মায়া ঘোষ ছিলেন বিপ্লবী দলের নেত্রী

মায়া ঘোষ  ছিলেন বিপ্লবী দলের নেত্রী। ছোট বেলা থেকে রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠেন। স্বদেশী আন্দোলন সবসময় মনকে টানতো। কিন্তু কীভাবে যুক্ত হবে সেটা জানতেন না। বি.এ পাশের পড়ে চাকরি করতে গিয়ে রাজনৈতিক কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে নির্যাতনের সম্মুখীন হয়। তারপরেও কাজ চালিয়ে যান।

জন্ম ও পরিবার

গণিতের প্রসিদ্ধ অধ্যাপক ও ‘বীজগণিত’- প্রণেতা কে. পি. বসুর দৌহিত্রী মায়া ঘোষ জন্মগ্রহণ করেছিলেন দিল্লীতে ২২ এপ্রিল ১৯১৫ সালে। তার মাতা প্রিয়ম্বদা দেবী ও পিতা যতীন্দ্রনাথ ঘোষ। মায়ার দু’বছর বয়সের সময় তার মায়ের মৃত্যু হয়। মায়াকে লালন পালন করার দায়িত্ব তার মাতামহী মেঘমালা দেবী, কে. পি. বসুর স্ত্রী।

মায়া ঘোষ-এর শৈশব জীবন

মেঘমালা দেবীর ভাই অতুলকৃষ্ণ ঘোষ ও অমরকৃষ্ণ ঘোষ বিপ্লবী নেতা যতীন্দ্রনাথ মুখার্জীর নেতৃত্বে গুপ্ত বিপ্লবী আন্দোলনের ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তারা তখন দিদি মেঘমালা দেবীর বাড়িতেই থাকতেন। সেখানে তাদের সহকর্মী বন্ধুদের গোপন আনাগোনা ছিল। তাঁদের সকলের প্রতি এবং তাদের বিপ্লবী কাজের প্রতি মেঘমালা দেবীর অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহানুভূতি ছিল। ফলে পুলিসের বহু নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল এই পরিবারকে। মায়া তার জ্ঞান হওয়া অবধি একটা বিপ্লবী আবহাওয়ার সঙ্গে পরিচিত হন। তার এই মামাবাড়ির সঙ্গে যুগান্তর-দলের বিপ্লবী নেতা ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত, হরিকুমার চক্রবর্তী, জীবনলাল চ্যাটার্জী, নলিনীকান্ত কর প্রভৃতির ঘনিষ্ঠ সংস্রব ছিল। এঁদের সংস্পর্শে এসে এঁদের বিপ্লবী জীবনের কাহিনী শুনে, এবং এঁদের ব্যক্তিত্বের প্রভাবে মায়ার মনে স্বাধীনতার স্পৃহা ও দেশসেবার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। মায়ার ছোট মাসীমা বীণাপাণি মিত্রও বিপ্লবীদের গোপনে অনেক সাহায্য করতেন। তিনি নিজে কখনো বিলাতী জিনিস ব্যবহার করতেন না এবং মায়াকেও দিতেন না।

আন্দোলনে যুক্ততা

১৯৩০ সাল থেকে সশস্ত্র বিপ্লব ও অহিংস আইন অমান্য আন্দোলনের দুই স্রোত পাশাপাশি বয়ে চলেছিল বাংলাদেশ জুড়ে। ঐ-সব বিপ্লবীরা তখন কারাপ্রাচীরের অন্তরালে। মায়া ঘোষ তখন স্বাধীনতা-সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে যে-কোনো কাজ করতে প্রস্তুত। তিনি ছটফট করছিলেন, অথচ পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের ছোট বোন স্নেহলতা দত্তও (সেন) তখন তাদেরই বাড়িতে থাকতেন। তারও প্রবল ইচ্ছা কাজ করবার।

একদিন কংগ্রেস-নেত্রী মোহিনী দেবী এলেন তাদের বাড়িতে। জিজ্ঞেস করলেন, মায়া ঘোষ প্রভৃতি জেলে যেতে রাজী কিনা। মায়া উচ্ছ্বাসে লাফিয়ে উঠলেন এবং লুকিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিন বন্ধু; মায়া ঘোষ, স্নেহলতা দত্ত ও দীপ্তি ঘোষ এবং পৌঁছলেন গিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে।

শোভাযাত্রায় যোগদান করাতে পুলিস নিয়ে যায় তাদের লালবাজার। পরদিন ছেলেমানুষ বলে বিচারে তারা মুক্তি পান। মুক্তি পেয়ে সেদিন কী দুঃখ তাদের। বিপ্লবী কাজে যোগ দেবার কোনো পথই তাদের সামনে তখন খোলা ছিল না। এদিকে বিপ্লবী দাদারা সবাই তখন জেলে। নিষ্ফল আকাঙ্ক্ষা মায়ার মনে বৃথাই কেঁদে ফিরল।

