর্ষে অসংখ্য বিপ্লবী সংগঠন ও বিপ্লবী ক্রিয়া কর্মের সংগঠক, বহু স্বনামধন্য বিপ্লবীর স্রষ্টা রাসবিহারী এমনই এক ব্যক্তি যাকে সর্বশক্তি নিয়োগ করেও ব্রিটিশ রাজশক্তি কোনো দিন গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়নি। পৃথিবীর বিপ্লবীদের ইতিহাসে এ ঘটনার কোনো নজির নেই।
আন্ডার গ্রাউন্ডে থেকে রাসবিহারী বিভিন্ন বিপ্লবী কর্মসূচী চালিয়ে যেতে লাগলেন। ইতিমধ্যে ইউরোপ জুড়ে শুরু হয়ে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ইংরাজের শাসনাধীন ভারতবর্ষেও তার তপ্ত আঁচ পড়ল। ওই সঙ্কটকালকে রাসবিহারী তাঁর বৃহত্তর পরিকল্পনা রূপায়ণের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করলেন।
দেশব্যাপী সশস্ত্র বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা নিয়ে তিনি ভারতীয় সিপাহীদের মধ্যে সুকৌশলে ইংরাজ বিদ্বেষ ও স্বাজাতাবোধ প্রচার আরম্ভ করলেন। একাজে তার সহযোগিতায় এগিয়ে এলেন বিপ্লবী নেতা পিংলে, হরদয়াল, শচীন সান্যাল, যতীন্দ্রনাথ মুখার্জী এবং নরেন ভট্টাচার্য তথা এম. এন. রায়।
দূর্ভাগ্যবশত কয়েকজন দেশদ্রোহীর বিশ্বাসঘাতকতায় রাসবিহারীর এই ব্যাপক কর্মসুচী মাঝপথেই বানচাল হয়ে গেল। পরিণামে বহু সংখ্যক দেশপ্রেমিক সিপাহী ও বিপ্লবীকে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হলো। বহু সিপাহীকে কারাদন্ডে দন্ডিত করা হলো। কার্তার সিং, বিষ্ণু গণেশ পিংলে, হরনাম সিং প্রভৃতির ফঁসি হলো।
এবারে কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করে রাসবিহারী চলে এলেন বাংলায়। বিপ্লবীর অভিধানে তো ব্যর্থতা বলে কথা নেই। তিনি নতুন ভাবে পরিকল্পনা শুরু করলেন।
এদিকে পুলিস পাগলা কুকুরের মত ভারতবর্ষ জুড়ে রাসবিহারীর সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার ছদ্মবেশ ধারণের অসাধারণ ক্ষমতার কথাও আর তাদের অজানা নয়। এই অবস্থায় রাসবিহারীর গতিবিধি আশঙ্কাজনক হুয়ে উঠল। তার সহযোগী বন্ধুরা তাকে অবিলম্বে দেশত্যাগ করে জার্মানি বা অন্য কোন স্বাধীন দেশে চলে যাবার পরামর্শ দিলেন। তিনিও তাদের পরামর্শ গ্রহণ করে বিদেশের মাটিতে কর্মক্ষেত্র প্রসারিত করবার উদ্যোগ গ্রহণ করলেন।
এই সময় রবীন্দ্রনাথ জাপানে যাচ্ছেন বলে খবরের কাগজে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। ঠাকুর পরিবারের সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর উদ্যোগী হয়ে রাসবিহারীর পাশপোর্টের ব্যবস্থা করে দিলেন। পি, এন, ঠাকুর নামে রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারী হিসাবে তার পরিচয় জানানো হলো। কবির বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থাদি তদারক করবার জন্য তিনি জাপান যাচ্ছে।
নির্দিষ্ট দিনে ‘শনুকি-মারু’ নামে একটি জাপানি জাহাজে প্রথম শ্রেণীর কেবিনে যাত্রী হিসেবে স্থান নিলেন রাসবিহারী। ইতিমধ্যে কলকাতার পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টের কাছে খবর পৌঁছে গেল বিপ্লবী রাসবিহারী জাপানি জাহাজে চেপে দেশত্যাগ করছেন।
সংবাদ পাওয়া মাত্র তিনি একদল সশস্ত্র সিপাহী নিয়ে জাহাজ ছাড়বার মুখে সেখানে এসে পৌঁছলেন। রাসবিহারী ছদ্মনামে জাহাজে আছেন ভেবে তিনি ক্যাপ্টেনের অনুমতি নিয়ে যাত্রীদের তল্লাসী শুরু করলেন। এক সময় টেগার্ট সাহেব পি. এন. ঠাকুরের কেবিনের সামনে এসে হাজির হলেন। রবীন্দ্রনাথের তথাকথিত সেক্রেটারিটি তখন বই পড়তে পড়তে খোস মেজাজে সিগারেট টানছেন।
প্রথমত ঠাকুর পদবী তার ওপরে খোদ কবি রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারি, কাজেই টেগার্ট আর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কেবিনে ঢোকার প্রয়োজন বোধ করলেন না। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে জাহাজ থেকে নেমে গেলেন।
জাপানে কাবে বন্দরে অবতরণ করে রাসবিহারী চিনের নেতা সান-ইয়াৎ সনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। পরে তিনি ভারতের নির্বাসিত নেতা লালা লাজপৎ রায় ও বিপ্লবী হেরঙ্গলাল প্রমুখের সঙ্গে মিলিত হলেন।
