লীলা নাগ ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী, লেখিকা

লীলা নাগ (জন্ম: অক্টোবর ২, ১৯০০ – মৃত্যু:জুন ১১ ১৯৭০) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের নারী বিপ্লবী। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী। নারীশিক্ষার জন্য নানা সেবামূলক কাজ করেছেন। 

তিনি ‘দীপালী সংঘ’ গঠন করেন মেয়েদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞানী করে তোলার জন্য। তিনি প্রথমে কংগ্রেসে যুক্ত থাকেন এরপরে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ সংগঠনে যুক্ত হন। রাজনৈতিক কাজের জন্য তাঁকে অনেক দিন কারাবরণ থাকতে হয়েছে।[১]

জন্ম ও পরিবার:

১৯০০ সালে লীলা নাগ জন্ম গ্রহণ করেন আসামের গোয়ালপাড়ায়। ভারতে জন্মগ্রহণ করলেও পিতৃভূমি ছিল সিলেটে। তার পিতা নাম ছিল গিরীশচন্দ্র নাগ ও মাতা কুঞ্জলতা নাগ ।

পিতা বাংলা ও আসামের সিভিল সার্ভিসে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন সেবাব্রতী, তেজস্বী ও ন্যায়পরায়ণ। পরবর্তী জীবনে তিনি ভারতীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়ে লবণ-করের প্রতিবাদে একবছর পরেই পদত্যাগ করেন।

মাতামহ প্রকাশচন্দ্র দেব ছিলেন আসাম সেক্রেটারিয়েটের প্রথম ভারতীয় রেজিস্ট্রার। তিনি ছিলেন সত্যনিষ্ঠ ও পরোপকারী।

লীলা নাগের বিদুষী মা শৈশব থেকেই কন্যাকে শিখিয়েছিলেন যে, ত্যাগের মধ্য দিয়েই সেবা করতে হয়। মায়ের শিক্ষায় মহৎ জীবনের আদর্শ কন্যাকে সকল কর্মে প্রবুদ্ধ করত। পিতা ও মাতামহ সরকারী চাকুরিয়া হওয়া সত্ত্বেও লীলা নাগ শৈশবাবধি ১৯০৫ সাল থেকেই দেখতেন বাড়ীতে বিলিতী কাপড় বর্জন এবং ‘বঙ্গলক্ষ্মী’র মোটা কাপড় বরাদ্দ হয়েছে। ক্ষুদিরামের ফাঁসির দিনে অশ্রু ও অরন্ধনের মধ্য দিয়ে এই পরিবার বাংলার সেই প্রথম শহীদের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

কিশোরী লীলা নাগকে তাঁর বাবা, মা ও মাতামহ শুনাতেন দেশবিদেশের কাহিনী এবং নানা দেশের উত্থান-পতনের ইতিহাস। ম্যাটসিনি, গ্যারিবন্ডি ও নেপোলিয়ানের জীবনের ঘটনাবলী তার কিশোর মনে গভীর ছাপ ফেলে যেতো। এই আদর্শনিষ্ঠ পরিবারের শিক্ষা লীলা নাগকে জাতীয়তা ও স্বাদেশিকতার ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তোলে।

লীলা নাগ-এর শিক্ষাজীবন:

তিনি ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে কলিকাতার বেথুন কলেজ থেকে ১৯২১ সলে বিএ. পাস করেন এবং মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে ‘পদ্মাবতী স্বর্ণপদক’ লাভ করেন।

তাঁর পিতা ঢাকাতে স্থায়ী বাসস্থান স্থাপন করেন। লীলা নাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. পড়তে চলে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনো সহশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না বলে তাকে প্রথমে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়নি।

কিন্তু লীলা নাগেব দৃঢ়তা ও শিক্ষার আকাঙ্ক্ষা শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. ক্লাসে সহশিক্ষার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাস করেন ১৯২৩ সালে। ছাত্রজীবনেই তিনি নানা প্রকার সংগঠনমূলক কাজে অগ্রণী ছিলেন। বেথুন কলেজের ছাত্রী রি-ইউনিয়ন গড়ে ওঠে যাদের প্রচেষ্টায় লীলা নাগ তাদের অন্যতম।

