আমার নানী শাহেরা খাতুনের প্রকৃতিপ্রেম ছিল নিজ সন্তান যত্নের মতই

আমার নানী শাহেরা খাতুন যেমনি পরোপকারী, সমাজ সেবক, শিক্ষানুরাগী ছিলেন ঠিক তেমনি তিনি প্রকৃতি প্রেমিও ছিলেন। বসত ভিটার সাথেই লাগানো প্রায় ৩৫ শতক জমিতে একক প্রচেষ্টায় তিনি যেমন বৃহৎ আকারের ভেষজ, ফলদ, বনজ আকারের বৃক্ষ থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র আকারের লতাপাতা বা গুল্ম রক্ষা করেছেন, এমন কি পশু পাখিসহ সকল প্রকার প্রাণিকেই তিনি নিজ সন্তানের মত যত্ন নিতেন।

নানীর বসতভিটা এবং বসতভিটার পিছনের অংশে বিভিন্ন জাতের আম, জাম, কাঠাল, আনারস, আমড়া, আতা, মেওয়া, কাগজি লেবু, বাতাবি লেবু, দেশি বড়ই, কুল বরই, ডালিম, ডেউয়া, পেপে, লুকলুকি, গাব, তাল, চালতা, খেজুর বেল, জলপাই, তেঁতুল, কেসর, মিষ্টি আলু, গড় আলু, জাম আলু, দেশি আলু, রসুন, তিসি, মটর, সরিষা, পেয়াজ, টমেটো এবং মোরগ ফুল, জবা ফুল, পাতা বাহার, শিমুল, মেহগনি, ঝিঙ্গল, বাকাম, ভুট্টুম, বন পটল, মাদার, তুত, মুথা, দূর্বাসহ প্রায় শতাধিক প্রজাতির বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র আকারের বৃক্ষ, গুল্ম বা ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ ছিল।

নিজ প্রচেষ্টায় সকল প্রকার উদ্ভিদের কাটাই, ছাঁটাই, মাড়াই, নিড়ানি, সেচ কার্য পরিচালনাসহ সকল প্রকার পরিচর্যা ও দেখাশুনা একক ভাবে নানী নিজেই করতেন। শুধু এসব উদ্ভিদের দেখাশুনা বা পরিচর্যা নয়, হরিপুর ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের বিপন্নপ্রায় শস্য বা সাধারণ উদ্ভিদের (যেমন দেশি আলু, জাম আলু, গড় আলু, পেয়াজ, রশুন, তিসি, কালজিরা ইত্যাদি ধরনের) বীজ ঘরোয়া পদ্ধতিতে সংরক্ষণ এবং উপযুক্ত মৌসুমে বীজ বা চারা রোপণসহ সকল ধরনের কাজ কর্ম করতেন।

আমি হরিপুর অঞ্চেলের শেষ তুঁত গাছ, গাব গাছ, ভুট্টুম গাছ, পাতা বাহার গাছ, জাম আলু, তিসি, কালজিরাসহ বেশ কিচু ফলদ ও বনজ উদ্ভিদ আমার নানীর কান্টায় দেখেছি। এর পরে হরিপুর অঞ্চেলে নানীর কান্টা ব্যতীত আর অন্য কোনো স্থানে অন্তত আমার চোখে এই উদ্ভিদগুলো পড়েনি। এছাড়াও বর্তমানে লুকলুকি গাছটি নানীর কান্টায় রয়েছে, যা হরিপুর অঞ্চলে আর অন্য কোথাও অন্তত আমার চোখে পড়েনি।

