বিশ শতকে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক ধারায় নানা পরিবর্তন এসেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছে। জ্ঞানী, গুণী, বিজ্ঞ, সমাজসেবী, রাজনীতি ও অর্থনীতে অবদানকারী গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়েছে। সেই অবস্থান থেকে শাহেরা খাতুন একজন সাধারণ নারী। তবে তিনি যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেছেন সেই সময়টি ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের পাতায় বিশেষ স্থান দখল করে আছে তখনকার ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায়ও তার প্রভাব পড়েছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অর্ধেক জীবন’-য়ে একটি অংশ লেখা আছে এই বিষয়ে। অন্য দিকে একই সময়ে চলছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। সারা ভারতে অনেক বিপ্লবী লড়ে যাচ্ছেন স্বাধীনতার জন্য; দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা শাসন, শোষণের অবসানের উদ্দেশ্যে।
শাহেরা খাতুনের জন্ম এই সময়ের মাঝেই হয়। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হচ্ছে ঠিক এক বছর পরে। তিনি যুদ্ধের সময়ের কিছুই বুঝতে পারে নি; এমনকি পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় ভারত জুড়ে অনাহার, হাহাকার, দুর্ভিক্ষের যে প্রভাব পড়েছিল সেটাও উনার পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব ছিল না। তবে এর কয়েক বছর পরে বাংলা ভাগ হয়, সেই সময়ে বিভিন্ন ঘটনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাক্ষী ছিলেন।
ব্রিটিশরা নিজেদের শক্তিকে আরো পাকাপোক্ত করার জন্য ভারত জুড়ে ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতিকে নিজেদের ধাঁচে তৈরির জন্য বিভিন্ন চেষ্টা চালায়। এর মধ্যে এক ধরনের মধ্যবিত্তও তারা তৈরি করে; যারা সাধারণ জনগণের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াবে। দেশ ভাগের সময় তেমনটাই ঘটেছিলো কিন্তু আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশরা আর টিকতে পারেনি। এর ফলে সাধারণ মানুষ খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলা ভাগের ফলে পশ্চিম ও পূর্ব বাংলার অনেক পরিবার বিপদের সম্মুখীন হয়। বিশাল সংখ্যক মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে এবং নিজ ভিটে ছেড়ে চলে যায় বেদনাদায়ক স্মৃতি নিয়ে। সেই সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ গণহত্যায় মেতে উঠে। উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক গ্রামে এর তেমন কোনো ঢেউ আসেনি তবে প্রভাব পড়েছিলো পূর্ব বঙ্গ, দক্ষিণ বঙ্গ ও বিহারে।
ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে দুই বাংলা একই ছিলো। কিন্তু ধর্মীয় বিদ্বেষের কাছে এই বন্ধনটিও টিকতে পারে নি। সেজন্য মানুষ জায়গা পাল্টালেও অনেকটা বছর আসা যাওয়া করেছে এপার বাংলা থেকে ওপার বাংলায়। শাহেরা খাতুন বিয়ের কয়েক বছর পরে পূর্ব বাংলা এলেও মালদহে বাবার বাড়িসহ অন্যান্য প্রদেশেও গিয়েছেন। পূর্ব বাংলায় এসে ভাষার জটিলতায় পড়তে হয়। সেই সময় তিনি বুঝতেন ভাষার গুরুত্ব। এজন্য নিজের আঞ্চলিক ও জাতীয় ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ছিলো অগাধ। প্রত্যেকের ভাব, অনুভূতি প্রকাশের জন্য নিজস্ব ভাষা থাকবে এটাই বলতেন তিনি। জোর করে চাপানো বিষয়কে তিনি অনধিকারচর্চা হিসেবেই দেখেছেন। তাই নিজের ভাষাকে শক্তপোক্ত করার জন্য লোক গীতের চর্চা, প্রচার, প্রসার করতেন। যদিও তিনি নিজ অঞ্চলের বাইরে এই কাজ করতে পারেন নি। নিজের গীত, বচন, ছড়া, ধাঁধাকে কোনো লিপিবদ্ধ পুস্তকে আনতে পারেন নি। তবে নিজের অবস্থানে থেকেই চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।