দীপালী সংঘ:

১৯২১ সালে ‘নিখিল বঙ্গ নারী ভোটাধিকার কমিটির সহ-সম্পাদিকা’রূপে তিনি নারীর সামাজিক ও আর্থিক অধিকার সম্বন্ধে জনমত গঠনের জন্য নানা সভাসমিতির আয়োজন করেন। ১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলন লীলা নাগের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।

১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি ঢাকাতে বারোজন সহকর্মীর সঙ্গে ‘দীপালী সংঘ’ নামে একটি মহিলা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি ছিলে সে প্রতিষ্ঠানের সম্পাদিকা। ‘দীপালী স্কুল’ নামে একটি উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ও তিনি স্থাপন করেন।

ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ‘দীপালী সংঘ’-র উদ্যোগে বারোটি অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুল এবং পবে ‘নারী শিক্ষামন্দির’ ও ‘শিক্ষাভবন’ নামে আরো দুটি ইংরেজি উচ্চবিদ্যালয় তিনি স্থাপন করেন। ঢাকায় স্ত্রীশিক্ষা প্রচার ও ব্যবস্থার ব্যাপারে লীলা নাগের অবদান অতুলনীয়।

শিক্ষা-বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ১৯২৪ সালে ‘দীপালী’ শিল্প প্রদর্শনী নামে একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। এই প্রদর্শনী ‘দীপালী সংঘ’- একটি বাৎসরিক অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে মেয়েদের হাতের কাজ, শিল্প ও অন্যান্য কারিগরি কাজের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হতো। তখনকার দিনে এরূপ প্রদর্শনী অভিনব ছিল ।

১৯২৫ সালে তিনি ‘শ্রীসংঘ’ নামে বিপ্লবী দলের সংস্পর্শে আসেন এবং এই বিপ্লবী দলে যোগদান করেন। ১৯২৬ সালে তিনি ঢাকায় ‘দীপালী ছাত্রী সংঘ’ নামে একটি ছাত্রীদের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। পরে এর শাখা বাংলা ও আসামের নানা স্থানে বিস্তৃত হয় ।

১৯৩০ সালে মেয়েদের সহজভাবে চলাফেরা এবং মেলামেশা খুব অসুবিধাজনক ছিল। মহিলা-কলেজের আবাসিকাগুলির নিয়ম অত্যন্ত কঠোর ছিলো।

রাজনৈতিক ভাবাপন্ন ছাত্রীরা বিশেষ অসুবিধা ভোগ করতেন। এই অসুবিধা দূর করবার জন্য এবং বিশেষভাবে ‘দীপালী সংঘ’য়ের সহিত যুক্ত কর্মীদের ও ছাত্রীদের মেলামেশার সুযোগ সৃষ্টির জন্য লীলা নাগের পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘ছাত্রীভবন’ নামে একটি ছাত্রী-আবাসিকা কলিকাতায় খোলা হয়।

এই ‘ছাত্রীভবন’ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় লীলা নাগের সহকর্মী রেণু সেন অসাধারণ কর্মকুশলতা ও সংগঠনী শক্তির পরিচয় দেন।

১৯২৭-২৮ সালে যখন পূর্ববঙ্গে ব্যাপক নারীনিগ্রহ অনুষ্ঠিত হয় তখন সেসম্পর্কে নিগৃহীত নারীদের আশ্রয়দান, তাদের মামলা পরিচালনায় সাহায্য এবং সাধারণভাবে নারীদের মধ্যে সাহস ও আত্মরক্ষার ভাব উদ্বুদ্ধ করবার জন্য লীলা নাগ ‘নারী আত্মরক্ষা ফান্ড’ নামে একটি ফান্ড খোলন।

মহিলাদের আত্মরক্ষার কৌশল শিক্ষা দেবার জন্য এবং মানসিক শক্তি বিকাশের জন্য ঢাকায় ও অন্যান্য স্থানে মেয়েদের মধ্যে লাঠি খেলা, ছোয়া খেলা, জুজুৎসু প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে শরীরচর্চার ব্যবস্থা করেন। ঢাকায় এসব শিক্ষা দিতেন আশুতোষ দাশগুপ্ত, কলিকাতায় পুলিন দাস।

