মার্কো পোলো একজন ভেনিসীয় বণিক, অনুসন্ধানকারী এবং লেখক

মার্কো পোলো (ইংরেজি: Marco Polo; ১৫ সেপ্টেম্বর, ১২৫৪ – ৮ জানুয়ারী, ১৩২৪) একজন ভেনিসীয় বণিক, অনুসন্ধানকারী এবং লেখক ছিলেন যিনি ১২৭১ এবং ১২৯৫ সালের মধ্যে সিল্ক রোড ধরে এশিয়ার মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করেছিলেন। তার ভ্রমণগুলি দ্য ট্রাভেলস অফ মার্কো পোলো গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। বইটি ইউরোপীয়দের কাছে তৎকালীন প্রাচ্যের রহস্যময় সংস্কৃতি এবং অভ্যন্তরীণ কার্যাবলী বর্ণনা করে, যার মধ্যে মঙ্গোল সাম্রাজ্য এবং চীনের ইউয়ান রাজবংশের সম্পদ এবং বিশাল আকারকে তুলে ধরেছে। বইটি চীন, পারস্য, ভারত, জাপান এবং অন্যান্য এশিয়ান শহর এবং দেশগুলি সম্পর্কে প্রথম ব্যাপক বিবরণ দেয়।

মার্কো পোলো ১২৫৪ খ্রিস্টাব্দে ভেনিস শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা নিকোলো পোলো ভেনিসের একজন বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। পিতা ও কাকার সঙ্গে মার্কো পোলো ১২৭১ খ্রিস্টাব্দে মাত্র সতেরো বছর বয়সে পোপ দশম গ্রেগরীর দূতরূপে চীন দেশে আসেন।

দেশ থেকে যাত্রা করে আর্মেনিয়া, ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়ার মালভূমি, তুর্কিস্তান, গোবি মরুভূমি প্রভৃতি পার হয়ে চীন দেশে পৌঁছতে তাঁদের দীর্ঘ চার বছর সময় লেগেছিল। তৎকালীন চীন সম্রাট কুবলাই খান তাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানান। তিনি দীর্ঘ সতেরো বছর ১৩১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চীন সম্রাটের অধীনে কাজ করেছিলেন।

ইউরোপীয় পর্যটকদের মধ্যে মার্কো পোলোই সর্বপ্রথম ভ্রমণকাহিনী লেখেন বলে জানা যায়। মার্কো পোলোর লিখিত বিবরণ থেকে সমসাময়িক কালের ভারতবর্ষ, চীন দেশ ও এশিয়ার অনেক দেশ সম্পর্কে বহু মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দে মার্কো পোলোর মৃত্যু হয়।

পর্যটক মার্কো পোলো রচিত ভ্রমণ বৃত্তান্ত

১২৭১ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি বাবা নিকোলো পোলো আর কাকা মেফিয়ো পোলোর সঙ্গে আর্মেনিয়ার লায়াস বন্দর থেকে মার্কো পোলোর স্থল যাত্রা শুরু হয়। পোলোরা শুনেছিলেন এশিয়া নামে একটি বড় দেশ আছে। সে দেশের রাস্তাঘাট নাকি সোনা দিয়ে মোড়া। আর সেই দেশের একচ্ছত্র অধিপতি সম্রাট কুবলাই খান। তাঁর প্রাসাদ নাকি স্বর্গরাজ্যকেও হার মানায়।

এই জনশ্রুতির ওপর নির্ভর করে বাবা ও কাকার সঙ্গে অজানা দেশের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন মার্কো। তাঁদেরই এক বন্ধু কুল্লাউ হন তাদের পথপ্রদর্শক। ক্রমে তারা কোগানি, কাইসারা, সারাস্তা, আরজিনগন পার হয়ে কুর্দস্থানে এসে পোঁছলেন। সেখান থেকে জর্জিয়ায়। এখানেই তারা রক্তপায়ী অ্যাভিগি শকুন দেখতে পান। এই অতিকায় পাখিগুলো ঘোড়া গাধা অবলীলাক্রমে থাবায় আঁকড়ে তুলে নিয়ে যায়।

জর্জিয়া থেকে যাত্রা শুরু হয় পারস্যের দিকে। বাগদাদের বসরা বাণিজ্যকেন্দ্রে পেীছে মার্কোরা কুবলাই খানকে উপহার দেওয়ার জন্য দুটি বহুমূল্য মুক্তোর মালা কিনলেন। বসরা থেকে পারস্য উপসাগর অতিক্রম করে কেরমান শহরে যাবার পথে একদল দস্যুর হাতে পড়লেন তারা। অনেক কিছুই হারাতে হলো। তবে ভাগ্যক্রমে মুক্তোর মালা দুটি বেঁচে গেল ।

পারস্য উপসাগরের ভেতর দিয়ে অনেক কষ্ট স্বীকার করে তারা উপস্থিত হলেন আর্মজ প্রণালীর বন্দর আবাসে। এখান থেকে পশ্চিম তাতার প্রদেশের শাসনকর্তার কাছে সম্রাটের সনদ দেখিয়ে তারা একশ রক্ষীর সাহায্য পেলেন। দীর্ঘ মরুপথে এই রক্ষীরাই তাদের রক্ষা করবে।

