মপাসাঁ বা মোপাসঁ বা গী দ্য মপাসাঁ (ইংরেজি: Henri René Albert Guy de Maupassant; ৫ আগস্ট ১৮৫০ – ৬ জুলাই ১৮৯৩) ছিলেন উনিশ শতকের ফরাসী লেখক, ছোটগল্পের রূপের একজন কুশলী হিসাবে এবং প্রকৃতিবাদী চিন্তার প্রতিনিধি হিসাবে স্মরণীয়, যিনি মানবজীবন, গন্তব্য এবং সামাজিক শক্তি থেকে মোহমুক্তিকে প্রায়শই হতাশাবাদী শর্তে চিত্রিত করেছিলেন। তাঁর সম্পূর্ণ নাম আঁরিরেনি আলবেয়র গী দ্য মপাসাঁ। সংক্ষেপে তার নাম আমরা লিখি, গী দ্য মপাসাঁ। গী দ্য মপাসাঁর জীবনকাহিনী বিশাল নয়, কিন্তু বৈচিত্র্যে ভরপুর। আর সে বৈচিত্র্য নৈরাশ্য, হতাশা আর বিষণ্ণতা ছাড়া কিছু নয়। তবে মানসিক দৃঢ়তাই তাকে জীবনপথের বাধা বিঘ্নকে অগ্রাহ্য করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দান করেছে।
সেটা ছিল আঠার শ’ পঞ্চাশ খ্রিস্টাব্দের পাঁচই আগস্ট, ফরাসীর অন্তর্গত নর্মাণ্ডিতে সেদিন জন্মগ্রহণ করলেন মপাসাঁ। তার বাবা গুস্তাভ দ্য মপাসাঁ, আর মায়ের নাম ছিল লরা। গুস্তাভ ছিলেন নর্মান। অতএব মপাসাঁ জন্মসূত্রে ছিলেন নর্মান। মপাসাঁর বারো বছর বয়সকালে তার বাবা-মা পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদের পর বালক মপাসাঁ তার মায়ের সঙ্গে থেকে যান। ফলে তার মা লরা বাবা ও মায়ের উভয় দায়িত্বই ঘাড়ে নিয়ে ছেলেকে মানুষ করে তুলতে থাকেন। মায়ের কাছেই তার বাল্য ও কৈশোরের শিক্ষালাভ হতে থাকে।
লরা কেবলমাত্র পাঠ্যপুস্তকের গন্ডির মধ্যেই বালক মপাসাঁর পাঠাভ্যাস সীমাবদ্ধ রাখলেন না। ইংরাজ কবি ও সাহিত্যিকদের অনুবাদ গ্রন্থ, বিশেষ করে শেকসপীয়রের নাটকগুলির অনুবাদ পড়ে তিনি ছেলেকে শোনান। ফলে ইংরাজি সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ বাল্য ও কৈশোর থেকে তিলে তিলে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
মপাসাঁর পক্ষে দীর্ঘদিন ইভেট-এর বিদ্যালয়ে পাঠাভ্যাস করা সম্ভব হলো না। রুক্ষ ও উদ্ধত আচরণের জন্য বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে বহিষ্কার করে দেন। এখন উপায়? তার মা ছেলের ভবিষ্যতের ব্যাপারে বড়ই ভাবিত হয়ে পড়লেন। শেষ পর্যন্ত একে-ওকে ধরাধরি করে, বহু কাঠখড় পুড়িয়ে লাউয়েন-এর বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। এখান থেকেই তিনি প্রথানুযায়ী পুঁথিগত বিদ্যা সমাপ্ত করেন।
বিদ্যানুশীলন সমাপ্ত করে কিশোর পাস এবার নৌ-বিভাগের করণিকের কাজে যোগদান করেন। কিন্তু এখানে আসায় তার সাহিত্য-সাধনায় ভাটা পড়ল। তা ছাড়া বৈচিত্রহীন একঘেয়ে কাজের মধ্যে দিনের পর দিন নিজেকে লিপ্ত রাখায় অচিরেই তার মন হাঁপিয়ে উঠল। অনন্যোপায় হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে আবার ফিরে এলেন প্যারিসের সে পরিচিত পল্লীতে। এবার তিনি পূর্ণ উদ্যমে গল্প ও উপন্যাস লেখায় নিজেকে সপে দিলেন। তার লেখনি সৃষ্টি করতে লাগল একের পর এক বিভিন্ন স্বাদের গল্প!