“দীপালী সংঘ’-র মাধ্যমে নারী-শিক্ষার ব্যবস্থাকে আরো প্রসারিত করার জন্য তিনি ‘গণশিক্ষা পরিষদ’ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।

জয়শ্রী মুখপত্র:

১৯৩০ সালে লীলা নাগের সম্পাদনায় ‘জয়শ্রী’ নামে মহিলাদের একটি মুখপত্র রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী নিয়ে প্রকাশিত হয়। এটি মহিলাদের দ্বারাই পরিচালিত ছিলো এবং এর লেখকগোষ্ঠীও গঠিত ছিলো প্রধানত  মহিলাদের দ্বারাই।

বিভিন্ন সময়ে ‘জয়শ্রী’র সম্পাদিকা ছিলেন লীলাবতী নাগ ( রায়) বৈশাখ ১৩৩৮-চৈত্র ১৩৩৮, আষাঢ় ১৩৪৫ চৈত্র ১৩৪৮, ফাল্গুন ১৩৫৩–মাঘ ১৩৫৬, বৈশাখ ১৩৫৭–অদ্যাবধি (১৩৬৯ পর্যন্ত)।
শকুন্তলা দেবী ( রায়) বৈশাখ ১৩৩৩ আশ্বিন ১৩৪০ পর্যন্ত।
বীণাপাণি রায় কার্তিক ১৩৪৩, চৈত্র ১৩৪ পর্যন্ত।
উষাবাণী রায় বৈশাখ ১৩৪১-চৈত্র ১৩৪২ পর্যন্ত।

লীলা নাগ যখন জেলে ছিলেন সেসময়ে উক্ত তিনজন সম্পাদিকা ছিলেন। এছাড়া বৈশাখ ১৩৪৩-জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৫ পযন্ত এবং বৈশাখ ১৩৪৯- মাঘ ১৩৪৩ পর্যন্ত সরকার কর্তৃক ‘জয়শ্রী’ প্রচার বন্ধ ছিল।

রাজনৈতিক কাজ:

১৯৩০ সালে লবণ সত্যাগ্রহেব সময় লীলা নাগ ঢাকার মহিলাদের নিয়ে ‘ঢাকা মহিলা সত্যাগ্রহ সমিতি’ গঠন করেন। তারা ঢাকা শহর ও জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে সভাসমিতিতে প্রকাশ্যে লবণ তৈরী করে লবণ আইন ভঙ্গ করেন।

এই সময় গান্ধিজীর ডাণ্ডি অভিযান ও তার পটভূমি-সংক্রান্ত তথ্যাবলী নিয়ে ৮০টি বিভিন্ন ছবি ও গান্ধীর বাণী এবং চিঠির অনুলিপির স্লাইড তৈরী করে;

ম্যাজিক-ল্যান্টার্ন মারফত মহিলাগণ ঢাকা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে সত্যাগ্রহের বাণী প্রচার করেন এবং সত্যাগ্রহে যোগদান করবার উৎসাহ সৃষ্টি কবেন। রেণু সেন, বীণা রায়, শকুন্তলা চৌধুরী প্রভৃতি কর্মিগণ এই ম্যাজিক ল্যান্টার্ন পরিচালনায় অগ্রণী ছিলেন।

১৯৩০ সালে শ্রীসংঘ’র দলনেতা অনিল রায়ের গ্রেপ্তারের পর সমগ্র দলের পরিচালনার দায়িত্ব এসে পড়ে লীলা নাগের উপর। ১৯৩১ সালের ২০শে ডিসেম্বর লীলা নাগ ও রেণু সেনকে ডেটিনিউ করে জেলে আটক রাখা হয়।

এই সময় লীলা নাগের আরো যেসমস্তু মহিলা সহকর্মী ডেটিনিউ অর্থাৎ রাজবন্দীরূপে কাবারুদ্ধ ছিলেন, তারা হচ্ছেন সুশীল দাশগুপ্ত, প্রমীলা গুপ্ত ও হেলেনা দত্ত।

