
আমার নানী বহুগুণে গুণান্বিত এমন ব্যক্তি যাকে তুলনা করতে গেলে আমার কেবল বটবৃক্ষের কথা মনে পড়ে। নানী যেন মরুর বুকে বৃক্ষের ছায়া। যদি আমাকে কখনো জিঙ্গাসা করা হয় যে, সার্বিক দিক থেকে জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কে? তবে চোখ বন্ধ করে এক কথায় উত্তর দিব যে, আমার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলো আমার নানী।
আমার জীবনের একটি মাত্র জায়গায় আমি শতভাগ ভাগ্যবান সেটি হলো যে, আমি উনার মতো সৎ, নিষ্ঠাবান, কর্মঠ, সমাজ সেবক, শিক্ষানুরাগী, প্রকৃতি প্রেমি এবং সংস্কৃতি প্রেমি একজন ব্যক্তিকে আমার নানী হিসাবে পেয়েছি। না শুধু নানী হিসেবে পেয়েছি বললে ভুল হবে চরম ভুল। তিনি শুধু আমার নানী নন;– তিনি আমার মমতা ময়ী জননী, তিনি আমার হৃদয়ের মনি, তিনি আমার শ্রদ্ধেয় গুরুজন, তিনি আমার ভালোবাসার আপনজন, তিনি আমার দুঃখের সময়ের সাথী, তিনি আমার পথ দেখানো পথিক, তিনি আমার চির চেনা বন্ধু।
আমি জন্মের পর আমার দাদা, দাদী এবং নানাকে চোখে দেখিনি। আর বাবাকে দেখলেও মনে নেই, কারন আমার জন্মের নয় মাস পরেই আমার বাবা মৃত্যুবরণ করেন। শৈশবে যদিও মায়ের কাছে থেকে বড় হয়েছি কিন্তু আম্মু ও নানীর বাড়ি কাছাকাছি হওয়ায় নানীর আদর, মায়া, মমতা, স্নেহ, ভালোবাসাতেই বড় হয়ে উঠেছি। অর্থাভাবে আমি এবং আমার ভাই অনাহারে থাকলে অথবা আম্মু বকা দিয়ে খাবার না দিলে আমরা দুই ভায়ের অনাহারের কথা জানতে পারলেই নানী আমাদের খুঁজে নিয়ে এনে খাওয়াত, আর না খেয়ে থেকেও নানীর কাছে গিয়ে অনাহারে থাকার কথা না বলার কারনে নানী আমাদের বকা দিত।
নানী সবসময় আমাদের বলত যে কখনোই পেটে ক্ষুধা রেখে মুখে লজ্জা রাখবি না। যখনই না খেয়ে থাকবি তখনোই এসে আমাকে জানাবি। আর কিছু দিতে পারি আর না পারি ছাতু আর আচার তো দিতে পারব। আসলে নানীর বাসায় বার মাস শুকনো খাবার হিসাবে ছাতুর সাথে আচার থাকত। নানীর হাতের আচার আমার খুব প্রিয় ছিল। আমি প্রায় আচারের লোভে নানীর কাছে আচার খেতে চাইতাম, কারণ আমি জানি যে ছাতুর সাথে আচার বোনাস।
আমি মূলত পিএসসি পরীক্ষার পর থেকে নানীর কাছে থেকে পড়ালেখা শুরু করি। এক কথায় নানীর সান্নিধ্যে থেকে জীবনকে গড়ার একটা নতুন সুযোগ পাই। তখন যদি নানীর কাছে থেকে পড়ালেখা করার সুযোগ না পেতাম তবে হয়তো আজকের এই আমি এতো দুর এই পথে আসার স্বপ্নও কখনো দেখতে পারতাম না। যদিও নানী ও আম্মুর বাসা পাশাপাশি হওয়ায় কদাচিৎ আম্মুর বাসা যাওয়া হতো কিন্তু সে যাওয়া কখনোই দীর্ঘ স্থায়ি হতো না, তাই সে যাওয়াকে ধানের মধ্যে পাতান হিসাবে হিসাব করাই শ্রেয়।