কয়েকটি উট কিনে নিয়ে দীর্ঘ মরুপথ পায়ে হেঁটে পার হয়ে বাম শহরের পথে তারা আবার পড়লেন ডাকাতের হাতে। বেশ কিছু জিনিসপত্রের সঙ্গে কুন্নাউসহ পাঁচ জন সঙ্গীকে ধরে নিয়ে গেল ডাকাতরা।

এগিয়ে চলার বিরাম নেই তবু মার্কোদের। ক্রমে ক্রমে পেছনে ফেলে এলেন কোহিস্তানের পর্বতমালা, কাশগড় ইয়ারখন্দ, খেটান, পিয়েন, কারাকোরাম, কিউনলুন। এরপর দীর্ঘ এক মাসে পাড়ি দিলেন বিপজ্জনক তাকামাকান মরুভূমি। এসে পৌঁছলেন টাঙ্গুর হামি শহরে। তারপর কান সু, সু-চৌ পার হয়ে পৌঁছলেন কান-চৌ শহরে। এখান থেকেই শুরু হয়েছে চীনের বিখ্যাত প্রাচীর। মহামান্য কুবলাই খানের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি এখান থেকেই। সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবার জন্য এখানে কয়েকদিন ব্যয় হলো সম্রাটের ছাড়পত্র সংগ্রহ করতে। তারপর তারা যাত্রা করলেন অভীপ্সিত পথের দিকে।

মাঝ পথেই সম্রাটের লোকেরা সাড়ম্বরে তাদের অভার্থনা করে নিয়ে গেল। রাজপ্রাসাদের তোরণ অতিক্রম করতেই মার্কোরা দেখতে পেলেন তোরণের দুইধারে অজস্র সান্ত্রী পরিবেষ্টিত স্বয়ং সম্রাট কুবলাই খান অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন মার্কোদের। তাদের মনে হলো, এত আনন্দ, এত অভ্যর্থনা, এত সম্মান তারা জীবনে আর কোথাও পাননি। তারা যেন এক রূপকথার রাজ্যে এসে পৌঁছেছেন।

মার্কো কুবলাই খান-এর দরবারে একটা সামান্য চাকুরি পেয়ে গেলেন। তারপর দেখতে দেখতে কুড়ি বছর কেটে গেল। ইতিমধ্যে মার্কো রাজ দরবারের কর্মচারীদের মধ্যে সবার প্রিয় হয়ে উঠেছেন। স্বভাবের নম্রতায়, আলাপের মাধুর্যে এবং বুদ্ধির চাতুর্যে তার সমকক্ষ আর কেউ ছিল না।

সম্রাট কুবলাই খান-এর দক্ষিণ হস্ত হয়ে উঠলেন মার্কো। মার্কোর বুদ্ধি পরামর্শ ছাড়া সম্রাটের এক মুহূর্ত চলে না, কি রাজদরবারে কি অন্দর মহলে। কিন্তু মার্কোর এই একচ্ছত্র প্রতাপে রাজ দরবারের বেশকিছু কর্মচারী অসন্তুষ্ট হলেন। তারা মার্কোকে হিংসা করতে শুরু করলেন। ঘৃণা ও বিদ্বেষের মনোভাব দেখা দিল তাদের মধ্যে। অচিরেই তারা মার্কোর চরম শত্রু হয়ে দাঁড়ালেন। এদের মধ্যে প্রধান ছিলেন তাউলুং। তাউলং মার্কোকে অপদস্থ করবার চক্রান্ত করেও শেষ পর্যন্ত কিছু করে উঠতে পারলেন না। মার্কোর তেজস্বিতা, ঐকান্তিক নিষ্ঠা এবং বুদ্ধির চাতুর্যে তাউলং সহজেই পরাজিত হলেন এবং ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে দেশ থেকে বহিষ্কৃত হলেন। তাউলুং দেশত্যাগী হয়েও মার্কোর প্রতি প্রতিশোধ নিতে ভুললেন না। তিনি নানা রকম ফন্দিফিকির খুঁজতে লাগলেন।

মার্কো সেই সময় ফিয়াংনান প্রদেশের গভর্নর। মূল ঘাঁটি থেকে এই প্রদেশটি দীর্ঘ ছয় মাসের পথ। ফলে এতদূর থেকে এই প্রদেশের শাসনকার্য চালানো খুব একটা সহজসাধ্য ছিল না। তাছাড়া একজন বিদেশীর শাসনকার্য পরিচালনা কিয়াংনান প্রদেশের প্রজারা মেনে নিলেও পাশের দেশ চেয়নবেনের রাজা তা মেনে নিতে পারলেন না। ফলে তিনি তাউলুং-এর প্ররোচনায় কিয়াংনান আক্রমণ করে বসলেন।

