রণজিৎ মল্লিক (জন্ম: ৫ এপ্রিল, ১৯৭৭) বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সৃজনশীল এবং মননশীল ধারার কবি ও প্রাবন্ধিক। তাঁর কবিতায় রাজনীতি, প্রকৃতি ও ব্যঙ্গ রচনার মিশ্রণ দেখা যায়। সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ করে তিনি যেমন সমাজের অসংগতি ও অন্যায্য বিষয়গুলোকে কবিতায় তুলে ধরেছেন, তেমনি রাজনীতিকে কবিতায় বিষয় হিসেবে তুলে ধরতেও দক্ষতা ও মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থার প্রতি ধিক্কার দিয়েছেন তিনি কবিতার মাধ্যমে।
রণজিৎ মল্লিক ১৯৭৭ সালে বর্তমান বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলাধীন কোটালীপাড়া উপজেলাস্থ রামশীল ইউনিয়নের কাফুলাবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শ্রী রাজ্যেশ্বর মল্লিক এবং মাতা শ্রীমতি হেমলতা মল্লিক। রণজিৎ মল্লিক কৃতিত্ত্বের সঙ্গে ১৯৯৩ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৯৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর তিনি ১৯৯৫-৯৬ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৯৯ সালে তিনি ইংরেজী সাহিত্যে বিএ এবং ২০০০ সালে এম এ ডিগ্রী লাভ করেন। বর্তমানে তিনি গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাহমিমা আনামের উপন্যাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী পরিস্থিতি বিষয়ে পিএইচডিতে গবেষণারত। তিনি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করেন ২০০৮ সালে। বর্তমানে তিনি সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত রয়েছেন সরকারী ব্রজমোহন কলেজের ইংরেজী বিভাগে।[১]
রণজিৎ মল্লিক লিখেছেন সামাজিক বিষয়ে
রণজিৎ মল্লিক সৃজনশীল এবং মননশীল ধারার লেখালেখিতেই নিজেকে সম্পৃক্ত রাখছেন। সমকালীন সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির সঙ্গে তাঁরঅভিনিবেশ রয়েছে ইতিহাসের প্রতি। উনিশ ও বিশ শতকের বাংলার সমাজ-রাজনীতি নিয়ে তিনি অনুসন্ধিৎসু। বর্তমানে তিনি পিএইচডি গবেষণা করছেন তাহমিমা আনামের উপন্যাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী পরিস্থিতি বিষয়ে।
রণজিৎ মল্লিকের প্রথম কবিতার বইয়ের নাম অপ্রেম অথবা দ্রোহের আকাল। বইটি ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার একুশে বইমেলাতে ‘জাগৃতি’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। বইটিতে মোট কবিতা আছে ৪৩টি। বইটির পরিশিষ্ট অংশে কবি নিজেই ‘কবি ও কবিতা প্রসঙ্গে’ শিরোনামে ৬ পৃষ্ঠার একটি আলোচনা সংযুক্ত করেছেন। ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হবার কারণে তিনি কবিতা বিষয়ক বিশ্লেষণে যে এগিয়ে থাকবেন তা স্বাভাবিক। পদ্যের পাশাপাশি গদ্যের ক্ষত্রেও রণজিৎ মল্লিকের চর্চা চলমান রয়েছে। তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে লোকায়ত, একবিংশ, ধানসিড়ি, কালি ও কলম উল্লেখযোগ্য। ইংরেজি সাহিত্যের নানা বিষয়ে রণজিৎ মল্লিকের নিজস্ব অবলোকন রয়েছে।
বিশ্বের পুঁজিবাদী বর্বর রাষ্ট্রব্যবস্থা জনগণকে উন্মূল করে দিয়েছে। শেকড়হীন করে দিয়েছে শ্রমিক শ্রেণিকে। কৃষক তার ভিটেমাটি ছেড়ে সেই যে বর্গির হানা দেয়া থেকে পালাতে শুরু করল, তা আর থামেনি। আফ্রিকার কালো মানুষেরা ইউরোপীয় বর্বর পুঁজির দাস হয়ে গেল। পুঁজির মালিক আর সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশবাদী ছাড়া কারো পায়ের তলায় কিছু নেই। কবি লিখেছেন,
আমার পায়রে তলায় ডেকে গেছে রক্তের বান
রণজিৎ মল্লিক, অপ্রেম অথবা দ্রোহের আকাল, জাগৃতি প্রকাশনী, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৯, পৃষ্ঠা ১২
আমার বিক্ষত শরীর জুড়ে ফণিমনসার কাঁটা
হামাগুড়ি দিয়ে জাগে আমার ভেতরে মহাকাল
রনাঙ্গনে এখন আমি শত্রুর মুখোমূখি, একা !
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ কবিকেই শুধু একা করেনি, সবাই একা হয়ে গেছে। কেউ আর নেই লড়াইয়ের মাঠে। আধুনিক কবিতার হতাশা যেন এই কবিতার প্রতি পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। ‘জীবনের উল্টান পাতায় কিছু স্মৃতি আজও করে ধূঁ ধূঁ।’ স্মৃতিরা ধূঁ ধূঁ করে বালুকাবেলায়। প্রেম তবুও মৃত্যুকে পরাজিত করে। জীবন জয়ী হয়। এইসব জীবনের কবিতা, ব্যর্থতার আর হতাশার কবিতা, সব মিলিয়ে আমাদের এই পঁচা সমাজের প্রতিফলন ও তার প্রতি ধিক্কার রয়েছে রণজিৎ মল্লিকের এই কবিতার বইয়ে। আর আছে আশাবাদ ‘সুদূর নভোনীলে!’ হাত পাতা আছে পরস্পরের হাত ধরবার। জয় হোক কবিতার। জয় হোক কবি রণজিৎ মল্লিকের।
তথ্যসূত্র:
১. অনুপ সাদি, ৯ জুন, ২০২০, “রণজিৎ মল্লিক বাংলা ভাষার সৃজনশীল এবং মননশীল ধারার কবি ও প্রাবন্ধিক”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/hatred-or-famine-of-rebelion/
২. কবিতা থেকে নেয়া উদ্ধৃতি ও অন্যান্য বাক্যাংশগুলো কাব্যগ্রন্থ অপ্রেম অথবা দ্রোহের আকাল গ্রন্থের ‘এখন আমি’, ‘তবু কিছু প্রেম’ এবং ‘কোন এক নবীনাকে’ কবিতা থেকে নেয়া হয়েছে।
রণজিৎ মল্লিকের পাঁচটি কবিতার আবৃত্তি শুনুন অনুপ সাদির কণ্ঠে
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।