আমার বড় ননদ শাহেরা খাতুন লম্বা, স্বাস্থ্যবান, কর্মঠ নারী ছিলেন

গুলশান আরা, গৃহিণী

আমার বড় ননদ শাহেরা খাতুনের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাত হয় আমার বিয়ের দুমাস পরে। বিয়ে হবার মাস দুয়েক পরে আমি প্রথম শ্বশুর বাড়িতে যাই। আমার সঙ্গে আমার নানী আর বড় ভাই গিয়েছিলো। এক সপ্তাহ ছিলাম শ্বশুরের বাড়ি মহেন্দ্রগাঁওতে। সেই সময় আমার বড় ননদের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিলো।

আমার বড় ননদকে আমি বড় বুবু ডাকতাম। উনি দেখতে লম্বা, স্বাস্থ্যবান, কর্মঠ নারী ছিলেন। একই বছরের রমজান মাসে দ্বিতীয় বার শ্বশুর বাড়ি যাই। সেই সময়ও আমার ননদ আসতেন; তিনি বাড়ির সাংসারিক কাজ শেষ করে দেখা করতে আসতেন। উনাদের মাটির ঘর ছিলো। তিনি ঢেঁকিতে ধান ভানতেন, তখন ঢেঁকির চল ছিল। তাঁর বাড়িতে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী আর নানা ধরণের গাছপালা ছিলো।

আমার বিয়ের সময় আমাদের বাড়িতে শ্বশুর নূর হোসেন এবং তার শ্যালক আর আমার বরের অফিস থেকে একজন এসেছিলেন। আমার বিয়ে হয়েছিলো গরমের সময় তখন গম, ডাল পেকেছিল। ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে। বিয়ের পরে আমার ছোট ভাই জাহাঙ্গীর মহেন্দ্রগাঁও গিয়েছিলো। সেখানে ধানের চেয়ে ডাল, গম, ভুট্টা, সরিষা ইত্যাদি বেশি হতো। কৃষি কাজ করত বেশিভাগ মানুষ।

আমার বড় ছেলে গোলাপের জন্মের আট দিন পরে অর্থাৎ ১১ জানুয়ারি, ১৯৯০ সালে সন্ধ্যায় বড় ননদ পার্বতীপুরের নিউ কলোনির বাসায় এসেছিলেন। উনার সঙ্গে ছিলো দুই ছেলে বানি ইসরাইল ও সাদি। তাঁরা পরের দিন আমার বাবার বাড়ি কালিকাবাড়ি ডাঙ্গাপাড়ায় গিয়েছিলো। ৩ রাত ২ দিনের সফর শেষে তারা সবাই দিনাজপুরে চলে যান।

আমার ভাসুর আমজাদ আলী যখন চৌরঙ্গীতে বাড়ি করেছিলো তখন পার্বতীপুর থেকে গিয়ে ওখানেই থাকতাম। সেই সময় বড় ননদের বাড়িতে বেশি যাওয়া আসা হতো। এছাড়াও বাড়িতে যেতাম পিঠা খাওয়ার জন্য ঢেঁকিতে চাল কুটার জন্য। বাস থেকে নেমেই মহেন্দ্রগাঁও যাওয়ার পথেই উনার বাড়ি ছিল, সেই সময় দেখা করে শ্বশুর বাড়ি যেতাম। উনি অতিথিপরায়ন ছিলেন। বাড়িতে কেউ বেড়াতে গেলেই কালাই রুটি, চিতই পিঠা, ফল ইত্যাদি খেতে দিতেন।

উনার সাথে পারিবারিক নানা গল্প হতো। উনি বলতেন— ‘আমার বড় ভাই ও ছোট ভাই খোঁজ খবর নেয়। ছোট ভাই অর্থাৎ দাউদ হোসেন অফিস ছুটিতে যখন বাড়িতে আসতো তখন আমার সাথে দেখা করার জন্য আসতো। দুঃখ-সুখের নানা কথা হতো ভায়ের সাথে। বাড়িতে এলেই বোনের হাতের রান্না করা খাবার খেতো। তাছাড়া বাড়িতে বোনের হাতে বানানো যেই খাবার থাকতো সেটাই চেয়ে খেতো’।

উনি বিভিন্ন রকমের গীত গাইতে পারতেন এটা আমি অন্যের কাছে জেনে ছিলাম। সেটা শোনার ভাগ্য হয়েছিলো আমার ভাসুরের ছেলে করিমের বিয়ের সময়। হুট করে বিয়ে হলো, কিন্তু সেই বিয়ে বাড়িতে আত্মীয় স্বজন সবাই এসেছিলো। তিন দিনের উৎসব ছিলো। সন্ধ্যায় গায়ে হলুদের সময় বড় বুবু গীত গেয়েছিলেন।

আমার স্বামী যখন মারা যায় আমি ভেঙ্গে পড়েছিলাম; সংসার, সন্তানের দায়িত্ব একাই নিবো কীভাবে? বড় বুবু আমাকে সাহস দিয়েছিলেন। উনার স্বামী মারা যাবার পরে কীভাবে সংসার চালাতেন সেইসব কথা বলতেন। খুব সাহসী ছিলেন। অনুপ্রেরণা দিতে পারতেন তিনি। হাজারো দুঃখেও ভেঙ্গে না পড়ে সাহসের সাথে কাজ করার কথা বলতেন।

আমার বড় ননদ মাছ খেতে পছন্দ করতেন। বাড়ির জমির সবজি খেতেন। এছাড়াও নানা রকম টাটকা ফল খেতেন। এছাড়া বাড়িতে কিসমিস, খেজুর রাখতেন।  তিলের খাজা, বাতাসা, জিলাপি, মিষ্টি চানাচুর খেতে পছন্দ করতেন। আমি যখনই উনার সাথে দেখা করতে যেতাম তখন উনার পছন্দের খাবার নিয়ে যেতাম।

উনার হুট করে চলে যাওয়া আমার মেনে নিতে কষ্ট হয়েছে। উনার সাথে যে মাসে শেষ দেখা হলো সেই দিনের একটি স্মৃতি মনে পড়ে। আমি মিষ্টি চানাচুর নিয়ে গিয়েছিলাম। উনি সকালে একটা চেয়ারে বসে বাচ্চাদের মতো মজা করে খাচ্ছিলেন। আমি ২টা প্যাকেট চানাচুর নিয়েছিলাম; দোকানে আর ছিলো না। বড় বুবুর খাওয়া দেখে মনে হচ্ছিলো দোকানে আরো চানাচুর থাকলে আমি নিয়ে আসতাম। আনন্দের সাথে চানাচুর খাওয়ার দৃশ্যটা আমার চোখে এখনো ভাসে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!