কান্টার এক অংশে শিমুল গাছের নিচে বাঁশ ঝাড় ও অসংখ্য আনারস গাছ এবং বিভিন্ন ধরনের লতাপাতা যুক্ত এলাকা ছিল। সেখানে অসংখ্য বিষধর ও বিষহীন সাপ দেখা যেত যার ফলে এলাকার কোনো মানুষই সেই অংশটির আশেপাশে যেত না অথচ প্রতিনিয়ত সেই অংশের আশপাশ দিয়ে নানী যাতায়াত করতেন। কোনো দিন যেমন নানী সাপদের কোনো ক্ষতি করেনি ঠিক তেমনি সাপেরাও নানীর সামনে কখনো ফনা তুলে দাড়ায়নি। নানীর মুখে শুনেছি যে রাতে দিনে অসংখ্যবারই নানী নাকি নিজের অজান্তেই সাপের গায়ে পা দিয়ে ফেলেছে, অথচ কোনো দিনই সেই সব সাপ রাগান্নিত হয়ে নানীকে কামড়ায়নি এমনকি নানী সাপগুলোকে পথ ছেড়ে চলে যেতে বললে সাপগুলো নাকি নানীর পথ ছেড়ে চলে যেত। নানীর এইসব কথা যখনই শুনতাম এবং নানীকে নিয়ে যখনই ভাবতাম তখনই যেন এক কল্পনার জগতে হারিয়ে যেতাম। আর মনে মনে ভাবতাম যে ইস! পৃথিবীর এমন সব ভয়ংকর প্রাণীর সাথে আমিও যদি বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারতাম… !

যখন আমার বয়স পাঁচ কি ছয় ছিল সে সময় নানীর মাটির বাসায় মাটির দেওয়ালে অসংখ্য গর্ত ও ফাটল ছিল সেই সব গর্ত ও ফাটলে ক্ষুদে মৌমাছি ও হাড়িবল্লইকে বাসা বাঁধতে দেখেছি। নানীকে কখনোই দেওয়ালের গর্ত বা ফাটল বন্ধ করে কিংবা সেই সব বিষধর বল্লার বাসায় আগুন দিয়ে অথবা অন্য কোনো উপায়ে বল্লা বা বল্লার বাসার ক্ষতি সাধন করতে দেখিনি, এমনকি গাছে বাসা বাঁধা মৌমাছির মৌচাকও কোনোদিন নানীকে মৌয়াল দিয়ে কাটাতে দেখিনি।

নানীর কান্টায় প্রায় ১২০ থেকে ১৫০ প্রজাতির গাছ ছিল, বড় তিনটি শিমুল ও একটি আম গাছ ছিল। সেই সব গাছে অসংখ্য প্রজাতির পাখি বাসা বাঁধত এমনকি বার মাস সেই সব গাছে পাখিরা অবাধে বসবাস করত। নানীর প্রকৃতি প্রেমি মমতা ময়ী হৃদয়ের অগাধ ভালোবাসার ছাপ আর সকল ক্ষেত্রের মত সেইসব পাখিদের উপরেও সমভাবে পড়েছিল।

নানী কখনোই নিজ কান্টায় বসবাসরত সেসব পাখিদের আদিবাসি শিকারি অথবা সম্ভ্রান্ত বা চেীধুরি পরিবারের বর্বর, নিষ্ঠুর, পিশাচ শিকারিদের হাতে শিকার হতে দেননি। তিনি সর্বদা পাখি শিকারের বিরোধিতা করেছেন এবং পাখি শিকারের বা পাখির বাসা ভেঙ্গে পাখির ডিম অথবা বাচ্চা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তিই নানীর কান্টায় যাক না কেন তিনি তারই বিরুদ্ধে কঠোর বিরোধিতা করেছেন।

আমার নানী শাহেরা খাতুন যে কেবল সাপ, বল্লার প্রতি সদয় থেকেছেন তা নয়। নানী যেমন ক্ষুদ্র ভেষজ মুথার গুরুত্ব বুঝতেন ঠিক তেমনি বৃহৎ শিমুলের বাহারি সৌন্দর্যের তৃষ্ণায়ও তৃষ্ণার্ত ছিলেন। নানী যেমন সাপ ও বল্লার প্রতি সদয় ছিলেন ঠিক তেমনি উর্বরতা, সুরক্ষা এবং শান্তির প্রতীক পাখির প্রতিও সদয় ছিলেন। এক কথায় বলতে গেলে নানী প্রকৃতির সকল প্রকার উদ্ভিদ থেকে শুরু করে সকল প্রকার প্রাণির প্রতিও তিনি সদয় ছিলেন।

Leave a Comment

error: Content is protected !!