আমার বড় বোন শাহেরা খাতুনের সাথে আমার বয়সের পার্থক্য অন্তত দশ বছরের। ওর বিয়ের কথা আমার মনে পড়ে না। ওদেশে [পশ্চিমবঙ্গে] আমার সাথে শাহেরা খাতুনের কোনো কথাই মনে পড়ে না, কারণ আমি খুব ছোট ছিলাম।
শাহেরা অনেক আগেই এদেশে চলে আসে। ও দামোলে চলে আসলে আমার বাবা মন খারাপ করে থাকত। ফলে বাবা সবাইকে নিয়ে এদেশে চলে আসে। মা বাবা আমাদেরকে বাড়িতে কোনো বড় পরব পড়লে ডেকে নিত। মুড়ি ভাজার জন্য, পিঠা বানানোর জন্য, চিড়া বানানোর জন্য, ইদের সময় সবাই একসাথে হয়েছি। ও খুব খাটতে পারত।
শাহেরার বাড়িতে আমার নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল। বাবার বাড়িতে যাবার ঘাঁটায় ওর বাড়ি পড়ত। তখন প্রতিবারই ওর সাথে দেখা করে এসেছি। শাহেরার বাচ্চা হলে বাচ্চাকে তেল মাখানো, ঝুল্লু দেয়া, খেলানো ইত্যাদি কাজে বারবার গেছি। ওর বাড়িতে কাজের চাপ থেকেছে সব সময়, খুব খিতিবিতি হত, তখন আমাকে ডেকে নিত।
আমার দাদার নাম জবেদ আলী মুন্না এবং দাদীর নাম খতিজা খাতুন। আমার বাবা ১৯৮৬? সালের এপ্রিল মাসের ২৩ তারিখে মারা যান। শাহেরার বড় ছেলে লুতফরের জন্ম হয় আব্বার বাড়িতে। এরপর সব ছেলে মেয়ের জন্ম হয়েছে দামোলে। সবার জন্মের সময় আমি শাহেরার সঙ্গে থেকেছি।
শাহেরার বাড়িতে খুব বেশি কাজ থাকত। জিনিস পাতি মেলা ছিল। সব সময় ঢেঁকি আর যাঁতা থাকত। মহিষ গরু ছাগল সব সময় দেখেছি। ওদুদ পড়ালেখা করার পর ওদের সব শেষ হয়। ওদের বাড়ি সব সময় বড় দেখেছি। চারটা বড় ঘর, বৈঠকঘর, চারিদিকে দেয়াল ছিল। ওদের বাড়িতে সব সময় দুজন বীরগড় মাদ্রাসায় পড়ালেখা করা ছাত্র জায়গীর থাকতে দেখেছি।
শাহেরা খাতুন যে বছর মারা যায় তার আগের রোজাতে পুরি বানাইছিল আর এক বস্তা মুড়ি কিনে নিয়ে এসেছিল। গোটা গাঁয়ের প্রত্যেকটা বাড়িতে একটা করে মুড়ির প্যাকেট আর পুরি দিয়েছিল। ও ঝাল, আঁইখার ক্ষীর, আন্ধাসা, মুড়ি, চিড়া, আঙ্গুর, বেদানা, খেজুর, কলা খেতে পছন্দ করত। পনের দিনের ভিতর নুবাহারের বাড়ি থেকে তিন ছড়ি কলা কিনে এনে খেয়েছিল। এক সের মাছ তিন দিনে খেয়ে শেষ করে ফেলত।
মারা যাবার কিছুদিন আগে আমার মেয়ে মারুফাকে বলেছিল, তুই ঝাল রেঁধে নিয়ে আসিস। মারুফা ভাপা পিঠা বানিয়ে নিয়ে গেছিল, আইখার ক্ষীর আর ঝাল আইন্ধা নিয়ে গেছিল।
আমার বড় বোন শাহেরা মরার চার দিন আগে একটা মুরগির পুরোটা খেয়েছিল। মরার আগের দিন সারা রাত গল্প করেছে। একটা আম কুড়িয়ে পেয়েছিল। আড়াইশ টাকার লিচুর বারটা লিচু রেখে সবগুলা একাই খেয়েছিল। ছয়টা ডিম সিদ্ধ করে নিয়েছিল হাসপাতালে খাবে বলে। কয়েকটা কলা সঙ্গে নিয়েছিল হাসপাতালে খাওয়ার জন্য।
শাহেরার এই কথাটা আমার খুব মনে পড়ে। মারা যাওয়ার তিনমাস আগেও বলেছিল ‘তোর জ্ঞানে তুই চলবি, হামার জ্ঞানে হামি চলব’। ও জোর করে কারো উপকার করতে চাইত না, কিন্তুক সবারই ভাল হোক তা চাইত।
ফুলকিবাজ ডট কমে অতিথি লেখক হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, কলাম, অনুবাদ, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লেখায় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন পূরবী সম্মানিত, ইভান অরক্ষিত, রনো সরকার, দিল আফরোজ, অনাবিলা অনা এবং রণজিৎ মল্লিক। এছাড়াও আরো অনেকের লেখা এখানে প্রকাশ করা হয়।