আঠাড়োশ’ আশি খ্রিস্টাব্দে মপাসাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘Des vers’ প্রকাশিত হয়। তার কাব্যগ্রন্থটির অধিকাংশ কবিতার মধ্যেই জীবনের অশালীন ও কদর। দিককে পরিস্ফুট করে তোলা হয়েছে! মজুহাত দেখিয়ে ফরাসি সরকার তাঁর কাব্যগ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করবেন বলে হুমকী দেন। মপাসাঁ এতে এতটুকুও দমলেন না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেটা বাজেয়াপ্ত হয় নি।
মপাসাঁর সাহিত্যচর্চা নিজস্ব পথে, স্বকীয়তা অব্যাহত রেখে এগিয়ে চলল। এ সময়েই তিনি প্রখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক ফ্লোবেয়র-এর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন। তখনকার দিনে ফরাসি কবি ও সাহিত্যিকদের কাছে তিনি ছিলেন সাহিত্য জগতের একজন দিকপাল।
কৈশোরে মায়ের সাহায্যে শেকসপিয়রের সাহিত্যকর্মের সঙ্গে পরিচয়, তারপর ফ্লোবেয়র-এর লেখার সঙ্গে পরিচয় ও প্রীতি লাভ তার সাহিত্য-সাধনার পাথেয় হয়ে উঠল। সংক্ষেপে বলতে গেলে সাহিত্য-সাধক ফ্লোবেয়র ছিলেন তার সাধনার একমাত্র লক্ষ্য, একমাত্র আদর্শ। স্বনামধনা সাহিত্যিক ফ্লোবেয়র-এর কাছে নিয়মিত যাতায়াতের মাধ্যমে তৎকালীন খ্যাতনামা ফরাসী সাহিত্যিক জোলা, দোদে এবং তুর্গেনিভ প্রভৃতির সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে।
১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে জোলা নিজের একটি গল্পসহ কিছু সংখ্যক তরুণ উদীয়মান লেখকদের গল্পের একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করেন। সংকলন গ্রন্থটির নাম দিলেন—“Les soire’es de me’man’- এতে মপাসাঁ ‘Boule de Suif’ নামক গল্পটি স্থান পায়। সংকলন গ্রন্থটিতে ছাপা মপাসাঁর গল্পটি তাঁকে অচিরেই সাহিত্য-রসিকদের কাছে বিশিষ্ট করে তুলল।
আঠারোশ’ আশি থেকে আঠারোশ’ একানব্বই খ্রিস্টাব্দ—এই দশ বছরেই মপাসাঁ বিশ্বের ছোটগল্পকে একশ’ বছর এগিয়ে দিলেন কেবলমাত্র ফরাসী দেশের গল্পকাররাই নয়, পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশের সাহিত্য রসিকরা তার লেখার বিশেষ ভঙ্গী ও আঙ্গিককে অনুসরণ করে গল্প রচনায় ব্রতী হলেন। এবার মপাসাঁর কয়েকটি গল্প পন্ডিতদের দ্বারা সমাদৃত হওয়ায় তার গল্প বেশ কয়েকটি শ্রেণির পাঠ্য তালিকায় স্থান পেল।
সাহিত্য সৃষ্টি করে কেবলমাত্র খ্যাতিলাভই নয়, তাঁর অর্থাগমও যথেষ্টই হতে লাগল যে মপাসাঁ একদিন পেটের জ্বালা নেভাতে, অর্থোপার্জনের জন্যে যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষের বুকের রক্ত ঝরিয়েছেন আজ তিনিই লেখনীর মাধ্যমে অগাধ অর্থের মালিক হলেন? সে আমলের সাহিত্যিকদের কাছে তিনি এক প্রতীক রূপে চিহ্নিত হলেন। সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে যে এমন বিপুল অর্থোপার্জন সম্ভব এটা সে যুগের খ্যাতিমান অন্যান্য সাহিত্যিকদের ধ্যান ধারণা বহির্ভূত ছিল। তবে এ অর্থ তিনি সম্পূর্ণ নিজের জন্য ব্যয় করেন নি বা ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করেও রাখেন নি। প্রতিবেশীদের অভাব অনটন ও দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য তিনি দরাজ হাতে অর্থ ব্যয় করতেন। আবার দুস্থ কবি ও সাহিত্যিকরাও তার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়ে ধন্য হয়েছেন।