দেশভাগ বা দেশত্যাগের ফলে দুই বাংলায় যে পরিমাণ উদ্বাস্তু হয়েছে, গবেষকরা সেটা পূর্বে ধারণা করতে পারে নি। নিজের ভিটে মাটি, সংস্কৃতি, আত্মার বন্ধন ছেড়ে যখন যেতে হবে সেটা ভাবে নাই। অনেক মধ্যবিত্ত মনে করেছিলো এটা স্বাধীনতার জন্যই হচ্ছে আর সাধারণদের কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিতাড়িত হতে হয় স্বভূমি থেকে। উঠতি মধ্যবিত্ত নিজের জন্য তৈরি করে এক উদ্ভট সীমানা। নিজের পোঁতা তারকাঁটা দিয়ে বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করা গেলেও স্মৃতিকে মুছে ফেলা যায় নি। ফেলে আসা অতীত নিয়ে আত্মার ক্ষরণ বহন করেই চলেছে। শাহেরা খাতুন বেঁচে থাকা পর্যন্ত পশ্চিম বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে নানা কথা বলতেন। নিজের শৈশব, কৈশোরের স্মৃতি ও আত্মীয় স্বজনের ঘটনা স্মরণ করতেন।
গণযুদ্ধকে প্রত্যক্ষভাবে তিনি দেখেছেন। নিজ, পরিবার, প্রতিবেশীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সর্বাত্বক স্বচেষ্ট ছিলেন। সেই সময় দলবদ্ধভাবে টিকে থাকার জন্য লড়াই চালিয়েছেন। আহার, বিশ্রাম, নিরাপত্তার জন্য সংঘবদ্ধভাবে থেকে সকলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চেষ্টা রাখতে হতো। তিনিও সকলের সাথে কাজ করেছেন। রক্ত চোষা বিভীষিকাময় ঘটনাকে নিজ চোখে দেখেছেন। যুদ্ধ শেষে বিধস্ত জনপদে এসে আত্মীয়, স্বজন, প্রতিবেশী হারানোর কষ্ট উনাকে কাঁদিয়েছে। পোড়া ঘরকে আবার নতুন করে বাঁধতে শুরু করেছেন। এইসব ঘটনা উনাকে বেঁচে থাকার সাহস জুগিয়েছে।
বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের মার্চ থেকে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ; সেই বছরের ডিসেম্বরের দিকে গিয়ে শেষ হয়। এই দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা গিয়েছিল। রংপুর অঞ্চল প্রথম মন্দা দেখা যায়। যুদ্ধের পরে আবার শুরু হয় নতুন করে টিকে থাকার লড়াই। ভাতের পরিবর্তে গ্রামে অনেকে গমের রুটি বা আটা সেদ্ধ খেতো। কেউ কেউ সামান্য আটার জন্য দূরদূরান্তে কাজের জন্য যেতো। সামান্য আটা এনে পরিবারের সবাই ঘাঁটি রেঁধে খেতো। সেই সময় তিনি সকলের সাথে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়েন।
দেশ ভাগ থেকে গণযুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ পর্যন্ত যারা দেখেছে তারা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। ভূমিকে ভালোবেসে এইসব মানুষ হেঁটেছেন প্রান্তরে প্রান্তরে। এক ভূখণ্ড থেকে অন্য ভূখণ্ডে। গ্রাম থেকে গ্রামে। এক জেলা থেকে অন্য জেলাতে। সরিষা দানার উপরে পা রেখে চলার মতো চলতে থাকে তারা।
শাহেরা খাতুন বাংলাদেশের অনেক জেলাতে গিয়েছেন। দিনাজপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, নরসিংদী, চাঁদপুর ইত্যাদি। নিজের ভাষা, সংস্কৃতিকে স্পর্শ করে দেখেছেন। দৃঢ় ব্যক্তিত্বের এই মানুষটি সচেতন ছিলেন নিজের অস্তিত্বের জন্য। ভূমি, ভাষা, রাজনীতি, অর্থনীতির এতো ভাঙা গড়া তিনি দেখেছেন যে নিজের স্বরূপ কীভাবে বজায় রাখতে হবে সেটার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। নিজস্ব পোষাক-পরিচ্ছেদ, কারু ও চারু শিল্প, গান, খাবার, আচার ব্যবহার ইত্যাদিকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন। নিজেদের ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন সবার আগে। নিজেকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে না পারলে অপসংস্কৃতি জায়গা দখল করে ফেলবে সেই ভয় তাঁর মাঝে ছিলো। বাংলা ছাড়া অন্য ভাষার নাটক, সিনেমা বা গান তিনি শুনতে পছন্দ করতেন না। এমনটা সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও। তিনি মনে করতেন মন ও স্বত্তাকে দুর্বল করতে ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আঘাত করা হয়। তাই নিজের ঐতিহ্যকে নিজেরই রক্ষা করতে হবে।
দোলন প্রভা বাংলাদেশের একজন কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও উইকিপিডিয়ান। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। তার জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯ তারিখে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার রেলওয়ে নিউ কলোনিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বাংলাদেশের আনন্দমোহন কলেজ থেকে এমএ সম্পন্ন করেছেন। তিনি ফুলকিবাজ এবং রোদ্দুরে ডটকমের সম্পাদক।
লেখাটা পড়ে অনেক ভাল লাগল। এই সাইটের লেখাগুলোতে অনেক তথ্য থাকে। বেশি জানতে হলে যথেষ্ট তথ্যপূর্ণ লেখা দরকার। 🙂.