তলস্তয় বা কাউন্ট লেভ নিকোলায়েভিচ তলস্তয় বা টলস্টয় বা টলষ্টয় বা ল্যেভ তলস্তোয় (ইংরেজি: Count Lev Nikolayevich Tolstoy) ছিলেন রাশিয়ার সবচেয়ে প্রতিভাধর লেখক। কিন্তু তার প্রভাব আজ দেশের বাইরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের শত্রু মোহনদাস গান্ধীও তাঁর শান্তিপূর্ণ অসহযোগের প্রেরণা পেয়েছিলেন তলস্তয়ের কাছ থেকেই।
রাশিয়ার সবচেয়ে অভিজাত এক জমিদার পরিবারে তলস্তয়ের জন্ম হয়েছিল ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর। তুলা প্রদেশের ইয়াসনারা পলিয়ানায় তাদের জমিদারী ছিল। সোনার চামচ মুখে নিয়েই তিনি একরকম জন্মেছিলেন, বেড়ে উঠেছিলেন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আর আদর প্রশ্রয়ের মধ্যে।
মাত্র নয় বছর বয়সেই তলস্তয় তাঁর বাবা ও মাকে হারান। ফলে তাকে ও তার ভাইবোনদের মানুষ হতে হয় পরিবারের অন্য আত্মীয়-স্বজনের কাছে। তাতিয়ানা নামে তাঁর এক খুড়িমা ছিলেন। স্বচ্ছল এবং বড় পরিবারের মানুষ হয়েও তিনি খুবই সরল জীবন যাপন করতেন। তার সরলতা ও ধর্মপ্রাণ তলস্তয়ের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল। এই প্রভাবই যৌবনের ভোগ সুখে মাতোয়ারা তলস্তয়কে বারবার মনের নিভৃতে নিজেকে অন্তরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিত।
জমিদার তলস্তয় আত্মজিজ্ঞাসু মানবপ্রেমিক তলস্তয় হয়ে পৃথিবীর শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন। তথাকথিত জমিদার পরিবারের সদস্য হিসেবে যৌবনের উচ্ছলতা তলস্তয়কে ভোগসুখের মধ্যে মাতিয়ে রেখেছিল। রাজধানী পিটার্সবার্গে নানারকম সামাজিক মেলামেশা, তাস-দাবা, মদ্যপান আর ফুর্তি নিয়েই তিনি মজে থাকতেন।
কিন্তু এই আমোদ-প্রমোদের মধ্যেও মাঝে মাঝেই যেন কেমন থমকে যেতেন তিনি। কেমন যেন মনে হতো— এসব তিনি কি করছেন, জীবনের অপচয় ছাড়া এতো আর কিছু নয়। উচ্ছল প্রমোদের জীবন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠত তাঁর মন। কিন্তু আশ্চর্য যে এই ভাবনা-চিন্তা স্থায়ী হতো না। কোন পরিকল্পনা সঙ্কল্পে রূপ নেবার আগেই ফের আনন্দ-ফুর্তির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিতেন। কিন্তু মনের ভেতরে সূক্ষ্মভাবে জেগে থাকত একটা অতৃপ্তির অসাচ্ছন্দ।
এই টানা পোড়েনের মধ্যেই জীবন এগিয়ে চলছিল। তলস্তয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ হলো ১৮৫১ সালে। সেই সময়ে পারিবারিক জমিদারি দেখাশোনার জন্য তার উপস্থিতি জরুরি হয়ে পড়ল। তলস্তয় কঠিন এক সমস্যার সম্মুখীন হলেন। পড়াশোনা শেষ হয়েছে। এখন হয় গ্রামে জমিদারিতে ফিরে যেতে হবে, নয়তো অন্য ভাইকে সেই দায়িত্ব দিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে হবে। কি করবেন সেই সিদ্ধান্ত স্থির করবার আগেই এক অদ্ভুত কান্ড করে বসলেন তলস্তয়।
তার এক ভাই, তার নাম নিকোলাস, সেনা বিভাগের অফিসার ছিল। তার সঙ্গে তিনি চলে গেলেন ককেশাস অঞ্চলে। সেখানে বিদ্রোহী তাতার উপজাতিদের সঙ্গে তখন জারের সেনাবাহিনীর প্রচন্ড লড়াই চলেছিল। তলস্তয় স্বেচ্ছাসেবক হয়ে সরকারি সেনাবাহিনীর সহযোগিতার কাজে লেগে গেলেন। প্রায় বছরখানেক সেনাবাহিনীর সঙ্গে থেকে যুদ্ধক্ষেত্র সম্বন্ধে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ হলো। এই অভিজ্ঞতাই তাকে কলম তুলে নেবার প্রেরণা জোগাল। পরের বছর তিনি ‘এরেইগ’ নামে একটি বই লিখলেন।