তাউলুং চেয়নবেনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে একদল সৈন্য নিয়ে গুপ্তপথে অগ্রসর হতে লাগলেন মার্কোর শিবিরের দিকে। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে তাউলুং একজন বিশ্বস্ত লোককে পাঠালেন মার্কের গোপন আস্তানা খুঁজে বের করবার জন্য। সেই লোকটি আর কেউ নয়, কেরম্যানের পথে দস্যু কর্তৃক অপহৃত কুল্লাউ। অপহরণ করে দস্যুরা প্রথমে তাকে দাস-ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেখান থেকে কোনর এবং কোমর থেকে হাতবদল হয়ে চেয়ানবেনের শাসনকর্তার সৈন্য বিভাগে স্থান পায় কুন্নাউ। কিন্তু কুন্নাউ-এর মনে ছিল মার্কোর প্রতি অপরিসীম স্নেহ ও ভালবাসা। তাই যখন তাউলং তাকে গুপ্তচর করে মার্কোর শিবিরের সন্ধানে পাঠালেন, তখন কুল্লাউ মনের আনন্দে মার্কোর কাছে গিয়ে খুলে বললেন তাউলুং-এর উদ্দেশ্য; সন্ধান দিলেন গোপন পথের।

মার্কো অবিলম্বে শত্রুমুক্ত হলেন। কিন্তু এবারে দীর্ঘদিন পর দেশের জন্য তাঁর মন অস্থির হয়ে উঠল। নিকলো এবং মেফিয়ো দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকায় দেশে ফিরবার জন্য তাঁরাও অনেক দিন থেকে উন্মুখ হয়ে ছিলেন। কিন্তু কুবলাই খান কিছুতেই মার্কোদের ছাড়তে রাজি হলেন না।

সম্রাটের দূরসম্পর্কীয় এক ভাইপো ছিলেন পারস্যে। তার নাম অরগন খাঁ। তার পত্নী বলগান খাতুন চেঙ্গিজ খান-এর পুত্র জজাতির কন্যা। তিনি হঠাৎ ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দে পরলোক গমন করলেন। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তিনি অরগন খাকে এই প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন যে, তাঁর অবর্তমানে তার নিকট আত্মীয়া ছাড়া আর কেউ রাজ মহীষীর স্থান দখল করতে পারবে না এবং সেই পত্নী নির্বাচন করবে তাতার সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি কুবলাই খান! বলগান খাতুনের মৃত্যুর পর অরগন খাঁ তার এই প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করবার জন্য কুবলাই খান-এর কাছে তিনজন রাজকর্মচারীকে পাঠালেন। কুবলাই খান নির্বাচন করলেন কোগতিন নামে ষোল বছরের এক তরুণীকে। কিন্তু পাঠাবেন কার সঙ্গে? তখন ট্রান্স অক্সিয়ানার একটি ছোট প্রদেশে জজাতির এক বংশধরের সঙ্গে কুবলাই খান-এর এক ভাই-এর তুমুল যুদ্ধ চলেছে। তাই তিনি এই পথে অরগন খাঁ-এর তিনজন মাত্র কর্মচারীর সঙ্গে কোগাতিনাকে ছেড়ে দেওয়া সঙ্গত মনে করলেন না।

কুবলাই খান মার্কোদের হাতে কোগাতিনের সমস্ত দায়-দায়িত্ব অর্পণ করলেন এবং সর্ত রইল কোগাতিনকে পারস্যে পৌঁছে দিয়ে দেশের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করে যত শীঘ্র সম্ভব মার্কোরা আবার ফিরে আসবেন এদেশে।

কুবলাই খান-এর এই শর্ত মার্কেরা সহজ ভাবেই মেনে নিলেন। ১২৮৯ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে হীরে-জহরৎ মণি-মুক্তো এবং দানসামগ্রী বোঝাই জাহাজে উঠলেন কোগাতিন ও মার্কোরা। সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে চোদ্দটি জাহাজ ভাসল অকুল দরিয়ায় আর এক মহাদেশের উদ্দেশ্যে।

একটানা চার বছর ক্রমাগত ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলেন তারা। একে একে যবদ্বীপ, জাভা, সুমাত্রা পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে দিয়ে আন্দামান ও সিংহল দ্বীপ হয়ে যখন তাঁরা সোজা পারস্য উপসাগরের মধ্যে হরমোজের বিখ্যাত বন্দরে এসে পৌঁছলেন ততদিনে তাদের অনেক লোক মারা গিয়েছে। মারা গিয়েছে অরগন খা-এর বিশিষ্ট দুজন কর্মচারীও। অরগন খাঁ নিজেও তখন পরলোকে। কুমার গাজান-এর সঙ্গে কোগাতিনের বিয়ে দিয়ে মার্কোরা দায়ভার থেকে মুক্ত হলেন। ইতিমধ্যে তাদের কাছে পৌঁছল এক দুঃসংবাদ। তাতার সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি সম্রাট কুবলাই খান পরলোক গমন করেছেন। তারপর একদিন দীর্ঘ বাইশ বছর পর মার্কেরা জাহাজ ভাসিয়ে ফিরে চললেন দেশে।

তথ্যসূত্র

১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৯৮৯-৯৯২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!