মণি সিংহ বা কমরেড মনি সিংহ (ইংরেজি: Moni Singh; ২৮ জুন ১৯০১, – ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯০) ছিলেন বাংলাদেশের সুবিধাবাদী, সংশোধনবাদী ধারার বামপন্থী রাজনীতিক, সমাজসেবী ও তৎকালীন ময়মনসিংহের কৃষক ও টংক আন্দোলনের নেতা। তিনি অন্তত দুই দশক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
মনি সিংহের পিতা কালীকুমার সিংহ ছিলেন পূর্বধলার সিংহ উপাধিধারী জমিদার সন্তান, বিয়ে করেছিলেন সুসঙ্গ জমিদার বংশে। জমিদারীর আয়ে সংসার চলতো না বলে পিতা কলিকাতায় কোনো এক কোম্পানীতে মধ্যমানের এক চাকরী করতেন। সেখানে মণি সিংহের জন্ম। চার ভাই এক বোনের মধ্যে বোন নির্মলা সিংহ বামপন্থি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
মণি সিংহ কলকাতায় লেখাপড়া করা অবস্থায় ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ন্যাশনাল পরীক্ষা দিয়েছিলেন। বাল্যকাল থেকেই তাঁর দেশ ও সমাজসেবার প্রতি জাগ্রতবোধ ছিল। কলিকাতায় পাঠ্যাবস্থায় তিনি তৎকালীন বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন দলের সঙ্গে যুক্ত হন ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে এবং বৈপ্লবিক কর্মতৎপরতার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারী হয়। তখন পাটির কাজের স্বার্থে তাঁকে দীঘ দীন আত্মগোপন করে থাকতে হয়। ফলে ভাগ্যে উচ্চশিক্ষা জোটেনি।
বয়স ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সঙ্গে বিপ্লবী রাজনীতির প্রতি মোহভঙ্গের পর তিনি ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ভাতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। সে সময় তিনি সুসঙ্গ দুর্গাপুর অঞ্চলের শোষিত হাজং ও কৃষকদের সঙ্গে মিশেন। তাদেরকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলার উদ্দেশ্যে কতিপয় সহকর্মীর সহযোগিতায় তিনি সেখানে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এ সকল কৃষক জনগণের সঙ্গে মেলামেশার জন্য সুসঙ্গের জমিদারগণ তাঁকে ভাল চোখে দেখতেন না। অতঃপর তিনি কলিকাতা চলে যান ও কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজফফর আহমদের প্রকাশ্য সংগঠন ওয়ার্কার্স এন্ড পিজেন্টস পাটির সার্বক্ষণিক কর্মীরূপে ব্রত হন এবং উক্ত সংগঠনে ৯ বছর কাজ করেন।
মেটিয়াবুরুজে কেশরাম কটন মিলে কাজ করার সময় শ্রমিক নেতা হিসাবে সুপরিচিত হন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠিত হওয়ার পরবর্তী ৯ মে তিনি গ্রেপ্তার হন। বিভিন্ন জেলখানায় আটক থাকার পর তাঁকে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে সুসঙ্গের নিজ বাড়ীতে নজরবন্দি করে রাখা হয়। তখন প্রতিদিন তাঁকে থানায় হাজিরা দিতে হতো। অন্তরীন অবস্থায় সুসঙ্গের নিকটবর্তী গ্রামসমূহের শোষিত মুসলমান ও হাজং কৃষকদের সঙ্গে তাঁর সংযোগ আরও গভীর হয়।
সিপিবির কয়েকটি ভিডিও দেখুন
কৃষকরা টংকের অত্যাচারে জর্জরিত। জমিতে ফসল হোক বা না হোক জমি চাষের জন্য খাজনা হিসাবে জমির মালিককে একর প্রতি ছয় থেকে পনর মণ ধান দিতে হতো। জমিতে প্রজার কোনো স্বত্ত্ব ছিল না। এ প্রথার নাম টংক প্রথা। সুসঙ্গে নজরবন্দি থাকার সময় নিজ গ্রামের জনৈক জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করেন। সে আক্রোশে জমিদার মণি সিংহ নজরবন্দী থাকাবস্থায় রাজনীতি করেন বলে, অভিযোগ দায়ের করেন। মামলার বিচারে তাঁর দেড় বছর জেল হয়। সাজার মেয়াদ শেষে নদীয়া জেলার করিমপুর থানার এক গণ্ডগ্রামে পুনরায় তাঁকে নজরবন্দি রাখা হয়।
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি মুক্তি পান। মুক্তির পর কলিকাতায় আসেন। তখন পার্টি আত্মগোপনে থাকায় বন্ধু কমিউনিস্টদের কারও সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। অতঃপর মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য সুসঙ্গ যান। মণি সিংহের বাড়ি আসার খবর পেয়ে শোষিত মুসলমান কৃষকরা প্রথমে তরে সঙ্গে দেখা করে। তারা টংক প্রথার অসহনীয় পীড়ন থেকে বাঁচানোর জন্য তাঁর নিকট আবেদন করে। তখন তিনি কলিকাতার শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। বাড়ীতে এসেছেন শুধু মাকে দেখতে এবং আবার নিজ কর্মক্ষেত্রে চলে যাবেন বলে জানিয়ে তাদেরকে বিদায় করেন। কৃষকরা তবু নাছোড়বান্দা হয়ে প্রতিদিন দেখা করে ও নিজেদের দাবী অব্যাহত রাখে।