পত্রিকায় কাজ

তার বাবা বিয়ের চেষ্টা করাতে মায়া অনশন করলেন। বিয়ের চেষ্টা ব্যর্থ হল। ১৯৩৬ সালে মায়া ঘোষ বি. এ. পাস করেন। ১৯৩৮ সালে বিপ্লবী নেতারা সবাই জেল থেকে মুক্তি পান। গুপ্ত আন্দোলনের দিন তখন শেষ হয়েছে। যুগান্তর-দলের নেতারা তখন গুপ্ত যুগান্তর-দল ভেঙে দিয়ে কংগ্রেসে যোগদান করেছেন। তাঁদেরই মুখপত্র-স্বরূপ ছিল তখন ‘মন্দিরা’ মাসিক পত্রিকা। বিপ্লবী রসিকলাল দাস মায়া ঘোষকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ‘মন্দিরা’র সম্পাদিকা কমলা দাশগুপ্তের সঙ্গে। মায়া মন্দিরা’র কাজ করতে থাকেন প্রাণের পরিপূর্ণ আগ্রহ ও আন্তরিকতা নিয়ে। ‘মন্দিরা’র কর্মীদের মনে তখন এই প্রেরণাই ছিল যেন ‘মন্দিরা’র কাজ স্বাধীনতা-সংগ্রামের অঙ্গ।

মায়া ঘোষ-এর কর্মজীবন ও রাজনৈতিক কাজ

১৯৩৯ সালে বেধেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪১ সালে বাড়ির সকলের অমতে একটি স্কুলের শিক্ষয়িত্রীর কাজ জুটিয়ে নিয়ে মায়া চলে যান বীরভূমের রামপুরহাটে নিজে রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্র প্রস্তুত করতে। এবারের স্বাধীনতা-সংগ্রামে যোগদান তাকে করতেই হবে।

তিনি ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী। স্কুলে কাজ করতে করতে তিনি বীরভূমের গ্রামের অভ্যন্তরে সম্প্রদায় নির্বিশেষে জনসাধারণের কাছে কংগ্রেসের আদর্শ প্রচার করতে থাকেন। সকলের সঙ্গেই তার একটা ঘনিষ্ঠতা, একটা নিবিড় সংযোগের ফলে কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়ে উঠল।

ওদিকে মায়া ঘোষের কাছে মহকুমা শাসকের নির্দেশ এল যুদ্ধ-তহবিলে চাঁদা তোলার জন্য স্কুলে সিনেমার টিকিট বিক্রি করে দেবার। মায়া ঘোষ লিখে পাঠান যুদ্ধ-তহবিলের জন্য টাকা তুলে দেওয়া তার আদর্শ বিরুদ্ধ। তবুও চাকরি তার গেল না।

১৯৪২ সালের আগস্ট-আন্দোলনের পূর্বেই ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত প্রভৃতি নেতাগণ আবার কাররুদ্ধ হন। আগস্ট আন্দোলনের মুখে মায়া ঘোষ কলিকাতা এলেন কমলা দাশগুপ্তবীণা দাসের সঙ্গে আলোচনা করতে, কিভাবে আন্দোলনের কাজ করা যায়। আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, প্রত্যেকে নিজ জায়গায় ফিরে কংগ্রেসের প্রোগ্রাম অনুযায়ী আন্দোলনের কাজ করবার চেষ্টা করবেন।

ইউটিউবে দেখুন আমার লেনিন তথ্যচিত্র

সাংগঠনিক কাজ গড়ে তোলা

মায়া কলকাতা থেকে ফিরে যান রামপুরহাটে। তাঁর বিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রীগণ প্রভাসিনী চক্রবর্তী, গুরুমা প্রভৃতি তার সঙ্গে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। তারা সিনেমা দেখতে গিয়ে বুলেটিনের মতো কংগ্রেসের প্রোগ্রাম বিলি করে এলেন। মায়া ঘোষ সর্বত্র ঘরে আন্দোলন পরিচালনা করবার চেষ্টা করতে থাকেন। স্থানীয় কংগ্রেসের নেতারা তাকে সভা-শোভাযাত্রায় যোগ দিতে অনুরোধ করেন। এতদিনে মায়া ঘোষের রুদ্ধ আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হতে চলেছে। পরদিন শোভাযাত্রা যখন মায়া ঘোষের স্কুলের সামনে এসে থামল। তিনি বেরিয়ে এলেন তাতে যোগ দিতে; সঙ্গে এলেন স্কুলের আরো দুটি শিক্ষয়িত্রী। উষা মাহাড়া ও মণিপ্রভা মুখার্জী। শোভাযাত্রা ছেলেদের হাইস্কুলের সামনে দিয়ে যাবার সময় তাতে যোগ দেয় এসে ছাত্রের দল। তাদের সঙ্গে মিলিত হলেন বীরভূমের বিখ্যাত কংগ্রেস কর্মী লালবিহারী সিংহ ও তার স্ত্রী সন্ধ্যারানী সিংহ, এলেন নীহারিকা মজুমদার।