এই সময় জাপানের সুবিখ্যাত সোমা পরিবারের এক মন্ত্রিকন্যা তোসিকো রাসবিহারীকে একটি গোপন আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রাসবিহারী জাপ কন্যা তোসিকোকে বিবাহ করেন এবং পরে জাপানের ব্ল্যাক ড্রাগন সোসাইটির সহায়তায় জাপানের নাগরিকত্ব লাভ করেন।
জাপানে থেকেই তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যেতে লাগলেন। প্রতিষ্ঠা করলেন টোকিও ইণ্ডিয়ান লিগ। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর মাসে তিনি সাংহাইয়ের এক চীনার সাহায্যে বহু পিস্তল ও টোটা ভারতের বিপ্লবীদের জন্য প্রেরণ করেন। ব্রিটিশ পুলিস তৎপর হয়ে উঠলে এরপর আট বছর তাকে আত্মগোপন করে থাকতে হয়।
ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে জাপান মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। রাসবিহারীও একটি শক্তিশালী সৈন্য বাহিনী গঠন করে ইংরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে মার্চ তিনি টোকিওতে ভারতীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের একটি সভা আহ্বান করলেন। উক্ত সভায় স্থির হয় যে, জাপানের অধিকৃত সমস্ত স্থানের ভারতীয় অধিবাসীবৃন্দকে নিয়ে ভারতীয় স্বাধীনতা সংস্থা বা আজাদ হিন্দ সঙ্ঘ (Indian Independence league) গঠন করা হবে।
এই উদ্দেশ্যে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জুন ব্যাঙ্ককে একটি বিরাট সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সম্মেলনে আজাদ হিন্দ সংঘ গঠিত হয়। রাসবিহারী এই সঙ্ঘের সভাপতি পদে বৃত হন। ক্যাপ্টেন মোহন সিং আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাপতি পদে নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনে গৃহীত ৩৫টি প্রস্তাবের মধ্যে একটিতে সুভাষচন্দ্র বসুকে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় আগমনের জন্য আহ্বান জানানো হয়।
বলাবাহুল্য ইতিপূর্বে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই ডিসেম্বর গৃহে অন্তরীন অবস্থা থেকে পুলিসের সতর্ক প্রহরা ভেদ করে সুভাষচন্দ্র গোপনে ভারতবর্ষ ত্যাগ করে মস্কো হয়ে বার্লিনে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং অস্থায়ী ভাবে স্বাধীন ভারত সরকারের সূচনা করেছিলেন। ইউরোপে তিনি ফ্রিস ইণ্ডিয়ান বা আজাদ হিন্দ বাহিনী পত্তন করেছিলেন। সেই সময় তার সৈন্যবাহিনীতে মাত্র দেড় হাজার সৈন্য ছিল।
ব্যাঙ্কক সম্মেলনের পরে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে শেষভাগে রাসবিহারী বার্লিনে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে ফোনে আলাপ করেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ২রা জুলাই সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুরে উপস্থিত হন এবং ৪ঠা তারিখে রাসবিহারী তার হাতে আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব অর্পণ করেন। পরে আজাদ হিন্দ সরকার গঠিত হলে তিনি মন্ত্রিসভার সর্বোচ্চ পরামর্শদাতার পদ গ্রহণ করেন।
১৯৪৫ খ্রিস্তাব্দে সমগ্র এশিয়ার মহান বিপ্লবী নেতা রাসবিহারী বসু টোকিওতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
রাসবিহারী ভারতবর্ষ সম্পর্কে জাপানী ভাষায় পাঁচখানি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ডাঃ স্যান্ডারল্যান্ডের ইণ্ডিয়া-ইন বন্ডেজ গ্রন্থ জাপানী ভাষায় অনুবাদ করেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে জাপ সরকার সেদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতীয় পুরস্কার The second order of the merit of the rising sun রাসবিহারীকে প্রদান করে সম্মানিত করেন। আমাদের দেশে বিপ্লবী মহানায়ক রূপে তিনি ভারতবাসীর হৃদয়ে শ্রদ্ধার আসনে চির জাগরুক রয়েছেন।
তথ্যসূত্র
১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৯৯৫-১০০২।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।