নানীর কাছে থাকার পর থেকে নানীকে সম্পূর্ণরূপে চিনতে জানতে এবং নানীর কাছ থেকে শিখার ও নানীর আদর্শে নিজেকে গড়ে তোলার সুযোগ পাই। সর্বগুণে গুণান্বিত বলতে যা বুঝায় নানী ঠিক তেমন একজন ব্যাক্তি ছিলেন। নানীর মধ্যে থাকা অসংখ্যা গুণের মধ্যে অন্যতম কয়েকটি গুণ হলো যেমন– নানী প্রখর স্মৃতি শক্তি সম্পন্ন একজন ব্যক্তি ছিলেন। শিশু কাল থেকে শুরু করে শেষ কাল পর্যন্ত জীবনে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা হুবহু মনে রাখতে পারতেন, এবং গল্প কেশসা ও গীত আকারে সেই সব ঘটনা উপস্থাপন করতে বা অনর্গল বলে যেতে পারতেন।
প্রায়ই আমি নানীর কাছে নানীর বাল্যকালের থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন ধরনের গল্প শুনতাম। ছোটবেলায় নানীর মাছ ধরার গল্প, সাতার কাটার গল্প, বিভিন্ন জায়গায় ঘুড়ে বেড়ানোর গল্প, গান ও গীত গাওয়ার গল্প, নানার লাঠি খেলার গল্প, দেশ ভাগের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, এলাকায় কে পায়ে হেঁটে হজ্ব করেছে, কে কি করেছে না করেছে এমন নানান ধরনের অসংখ্য সব গল্প নানীর কাছ থেকে শুনতাম। আমি প্রায় নানীর কাছে গল্প শুনার বায়না ধরতাম এবং নানী যখন গল্প বলত তখন জগতের সকল চিন্তা ভুলে গিয়ে নানীর গল্পের মাঝে হারিয়ে যেতাম।
নানীর মৃত্যুর আগের রমজান মাসে নানীকে বলেছিলাম যে নানী পারলে আমার জন্য আমের আচার বানাইও। নানী আমাকে বলেছিল যে এখন কি আমার বয়স আছে? এক্সিডেন্টের পর হাঁটুর ব্যথাতে তো তেমন হাটতে পারি না ঝড় বাদলে কিভাবে আম কুড়িয়ে আচার বানাব? আমি পরবর্তিতে আমার নিজের ভুল বুঝতে পেরে নানীকে আচার বানাতে নিষেধ করেছিলাম। অথচ মৃত্যুর সময় বাড়ি গিয়ে দেখি ও শুনি যে, আমার জন্য দুই বয়াম আচার বানিয়ে রেখেছেন নানী। অসুস্থ অবস্থায় নানী তাঁর ছোট বোনকে নাকি বলেছিলেন যে, “দে তো আমগালা, কাইটা দে, সিঝিয়া রইদে দিই, সেলিম আচার বানাইবার কথা কহেছিল, কুরবানির ঈদে আসবে তখন ওকে আচার আর ছাতু দিব ঢাকা লিয়া যাইবে। ছুঁড়াটা একলাই থাকে কখন কি করে না করে, কি খায় না খায়; কিছু করতে না পারলে অন্তত অল্প আচার আর ছাতু খায়া মুখে পানি দিতে পারবে।”
নানী প্রচন্ড ভাবে আমার কথা ভাবতেন, আমার দুখে, কষ্টে নানী যেমনি কেঁদেছেন, ঠিক তেমনি আমাকে সান্তনা দিয়েছেন। ২০২১ এর রোজায় ফোনে কথা বলতে বলতে আমি পারিবারিক কারণে কেঁদে ফেলি। আমার কান্না শুনে নানীও কেঁদে ফেলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই নিজেকে শক্ত করে আমাকে সর্বত্তম সান্তনা দেন এবং সব ক্ষত ভুলে পুনরায় শক্ত হয়ে গড়ে উঠতে আমাকে সর্বোচ্চ সাহায্য করেন। আমার জীবনের যে কোনো বিপদের মুহূর্তে যে কনো সমস্যায় শতভাগ নির্ভরযোগ্য আস্থার প্রতীক হয়ে ছিলেন আমার নানী। কোনো ধূসর মরুর মধ্যে যদি একটি মাত্র ক্ষুদ্র হ্রদ ও বৃক্ষ থাকে তবে সেই হ্রদ ও বৃক্ষ যেমন উক্ত মরু অঞ্চলের সকল প্রাণীর বিপদের ক্ষণে প্রাণ রক্ষা বা জীবন ধারনের একমাত্র আশ্রয় স্থল হয়ে দাঁড়ায়, ঠিক তেমনি আমার নানী আমার এই মরুময় জীবনের একাধারে হ্রদ ও বৃক্ষ হয়ে এক মাত্র নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল হয়ে ছিলো।