অল্প বয়সের লেখা হলেও বর্ণনার মাধুর্য পর্যবেক্ষণের গভীরতা এবং লেখকের বক্তব্যের অনাড়ম্বর ও তীক্ষ্ণতা বইটিতে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছিল। বইটি বিদগ্ধ মহলে সমাদৃত হলো। উৎসাহিত হয়ে তলস্তয় এবারে একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস রচনায় হাত দিলেন। ‘দ্য কসাকস’ নামের এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হলো ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে।
এটি আত্মজীবনী মূলক লেখা না হলেও মূলত সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতা উপলব্ধি ও আন্তর জিজ্ঞাসা এমন গভীর অনুভূতির সঙ্গে বিবৃত হয়েছে যে দেশের শিক্ষিত মহল বুঝতে পারল যে নতুন এক শক্তিশালী লেখকের আবির্ভাব হয়েছে।
বস্তুত যুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, তলস্তয়ের অন্তর্জগতে এক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিল। জীবন সম্পর্কে এক নতুন মূল্যবোধের সন্ধান পেলেন তিনি। এতকাল যে জীবন যাপন করেছেন তা যে প্রতিভা ও জীবনের সার্থকতার কঠিনতম অন্তরায় এই উপলব্ধি তাকে এক অজানা অতৃপ্তিতে পীড়ন করতে লাগল। জীবন কেন? তার সার্থকতা কোথায়? থেকে থেকে এই জিজ্ঞাসাই মনকে নাড়া দিতে লাগল।
বয়স যখন চব্বিশ হলো, তলস্তয় তাঁর জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পেলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন, জীবন আনন্দময়! আর এই আনন্দ রয়েছে হিংসায় নয়, রক্তপাতে নয়, রয়েছে ভালবাসায়। ভালবাসারই অপর নাম ধর্ম। এই ধর্ম সাধনেই জীবনের সার্থকতা নিহিত।
স্বাভাবিক ভাবেই জীবনের লক্ষ স্থির হয়ে গেল তার। কিন্তু লক্ষ পুরনের জন্য কর্মক্ষেত্রে যে প্রস্তুতির আবশ্যক তা তার ছিল না। তাই লক্ষে সচেতনতা অবিচল রেখে চলল তার অপেক্ষার পালা। সৈনিক দলের কাজে ইস্তফা দিয়ে তলস্তয় কিছুকাল পিটার্সবার্গে বসবাস করলেন। পরে ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন।
মানুষের জীবনবোধ ও জীবনচর্যা সম্পর্কে অভিজ্ঞতার সঞ্চয় বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছিল তার এই ভ্রমণ। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাশিয়ায় ফিরে এলেন। দেশের নিরক্ষর দরিদ্র মানুষের জীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের অভিপ্রায় নিয়ে তিনি পৈতৃক জমিদারী দেখা শোনার কাজ শুরু করলেন। সেই সঙ্গে শুরু হলো নিরলস সাহিত্য সাধনা।
তলস্তয় এখন শতশত দরিদ্র প্রজার দণ্ডমুন্ডের কর্তা। কিন্তু প্রজাদের অবস্থা দেখে নিজেই লজ্জিত হলেন। একদম পাশাপাশি দুটি জীবনধারা, একটিতে চরম ভোগ, অপরটিতে চরম বঞ্চনা আর হতাশা। জীবনের এই অসম প্রবাহ চলতে পারে না।
অথচ বঞ্চিত জনের বঞ্চনা সম্পর্কে নেই উপলব্ধি। শিক্ষার অভাবেই এই চেতনাহীনতা। তলস্তয় নিজের চেষ্টায় স্কুল স্থাপন করে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিতে শুরু করলেন। শিক্ষা দেবার নতুন প্রণালীও তিনি উদ্ভাবন করলেন। আর এদিকে নিজে ত্যাগ করলেন ঐশ্বর্য আর বিলাসিতার জীবন। দরিদ্র কৃষকদের সঙ্গে নিজেও হয়ে গেলেন তাদেরই একজন।
ইতিপূর্বে ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে তলস্তয় বিয়ে করেছিলেন এক পরিচিত পরিবারের মেয়ে বেহরকে। তাদের বিবাহিত জীবনও সুখের হয়েছিল। বিবাহের পরে পরেই তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন বিখ্যাত ‘ওয়ার অ্যান্ড পীস’ উপন্যাসটি।
এই উপন্যাসেই তলস্তয় প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল। সাহিত্য সমালোচকদের মতে উপন্যাস সাহিত্যের ইতিহাসে ‘ওয়ার অ্যান্ড পীস’ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
