পারুল মুখার্জী ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের নারী বিপ্লবী। অল্প বয়স থেকে পরিবারের মাধ্যমেই রাজনৈতিক বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক কাজের জন্যই বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন। ছোটবেলা থেকে সাংগঠনিক কাজে যুক্ত ছিলেন।
পারুল মুখার্জী-এর জন্ম ও পরিবার:
পারুল মুখার্জী জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলকাতায় ১৯১৫ সালের নভেম্বর মাসে। তার ছোট বোন ঊষা মুখার্জী। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৮ সালে। তাদের পিতা গুরুপ্রসন্ন মুখার্জী, মাতা মনোরমা দেবী। অনুশীলন-দলের বিখ্যাত বিপ্লবী নেতা অমূল্য মুখার্জী ছিলেন তাদের বড় ভাই। পিতৃভূমি তাদের ঢাকা বিক্রমপুরের বাহেরক গ্রামে। কিন্তু বেড়ে ওঠেন কুমিল্লায়।
দাদা অমূল্য মুখার্জীর গভীর প্রভাব ছিল এই পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষের উপর। পারুল ছোটবেলা থেকে দেখেছেন বাড়িতে দাদার জন্য পুলিসের অত্যাচার ও হামলা এবং বিপ্লবী ভাইয়ের অনমনীয় দৃঢ় মনোভাব। এই পারিপার্শ্বিকে মানুষ হবার ফলে একটু বড় হয়েই তারা দাদার অনুগামী হন।
রাজনৈতিক কাজে যুক্ততা:
১৯২৯ সালে কুমিল্লায় একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পারুল ১৪ বছর বয়সে এই সম্মেলনে মেয়েদের নিয়ে কলিকাতা-কংগ্রেসের অনুকরণে একটি স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী গঠন করেন। এরপরে পারুল ‘অনুশীলন সমিতি’তে যোগদান করেন।
পারুল মুখার্জী ১৯৩২ সালে কুমিল্লায় স্বগৃহে অন্তরীণ ছিলেন। ১৯৩৩ সালে আন্তঃপ্রাদেশিক ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে পুলিস তার নামে ওয়ারেন্ট বার করে খোঁজ করতে থাকে। সেই সময়ে তিনি পলাতক হন। তিনি রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, ফরিদপুর, কুমিল্লা, বরিশাল, খুলনা প্রভৃতি স্থানে অনুশীলন-দলের সংগঠন গড়ে তুলতে সাহায্য করছিলেন।
এই সময়ে টিটাগড়ের একটি পল্লীর মধ্যে বিপ্লবীদের বৈপ্লবিক কাজের এক বিরাট আয়োজন চলেছিল। তাদের এখানকার বাসাটিকে সন্দেহমুক্ত রাখবার জন্য পলাতক পারুল মুখার্জীকে খুলনা থেকে টিটাগড়ের বাসায় নিয়ে আসা হয়। তার উপস্থিতিতে বাসাটি সাধারণ গৃহস্থের বাসার রূপ ধারণ করে। সেখান থেকে অনুশীলন-দলের বিপ্লবীরা বোমা বারুদ প্রভৃতি তৈরির ব্যবস্থা করছিলেন। ডিনমাইট এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের বাবস্থাও চলেছিল।
১৯৩৫ সালের ২০ জানুয়ারি ভোর চারটায় অসংখ্য পুলিস টিটাগড়ের বাসাটা ঘিরে ফেলে। টের পেয়েই বিপ্লবী পূর্ণানন্দ দাশগুপ্ত ও শ্যামবিনোদ পাল ভোরের আবছা অন্ধকারের মধ্যে একতলার ছাদ থেকে বাইরে লাফিয়ে পড়লেন। লাফিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা গ্রেপ্তার হন।
পারুল মুখাজীও তাদের সঙ্গে ছাদে উঠেছিলেন। কিন্তু কী যেন মনে করে তিনি উল্টোদিকে লাফ দিয়ে উঠোনে পড়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। পুলিস দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখে এক অগ্নিকুণ্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন পারুল মুখার্জী। তিনি কাগজপত্রগুলি নিশ্চিহ্ন করবার আশায় তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিস অর্ধদগ্ধ কাগজপত্রগুলি হস্তগত করে। সেই বাসাতে পুলিস পায় পিস্তল, বিস্ফোরক পদার্থ, বোমা তৈরির ফরমুলা প্রভৃতি। পারুল মুখাজী গ্রেপ্তার হলেন।
পারুল মুখার্জী-এর জেল জীবন:
পারুল মুখার্জীকে পুলিস-হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে গিয়ে ইতর ভাষায় গালাগালি করেও যখন স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারে নি তখন গোয়েন্দা-অফিসার উৎপীড়নের জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে পারুল মুখার্জীর দিকে ছুটে যায়। পারুল চীৎকার করে জুতা ছুঁড়তে থাকেন। কিন্তু রুখতে পারছিলেন না। এমন সময় চীৎকারে আকৃষ্ট হয়ে আর-একটি গোয়েন্দা-অফিসার ছুটে এসে এই অফিসারকে ধমকাতে যাবেন—“আপনি আপনার পরিণাম বুঝতে পারছেন না আপনার সর্বনাশ হয়ে যাবে।”—পশুটা নিরস্ত হল।
রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধোদ্যমের প্রচেষ্টায় মামলা আলিপুর কোর্টে একটি ট্রাইবুনালের অধীনে আরম্ভ হয়। এর নাম ছিল ‘টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলা’। ১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাসে এই মামলার রায় বেরোয়। মোট ১৭ জনের সাজা হয়। পূর্ণানন্দ দাশগুপ্তের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়, প্রফুল্ল সেনের চৌদ্দ বৎসর, শ্যামবিনোদ পালের দশ বৎসর এবং অন্যান্য অনেকেরই কঠিন শাস্তি হয়। পারুল মুখাজরি তিন বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়।
তাকে নানা জেলে স্থানান্তরিত করা হত। ১৯৩৬ সালে তিনি যখন প্রেসিডেন্সি জেলে ছিলেন তখনকার একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। জেলের নিয়ম হচ্ছে সন্ধ্যাবেলায় বন্দীদের ওয়ার্ডের ভিতরে তালাবন্ধ হতে হবে। একদিন তিনি বিকালবেলা প্রেসিডেন্সি জেলের ক্ষুদ্র ফিমেল-ইয়ার্ডের চত্বরে পায়চারি করছিলেন। তখনো লক-আপ হবার প্রায় আধঘণ্টা-পয়তাল্লিশ মিনিট বাকি ছিল। এমন সময় মেট্রন তার ডিউটি তাড়াতাড়ি সমাধা করতে গিয়ে পারুল মুখার্জীকে তখনই লক-আপ হতে বলে। পারুল মুখার্জী অসময়ে ওয়ার্ডে ঢুকতে অস্বীকার করাতে মেট্রন জোর করে তাকে ওয়ার্ডে ঢোকাতে চেষ্টা করে। তৎক্ষণাৎ পারুল মেট্রনকে করলেন এক চপেটাঘাত। মেট্রন মাটিতে পড়ে গেল। মেট্রনকে মারা ? জেলের জমাদারনী ও লাল-কালো-বিল্লাধারী কয়েদীরা ছুটে এসে পারুল মুখার্জীকে ধরে মাটিতে ফেলে দিয়ে মারতে উদ্যত হল। গোলমাল শুনে অন্যান্য রাজবন্দী মেয়েরা তখনি এসে পড়লেন। তাকে আর মারা হল না। মেট্রনের গায়ে আঘাত করার অপরাধে পারুল মুখার্জীর শাস্তি হল জেল-কোড অনুসারে। বেপরোয়া পারুল এ-সব শাস্তি হেসেই উড়িয়ে দিতেন। ১৯৩৯ সালে গান্ধীজীর প্রচেষ্টায় পারুল মুখার্জী অন্যান্য মহিলা রাজনৈতিক বন্দীদের সঙ্গে মুক্তি পান।
টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলা
বিপ্লবী দলটির নেতা পূর্ণানন্দ দাশগুপ্ত হলেও টিটাগড়ের বিপ্লবী ডেরার প্রকৃত দায়িত্ব ছিল পারুলের উপর। একাধিক ছদ্মনামে তিনি কাজ করেছেন, যা অনেক সময় তার সহকর্মীরাও জানতেন না। যেমন শান্তি, আরতি, শোভারাণী, রাণী, খুকি, সুরমাদেবী ইত্যাদি।
টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলার আসামী ছিলেন পারুল মুখার্জী সহ মোট ৩১ জন। ১৯৩৫ সালের ৩১ অক্টোবর সরকারি আদেশ অনুসারে একটি স্পেশাল ট্রাইবুনাল গঠিত হয়। এই বিচারের জন্যে। এখানে তিনজন বিচারক ছিলেন—এইচ জি এস বিভার, কে সি দাশগুপ্ত এবং এন সি বোস। আসামীদের মধ্যে ২ জন রাজসাক্ষী হন। টিটাগডের গোয়ালপাড়ার আখড়া থেকে বিস্ফোরক ও আগ্নেয়াস্ত্র বাদে পুলিশ কতগুলি বই উদ্ধার করে। বইগুলি হল— (১) Field Gunnery (২) MacRine gunner’s Hand Book (৩) War equipment (৪) Infantry Training (৫) Aeroplane. Constructions. পারুলকে দিয়ে পুলিশ কোনও স্বীকারোক্তি করাতে পারেনি। বাঙালিদের মধ্যে তার বিচার রীতিমত আলোড়ন তুলে দিয়েছিল, বিশেষত নারীদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। উক্ত মামলায় হাইকোর্ট আপিলের উপসংহারে বলেন— No doubt the house of Titagarh was the general head quarters of the conspiracy. Whether or not Purnananda lived there for the whole time or whether or not Shyam Benode was there all time makes no difference as they undoubtedly used it as the heart and centre of the conspiracy during the time it was occupied by Parul” ১৯৩৯ সালে মুক্তি লাভের পর পারুল নিঃসঙ্গ, নীরব জীবন কাটিয়েছেন। ২০ এপ্রিল ১৯৯০ তারিখে তার মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র:
১. কমলা দাশগুপ্ত (জানুয়ারি ২০১৫)। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী, অগ্নিযুগ গ্রন্থমালা ৯। কলকাতা: র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন। পৃষ্ঠা ১৪৪-১৪৬। আইএসবিএন 978-81-85459-82-0
দোলন প্রভা বাংলাদেশের একজন কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও উইকিপিডিয়ান। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। তার জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯ তারিখে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার রেলওয়ে নিউ কলোনিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বাংলাদেশের আনন্দমোহন কলেজ থেকে এমএ সম্পন্ন করেছেন। তিনি ফুলকিবাজ এবং রোদ্দুরে ডটকমের সম্পাদক।