নিজ জীবনের সুখ-দুখ, ভালো-মন্দ সহ সব কিছুই নানীর সাথে ভাগ করতাম তাছাড়া সকল সমস্যার সঠিক সমাধানও নানীর কাছে চট জলদি পেয়ে যেতাম। এক কথায় বলতে গেলে নানী ছিল আমার কাছে এমন অদ্বিতীয় ব্যক্তি যার স্থান আমার কাছ থেকে কেউ কখনো নিতে পারেনি এবং পারবেও না। গত ২ জুন ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে বিকাল চার ঘটিকার সময় ইহজীবনের মায়া ত্যাগ করে নানী পরকালে পাড়ি জমান।
আমি কখনোই নানীর মৃত্যুর দিনটির কথা ভুলতে পারব না। সেদিন প্রায় আমি চার কি পাঁচবার নানীর সাথে ফোনে কথা বলি। নানী আর অন্যান্য সকল দিনের মতই স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেন, এমনকি নানীর মৃত্যুর দশ মিনিট আগেও আমি নানীর সাথে কথা বলি। সে সময় নানী আমাকে বলে যে “এইতো হামার ভাতিজা একটা চ্যাংড়াকে লিয়া আইসাছে, এখন হামি রক্ত লিব, রক্ত লিলেই হামি ভালো হয়া যাব, ফের আগের মতো হাইটা ব্যাড়াইতে পারব। রাখ এখন ফোন রাখ এই যে রক্ত দিতে ডাক্তার আইসাছে রক্ত লিয়ালি তারপর কথা কহব।” এসব কথা বলার প্রায় পনের মিনিট পরে ছোট মামি আমাকে ফোন করে বলে যে রাণীশংকৈল হাসপাতালে রক্ত নেওয়ার সময় নাকি নানী মারা গেছে।
ছোট মামির এ কথা আমি কোনোভাবেই মানতে ও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, তাই অন্যান্য পরিচিতদের ফোন দিয়েও একই কথা শুনলে তৎক্ষণাত আমার মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে, এক মুহূর্তেই পুরো পৃথিবী যেন আঁধার হয়ে যায়, আর বার বার মনে পড়ে যে নানী তো আমাকে বলেছিল যে নানীর রক্ত নেওয়া হলে আমার সাথে কথা বলবে তবে কেন নানী এভাবে ফাঁকি দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেল! সত্যি বলতে নানীর এভাবে চলে যাওয়া সেদিন কোনোভাবেই আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। তবে বাস্তবতা যতই নিষ্ঠুর বা বেদনাদায়ক হোক না কেন আর সকলের মতো আমিও সেদিন বাস্তবতা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম।
ফুলকিবাজ ডট কমে অতিথি লেখক হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, কলাম, অনুবাদ, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লেখায় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন পূরবী সম্মানিত, ইভান অরক্ষিত, রনো সরকার, দিল আফরোজ, অনাবিলা অনা এবং রণজিৎ মল্লিক। এছাড়াও আরো অনেকের লেখা এখানে প্রকাশ করা হয়।