লীলা নাগ রাজবন্দী হবার পর শকুন্তলা রায়, সুরমা দাস প্রভৃতির উপর বাংলাদেশ হ’তে বহিষ্কারের আদেশ হয়। এ ছাড়া তার অন্যান্য সহকর্মীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন উষা রায়, বীণা রায়, সীতা সেন, অনুপমা বসু, লতিকা দাস (সেন), রেণুকণা দণ্ড প্রভৃতি। রেণু সেনের ছিল সংগঠনী শক্তি এবং শকুন্তলা দেবীর ছিল তীক্ষ্ণধী ও যুক্তিবাদী মন।

১৯৩৭ সালের অক্টোবর মাসে লীলা নাগ মুক্তি পান। ১৯৩৯ সালে লীলা নাগ ও অনিল রায় পরস্পরকে জীবনসঙ্গীরূপে গ্রহণ করেন। এই সময় গুপ্ত বিপ্লববাদের যুগ শেষ হয়ে রাজনীতিক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী দেখা দেয়।

লীলা রায় ও অনিল রায় তখন জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে সম্পূর্ণ প্রকাশ্যভাবে ব্যাপক জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার কর্মপন্থা গ্রহণ করেন।

১৯৩৭ সালের শেষের দিকে যখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বন্দিগণ ব্যাপকভাবে মুক্ত হন তখন কংগ্রেস ও তার কার্যাবলীকে নতুনভাবে সংগঠিত করবার প্রশ্ন এলো।

সেসময় রাজনৈতিক মহিলাগণ একটি সম্মিলিত সংস্থাতে মিলিত হবার কথা চিন্তা কবেন। প্রদেশের বিভিন্ন কংগ্রেস-মহিলা-কর্মীদেব আলাপ-আলোচনার পর তারা ‘কংগ্রেস মহিলা সংঘ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

স্থির হয় যে, এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সাক্ষাৎ সংযোগ রক্ষা করা হবে, কংগ্রেস মহিলা সাব-কমিটি’র মারফত। ‘কংগ্রেস মহিলা সাব কমিটি’ পূর্বেই গঠিত হয় ১৯৩৭ সালে। লাবণ্যলতা চন্দ ছিলেন তার সেক্রেটারি।

উপরোক্ত পরিকল্পনাটি লীলা নাগ উত্থাপন করেন এবং কংগ্রেস কর্মিগণ সাগ্রহে সমর্থন করেন। তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু এই পরিকল্পনাকে উৎসাহের সঙ্গে সমর্থন করেন।

১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে কলিকাতায় বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে সমাগত মহিলাদের নিয়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস মহিলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

এই সম্মেলনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস মহিলা সংঘ’ গঠনের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। তার সভানেত্রী নির্বাচিত হন মোহিনী দেবী এবং সেক্রেটারি লাবণ্যলতা চন্দ।

ত্রিপুরী কংগ্রেসের পরে বাংলা কংগ্রেস দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায়। তার ফলস্বরূপ ‘কংগ্রেস মহিলা সংঘ’-র কাজ একবছরের বেশী অগ্রসর হতে পারে নাই।

ফরওয়ার্ড ব্লকে যুক্ত:

১৯৩৮ সালে কংগ্রেস-সভাপতিরূপে নেতাজী সুভাষচন্দ্র কর্তৃক যে জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গঠিত হয়, সেই কমিটিতে লীলা রায় বাংলাদেশ থেকে মহিলাসাব-কমিটির সভ্য মনোনীত হন এবং পরিকল্পনা-কমিশনের কাছে বাংলার তরফ থেকে একটি সুচিন্তিত রিপোর্ট পেশ করেন।

১৯৩৯ সালের জুন মাসে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ গঠিত হয়। লীলা রায় ও অনিল রায় নেতাজী সুভাষচন্দ্রের অন্যতম সহযোগীরূপে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁদের সহকর্মীরাও সকলেই ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগদান করেন।

১৯৪০ সালের জুলাই মাসে হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের আন্দোলনে লীলা রায় ও অনিল রায় কারাবরণ করেন। সকলেই মুক্তি পান, কিন্তু সুভাষচন্দ্র কারান্তরালে রয়ে গেলেন।