এদিকে তার জীবনচর্যায়ও ঘটে চলেছিল পরিবর্তন। দিনে দিনে তিনি কৃষকদের সঙ্গে মিশে তাদের মতই সাধারণ স্তরের জীবনযাত্রা শুরু করেছিলেন। এই সূত্রে স্ত্রীর সঙ্গেও শুরু হয়েছিল বাদানুবাদ। কিন্তু তলস্তয় জীবন-সত্যের সন্ধান পেয়েছেন, কোনো প্রতিকূলতাই তাকে লক্ষভ্রষ্ট করতে পারল না।
বর্তমান ভোগ সর্বস্ব সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছিল। নিজের উপলব্ধি সাধারণকে বোঝাবার জন্য ছোট ছোট গল্প লিখতে লাগলেন তলস্তয়। তার এই গল্পগুলো জগতের সাহিত্যে অতুলনীয়।
তলস্তয় তাঁর বিখ্যাত দ্বিতীয় উপন্যাস লেখা শুরু করলেন ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে। এই সময়ে তার ব্যক্তিগত জীবনেও একের পর এক বিপর্যয় ঘটতে লাগল। তার দুটি সন্তান মারা গেল। ছোটবেলার যে খুড়িমা ছিলেন তার পরম স্নেহময়ী অভিভাবিকা—তাতিয়ানা, তলস্তয়ের জীবনের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি তিনিও মারা গেলেন। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে স্ত্রীও অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
এর মধ্যেই আনা কারেনিনা প্রকাশিত হলো এবং অসাধারণ উপন্যাস রূপে স্বীকৃতি লাভ করল। এই উপন্যাসে নরনারীর মানসিক সম্পর্ক ও বৈচিত্র্য নিয়ে তলস্তয়ের যে সুগভীর জ্ঞানের পরিচয় প্রকাশিত হলো তা কেবল শেকসপীয়র ছাড়া আর কেউ সেই জ্ঞানের পরিচয় দিতে পারেননি।
যতই বয়স বাড়তে থাকে ততই তার ধারণা হতে থাকে যে সর্ব-ত্যাগের আদর্শ তিনি প্রচার করছেন সাহিত্যে, নিজের জীবনে তিনি তাকে পূর্ণমাত্রায় রূপায়িত করতে পারছেন না। এই অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হতে হতেই তিনি একে একে রচনা করলেন দ্য পাওয়ার অব ডার্কনেস এবং ক্রুয়েটজার সোনাটা। পরে পরেই রচনা করলেন দ্য রেজারেকশান নামের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসটি। এই বইতে তিনি মানবজাতির ভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেছেন।
তলস্তয় নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি থেকে যেসব উপন্যাস রচনা করেছেন তার মধ্যে ওয়ার অ্যান্ড পীস, আনা কারেনিনা এবং দ্য রিজারেকশান এই তিনটি আজ জগতের ক্লাসিকরূপে পরিগণিত।
তলস্তয় চরম মানসিক অতৃপ্তিতে ভুগছিলেন। ঘরের বন্ধন, প্রেম-ভালবাসা সবই বাধা বলে মনে হচ্ছিল নিজের সঙ্কল্প পূরণের পথে। কৃষকদের বেশভূষায় কৃষকদের মত জীবন যাত্রায় আরও বেশি করে একাত্ম হতে পারছেন না।
সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের দুঃখ শোকের অংশীদার হতে পারছেন না। ঈশ্বরপ্রেম মানবপ্রেমের পূর্ণতায় সার্থক করে তুলতে পারছেন না এই ছিল দ্বন্দ্ব। এই নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গেও দীর্ঘস্থায়ী প্রেমের পরিসমাপ্তি ঘটল। শেষ পর্যন্ত বিরাশি বছর বয়সে একদিন শীতের রাতে সামান্য দরিদ্র লোকের পোশাকে তলস্তয় ঘরের আশ্রয় ত্যাগ করে পথে বেরিয়ে পড়লেন। এই পথই হলো তাঁর শেষ আশ্রয়স্থল।
যেই ট্রেনে চড়েছিলেন, সেখানেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তার এগার দিন পরে চিরতরে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বর।
তলস্তয় বিশ্বমানবতার স্বার্থেই মানসিক দ্বন্দ্বের শিকার হয়েছিলেন। পত্নীর ভালবাসাহীন রূঢ় ব্যবহার তার বার্ধক্যের দিনগুলোকে বিষময় করে তুলেছিল। তবুও তিনি নিজের লক্ষে ছিলেন স্থির। এই মহামনীষীর বেদনার্ত জীবনের পরিসমাপ্তি শুধু রাশিয়ার নয়, সমগ্র মানবজাতির বেদনাপূর্ণ স্মৃতি হয়ে রয়েছে।
তথ্যসূত্র
১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ১১৫-১১৯।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।