অবশেষে কৃষকদের দুর্দশা ও ক্রমাগত কাতর অনুনয়ে তিনি অত্যন্ত ভাবনায় পড়েন। কারণ জমিদার, জোতদার এমন কি তাঁর নিজ জমিতেও টংক চাষী বিদ্যমান ছিল। এ অবস্থায় অনেক ভেবে চিন্তে শেষ পর্যন্ত তিন টংক আন্দোলনের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন স্থানে সভা সমিতি করে টংক প্রথা উচ্ছেদের জন্য তুমল অন্দোলন শুর করেন। প্রথমে একাই কাজের সূত্রপাত ঘটান। পরে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন ভূপেন ভট্টাচার্য, প্রমথ গুপ্ত, জলধর পাল, আলতাব আলী, নগেন সরকার এবং অন্যান্য নেতৃস্থানীয় কমিউনিস্ট কর্মীগণ। তাঁদের সমবেত প্রয়াস ও সংগ্রামের ফলে উত্তর ময়মনসিংহের গারো পাহাড় অঞ্চল সে সময় এক সাম্যবাদী রাজনীতির সংগ্রামী ভুবনে পরিণত হয়।
আন্দোলনের কর্মীদের মাঝে হাজংরা ছিলেন প্রবল ও পাহাড়ের পাদদেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে ও পরে দুই ভাগে টংক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিলো। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে জমিদার ও সরকারী বাহিনীর বহুবার সংঘর্ষ হয়। উভয় পক্ষে বহু লোক হতাহত হয়। তার এক সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে।
মণি সিংহ সর্বপ্রথম ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলা কমিউনিস্ট পাটির সদস্য হন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে কিশোরগঞ্জে ও ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে দুর্গাপুরে অনুষ্ঠিত জেলা কৃষক সম্মেলন এ বং ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে নালিতাবাড়ীতে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন।
১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে করিমগঞ্জ থানায় মহামারী হয়। সেখানে তিনি চিকিৎসক দল প্রেরণ করেন। পঞ্চাশের মনন্তরের (১৩৫০ বঙ্গাব্দ =১৯৪৩ খ্রি.) সময় ময়মনসিংহ শহরে লঙ্গরখানার উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। দুর্ভিক্ষে চাউলের মূল্য কম রাখার জন্য শেরপুর থেকে চাউল ক্রয় করে ময়মনসিংহের বাজারে ছাড়ার ব্যবস্থা করেন।
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসের ৪ ও ৫ তারিখে নেত্রকোনার নাগরার মাঠে অনুষ্ঠিত সারা ভারত কৃষক সম্মেলনের দায়িত্বে ছিলেন। এরূপ বিরাট ও সুশৃঙ্খল ঐতিহাসিক জন সমাবেশ এতদঞ্চলে পূর্বাপর দেখা যায়নি। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য পদের জন্য নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করে ব্যর্থ হন। একই সনে তিনি দ্বিতীয় দফায় টংক আন্দোলন জোরদার করেন। দুর্গাপুর, লেঙ্গুরা, বহেরাতলী, দশলি প্রভৃতি গ্রামসহ পূর্বে পশ্চিমে দীঘ ৬০/৭০ মাইল বিস্তীর্ণ পাহাড় অঞ্চল এক সশস্ত্র বিপ্লবের ক্ষেত্রে পরিণত হয়। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারীতে ১৯ জন আন্দোলনকারী শহীদ হন। তা ছাড়াও পরে অনেককে পাকিস্তান সরকার হত্যা করে। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের পর টংক আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে এবং টংক ও জমিদারী প্রথা উঠে যায়।
পাকিস্তানি আমলে মণি সিংহ
তৎকালীন নুরুল আমিন সরকার কতৃক মণি সিংহের ঘরবাড়ী উচ্ছেদ করা হয়। আইয়ুব খাঁর শাসনামলে তিনি দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন এবং ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারী মাসে মুক্তি পেয়ে জুলাই মাসে পুনরায় গ্রেপ্তার হন।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী জেলে বন্দী ছিলেন এবং ২৫ মার্চের পর কমরেড দেবেন শিকদারের নেতৃত্বে অন্যান্য বন্দিরা জেল ভেঙ্গে তাঁকে বের করে। পরে তিনি ভারতে গমন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অবদান রাখেন। দেশ বিভাগের পর ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পাটির সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। তাঁর লেখা একটি মাত্র বই হচ্ছে জীবন সংগ্রাম যা ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয়।
তথ্যসূত্র
১. দরজি আবদুল ওয়াহাব, ময়মনসিংহের চরিতাভিধান, ময়মনসিংহ জেলা দ্বিশতবার্ষিকী উদ্যাপন কর্তৃপক্ষ, ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ, এপ্রিল ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ৩৬৭-৩৭০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।