তাঁরই নির্দেশে লীলা রায় মুক্তিলাভের পর ‘ফরওয়ার্ড ব্লক সাপ্তাহিকের সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। নেতাজীর ভারত-ত্যাগের পরেও কিছুকাল পর্যন্ত তিনি এই কাগজের সম্পাদনা করেন।

অন্তর্ধানের পূর্বে নেতাজী যে নির্দেশ দেন, সে অনুযায়ী শীলা রায় ও অনিল রায় ১৯৪০-৪১ সালে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লী ও মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ গঠন করার উদ্দেশ্যে এবং বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় জাতীয় আন্দোলন সংগঠনের জন্য ব্যাপকভাবে সফর করেন।

১৯৪১ সালে লীলা রায়ের উপর সভাসমিতিতে বক্তৃতা করা ও বাংলার বাইরে যাওয়া সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। ১৯৪২ সালের প্রথমদিকে অনিল রায়কে কারারুদ্ধ করা হয়।

ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হবার পর ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ দঙ্গকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়। সারা ভারতের ফরওয়ার্ড-ব্লকের কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হতে থাকে। ১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে লীলা রায়কে নিরাপত্তা বন্দীরূপে জেলে আটক রাখা হয়।

জয়শ্রী অফিস পুলিশ তালা লাগিয়ে বন্ধ করে দেয় এবং সমস্ত জিনিসপত্র ক্রোক করে। এবারে লীলা রায়ের সহকর্মীদের মধ্যে যারা জেলে নিরাপত্তা বন্দীরূপে আটক ছিলেন তারা হচ্ছেন লাবণ্য দাশগুপ্ত, হেলেনা দত্ত, শৈল সেন, গৌরী সেন, প্রভা মজুমদার, উমা গুহ, ছায়া গুহ ও আশা রায়। লীলা রায়কে প্রথমে দিনাজপুর জেগে ও পরে প্রেসিডেন্সি জেলে আটক রাখা হয়। ১৯৪৬ সালে তিনি মুক্তি পান।

আবার তিনি ‘জয়শ্রী’ ও ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং সংগঠনের কাজ করতে থাকেন। ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলার সাধারণ আসন থেকে তিনি ভারতীয় কস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হয়ে ভারতীয় সংবিধান রচনায় অংশগ্রহণ করেন।

১৯৪৬ সালে কলিকাতা ও নোয়াখালিতে দাঙ্গার পর লীলা রায় চলে যান নোয়াখলিতে-দুর্গতদের মধ্যে রিলিফের কাজ করতে। তিনি ন্যাশনাল সার্ভিস ইনস্টিটিউট’ নামে একটি সেবা-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং তারই সম্পাদিকা রূপে সেখানে শান্তি ও সেবাকার্যে নিযুক্ত থাকেন।

এর পরেই আসে ভারত-বিভাগের দুর্যোগ। বাংলা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। লীলা রায়ের সারাজীবনের প্রিয় কর্মভূমি ঢাকা ও পূর্ববঙ্গ ছেডে তাকে চিরকালের জন্য চলে আসতে হ’ল।

তার অদম্য প্রাণশক্তি এবং আদর্শনিষ্ঠা নিয়ে তিনি অদ্যাবধি জনসেবার কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রেখে চলেছেন। বর্তমানে তিনি প্রজা সোশ্যালিস্ট দলের সভানেত্রী।

হৃদয় ও মনের বহু উচ্চগুণে বিভূষিতা লীলা রায়কে রাজনৈতিক বাংলার, বিশেষতঃ পূর্ববাংলার নারী প্রগতির ইতিহাসে অনেক বিষয়ে পথিকৃতের সম্মান দেওয়া যায়।[২]

তত্থসুত্র:

১. দোলন প্রভা, ৪ আগস্ট , ২০১৯, “লীলা নাগ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিকন্যা”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএলঃ https://www.roddure.com/biography/lila-nag/

২. কমলা দাশগুপ্ত (জানুয়ারি ২০১৫)। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী, অগ্নিযুগ গ্রন্থমালা ৯। কলকাতা: র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন। পৃষ্ঠা ৮২-৮৮। আইএসবিএন 978-81-85459-82-0।

Leave a Comment

error: Content is protected !!