জীবনের শেষের দিকে কঠোর পরিশ্রম ও রাত্রি জাগরণ তার শরীর বরদাস্ত করল না। শারীরিক ব্যাধির কবলে পড়লেন তিনি। দুরারোগ্য উপদংশ বাধি এবার তাঁকে আক্রমণ করে বসল। তখনকার দিনে ইউরোপ মহাদেশে এ-ব্যাধির চিকিৎসা-ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয় নি। ফলে রোগ জীবাণু প্রথমে তার শরীরকে নিস্তেজ করে দিতে লাগল। যন্ত্রণাদায়ক ব্যাধির কবল থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য বহু প্রখ্যাত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন তিনি। না, রোগ নিরাময়ের কোনো লক্ষণই দেখা গেল না। উপরন্তু তার শারীরিক ব্যাধির প্রকোপ তার মনের ওপর ক্রিয়া করতে শুরু করল। শরীরের সঙ্গে মনও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ল। দৃষ্টিশক্তি ক্রমেই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে লাগল। তার মাথার ওপরে প্রতিনিয়ত হতাশার শকুন চক্কর মারতে লাগল।
ইতিমধ্যে তাঁর অনুজ উন্মাদদশা প্রাপ্ত হয়ে পাগলা গারদে আশ্রয় নিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তার মৃত্যুও হয়ে গেল। মপাসাঁ আতঙ্কিত হলেন, তাঁকেও হয়ত মানসিক সুস্থতা হারিয়ে শেষ পর্যন্ত উন্মাদই হয়ে যেতে হবে। ক্রমবর্ধমান মানসিক অস্থিরতা তাঁকে আত্মহত্যার প্রেরণা জোগাল। তিনি দুবার আত্মহননের চেষ্টাও করলেন। কিন্তু না, সম্ভব হলো না। তার সদা সতর্ক পরিচারক দু’বারই তাকে রক্ষা করল। প্রাণে বাঁচানো গেলেও তাকে অনুজের মত উন্মাদ আশ্রমে আশ্রয় নেওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা গেল না। বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায় আশ্রমের চার দেওয়ালে ঘেরা ছোট্ট খুপরির মধ্যে আশ্রয় নিতে হলো।
আঠারোশ’ তিরানব্বই খ্রিস্টাব্দে, মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে দেহমনে জীর্ণ অবসন্ন মপাসাঁ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করলেন।
সাহিত্য-সাধক মপাসা ছিলেন উনিশ শতকের এক বিস্ময়। মাত্র তেতাল্লিশ বছরের জীবনে তিনি বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে রীতিমত ঝড় তুলে গেছেন। গবেষকগণ বিচার করবেন, মপাসাঁ আমৃত্যু কিসের সন্ধানে হন্যে হয়ে ছুটেছেন? একমাত্র নারীদেহকেই কি তিনি মনে প্রাণে চেয়েছেন, নাকি দেহাতিরিক্ত প্রেমের পুজারী ছিলেন তিনি? যে, যা-ই বলুন না কেন, অভিজাত সমাজে নষ্টামি ও ভন্ডামির মূলে কঠিন কঠোর আঘাত হানা, অবহেলিত নিষ্পেষিত মানুষকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তার সাহিত্য সৃষ্টির মূল লক্ষ্য। ইতিমধ্যে পৃথিবীতে বহু পরিবর্তনের জোয়ার এসেছে, কবি ও সাহিত্যিকদের চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন এসেছে! আজ, বিংশ শতকের শেষেও মপাসাঁ অসাধারণ জনপ্রিয় লেখক হিসাবে গণ্য হন।
মপাসাঁ সারা জীবনে সাতটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস এবং প্রায় আড়াইশ’টি ছোটগল্প রচনা করেছেন। পৃথিবী বিখ্যাত সাহিত্যিক তলস্তয়, জোহান বয়ার এবং বিখ্যাত সমালোচক লুকাস তার সাহিত্যসৃষ্টির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
তথ্যসূত্র
১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ১৫৩-১৫৬।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।