রামপুরহাটের স্কুলগুলি বন্ধ হয়ে গেল। বিরাট শোভাযাত্রা চলেছে শহরে ও গ্রামে। তাদের দমন করবার জন্য সেখানে আমদানি করা হয় সশস্ত্র পুলিসবাহিনী। শোভাযাত্রীদল ও সশস্ত্র কাহিনী পাশাপাশি চলতে থাকে ঐ ছোট্ট শহরেও। ৩১ আগস্ট থানা দখল করা হবে স্থির হয়। মায়া ঘোষ সদলবলে আদালত বন্ধ করতে চলে যান। মহকুমা শাসক ফৌজদারি আদালত বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলেন। মায়া ঘোষের নেতৃত্বে কর্মীবাহিনী দ্রুত এসে সিভিল-কোর্টে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দিলেন।

ছেলের দলকে খাবার জন্য পাঠিয়ে দিয়ে মায়া ঘোষ ফৌজদারি আদালতের বারান্দায় বসে ছিলেন। পাশে বসে আছেন সাবিত্রী গান্ধী। এমন সময় সশস্ত্র পুলিসবাহিনী বন্দুক উঁচিয়ে এসে তাদের ঘিরে ফেলল। পুলিসবাহিনীর শ্বেতাঙ্গ অফিসার মায়া ঘোষকে সেখান থেকে হটাতে না পেরে, তার দৃঢ়তা দেখে চলে যায় মহকুমা শাসকের কাছ থেকে গুলী চালাবার অনুমতি চাইতে। অনুমতি মেলে নি। গ্রেপ্তারের আদেশ হয়। পুলিসবাহিনীর একজন এসে সাবিত্রী গান্ধীকে ধাক্কা দিয়ে বারান্দা থেকে নামিয়ে দেয়। মায়া ঘোষকে চারিদিক থেকে পুলিস ঘিরে ফেলে। দুজন লোক এমন শক্তভাবে তার হাত ধরেছিল যে, অনেকদিন পর্যন্ত সেই কালসিটের কালো দাগ মিলিয়ে যায় নি। মায়া ঘোষ গ্রেপ্তার হলেন। সাবিত্রী গান্ধী তখনো তেজোময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন। উদ্যত বন্দুকের সামনে জনতা নির্ভীকভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যারানী সিংহ দাঁড়ালেন এসে বন্দুকের সামনে। তিনিও গ্রেপ্তার হলেন। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সাবিত্রী গান্ধীও।

মায়া ঘোষ-এর জেল জীবন ও অন্যান্য কাজ

মায়া ঘোষদের নিয়ে যায় সিউড়ি জেলে। সাজা হয় তার একবছর দশমাস সশ্রম কারাদণ্ডের। ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে মায়া ঘোষ রাজশাহী জেল থেকে মুক্ত হন। বেরিয়ে এসেই দেখেন তিনি পঞ্চাশের মন্বন্তরের কালো ছায়া। রিলিফের কাজ করতে লেগে যান তিনি বীরভূমের গ্রামগুলির মধ্যে। ১৯৪৫ সালে কস্তুরবা-ট্রেনিং নিতে চলে যান তিনি বম্বে।

১৯৪৬ সালে নোয়াখালি-দাঙ্গার পর নোয়াখালিতে গিয়ে রিলিফের কাজ করেন তিনি দাঙ্গাবিধ্বস্ত গ্রামের অভ্যন্তরে। ফিরে এসে তিনি সাঁইথিয়ার একটি দুইক্লাস যুক্ত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রীরূপে যোগদান করেন। সেই বিদ্যালয়কে বহু পরিশ্রম করে এগারো শ্রেণী সমন্বিত স্কুলে পরিণত করেন। নীরবে সমাজসেবার কাজ করে চলেছিলেন তিনি বীরভূমের গ্রামে গ্রামে। নিরলস, শ্রান্তিহীন তার কর্মপ্রেরণা।

আরো পড়ুন

তথ্যসূত্র:

১. কমলা দাশগুপ্ত (জানুয়ারি ২০১৫)। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী, অগ্নিযুগ গ্রন্থমালা ৯। কলকাতা: র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন। পৃষ্ঠা ২১৬-২১৯। আইএসবিএন 978-81-85459-82-0

Leave a Comment

error: Content is protected !!