লেভ তলস্তয় – রুশ বিপ্লবের দর্পণ

মহাশিল্পী[১] যে-বিপ্লবকে[২] স্পষ্টতই বুঝতে পারেন নি, যার থেকে তিনি স্পষ্টতই রয়েছেন ফারাকে, তারই সঙ্গে তাঁকে এক করে দেখানটাকে আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত এবং কৃত্রিম মনে হতে পারে। যে-দর্পণ সবকিছুকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত করে না সেটাকে তো দর্পণ বলা শক্ত। আমাদের বিপ্লবটা কিন্তু অত্যন্ত জটিল জিনিস। এই বিপ্লব যারা সরাসরি ঘটাচ্ছে, এতে অংশগ্রহণ করছে, সেই জনসমূহের মধ্যেও বহু সামাজিক অঙ্গ উপাদান আছে যারা স্পষ্টতই বুঝতে পারে নি কী ঘটছে, ঘটনাবলির গতি যেসব বাস্তব ইতিহাস-নির্দিষ্ট কাজ সামনে তুলে ধরেছে সেগুলো থেকে তারাও স্পষ্টতই রয়েছে ফারাকে। কিন্তু, যাঁর কথা বলা হচ্ছে যথার্থই মহাশিল্পী হলে তিনি নিজ রচনায় বিপ্লবের অন্তত কিছু কিছু, সারবান দিক প্রতিফলিত করেছেন নিশ্চয়ই।

বৈধ রুশ পত্র-পত্রিকাগুলির পাতায়-পাতায় তলস্তয়ের অশীতিতম জন্মদিবস উপলক্ষে অজস্র প্রবন্ধ চিঠিপত্র আর মন্তব্য ঠাসা থাকলেও, রুশ বিপ্লবের প্রকৃতি আর চালিকাশক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর রচনাবলি বিশ্লেষণ করায় তারা থোড়াই আগ্রহান্বিত। এই গোটা পত্র-পত্রিকাজগৎ থেকে ভণ্ডামি উপচে পড়ছে, তা দেখলে গা ঘিনঘিন করে, আর সেটা ডবল রকমের ভণ্ডামি: সরকারী আর উদারনীতিক। আগেরটা হলো কেনা ওঁছা ভাড়াটে লেখকদের স্থল ভণ্ডামি, – লেভ তলস্তয়কে ঘা মারার জন্যে তাড়া করার হুকুম ছিলো তাদের উপর গতকাল, আর আজ হুকুম হয়েছে তলস্তয়কে দেখাও দেশপ্রেমিক হিসেবে, ইউরোপের মানুষের চোখের সামনে শালীনতা মেনে চলার চেষ্টা করো। এই রকমের ঔছা। ভাড়াটে লেখকদের লম্বা-লম্বা বিরক্তিকর বাগাড়ম্বরের জন্যে পয়সা দেওয়া হয়েছে তা সবাই জানে, তারা ঠকাতে পারবে না কাউকে। ঢের বেশি মার্জিত, তাই ঢের বেশি হানিকর এবং বিপজ্জনক হলো উদারনীতিক ভণ্ডামি। রেচ’ পত্রিকার কাদেতী বালালাইকিন’দের [৩] কথা শুনলে মনে হতে পারে তলস্তয়ের প্রতি তাদের দরদ বুঝি একেবারে পূর্ণাঙ্গ আর অতি আকুল ধরনের। আসলে, ‘মহান ভগবৎসন্ধায়ী’ সম্বন্ধে তাদের হিসেব-কষে-বানানো আবেগ মুখরতা আর জাঁকাল কথা আগাগোড়াই ভুয়া, কেননা কোনো রুশী উদারনীতিক তলস্তয়ের ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, কিংবা বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা সম্বন্ধে তলস্তয়ের সমালোচনার সঙ্গে সমমনোভাবাপন্ন নয়। রুশ উদারনীতিকেরা একটি জনপ্রিয় নামের সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্ট করছে নিজেদের রাজনীতিক পুঁজি বাড়াবার মতলবে, দেশজোড়া প্রতিপক্ষের একটা নেতার ভঙ্গি ধরার মতলবে; ফাঁকা বুলির ঢানিনাদ আর উচ্চনাদের মধ্যে তারা একটা প্রশ্নের সোজা স্পষ্ট উত্তরের জন্যে দাবিটাকে ডুবিয়ে দিতে চাইছে, প্রশ্নটা হলো – তলস্তয়বাদের’ দগদগে অসঙ্গতিগুলো কিসের দরুন, আর তাতে প্রকাশ পাচ্ছে আমাদের বিপ্লবের কোনো-কোনো, এটি বিচ্যুতি আর দুর্বলতা ?

তলস্তয়ের রচনাবলিতে, অভিমতে, মতবাদে, তাঁর মতসম্প্রদায়ে অসঙ্গতিগুলো বাস্তবিকই দগদগে। একদিকে, আমাদের এই মহাশিল্পী, এই মহাপ্রতিভাধর, যিনি রুশ জীবনের বিভিন্ন অতুলনীয় চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন শুধু তাই নয়, তাঁর রয়েছে বিশ্বসাহিত্যক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রথম শ্রেণীর অবদান। আর, খ্রিস্টের ভক্ত জমিদারটিকে আমরা পাচ্ছি অন্যদিকে। একদিকে, সামাজিক মিথ্যাচার আর ভণ্ডামির বিরুদ্ধে অসাধারণ শক্তিশালী, স্বাভাবিক এবং আন্তরিক প্রতিবাদ, আর অন্যদিকে সেই তলস্তয়ী, অর্থাৎ, থকে-যাওয়া বিকারগ্রস্ত ঘ্যানঘ্যানকারী, যাকে বলে রুশ বুদ্ধিজীবী, যে প্রকাশ্যে বুক চাপড়ে বিলাপ করে : “আমি খারাপ দুষ্ট মানুষ, কিন্তু আমি নৈতিক আত্মশুদ্ধিব্রত পালন করছি; আমি মাছ-মাংস আর খাই নে, এখন খাই ভাতের কাটলেট। পুঁজিতান্ত্রিক শোষণের নির্মম সমালোচনা, সরকারী দৌরাত্ম্য আর প্রহসনিক বিচার আর রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের স্বরূপ উদঘাটন, সম্পদবৃদ্ধি আর সভ্যতার সাধন সাফল্য এবং মেহনতী জনগণের দারিদ্রবৃদ্ধি, অধঃপাত আর দৈন্য দুর্দশার মধ্যেকার গভীর অসঙ্গতিটাকে খুলে ধরা একদিকে, আর অন্যদিকে বশ মেনে নেবার পাগুলে নীতি-উপদেশ – ‘অমঙ্গলের প্রতিরোধ কোরো না’ হিংসা দিয়ে। একদিকে অতি সংযত বাস্তববাদ, সমস্ত রকমের মুখোস ছিড়ে ফেলা, আর অন্যদিকে জগতের সবচেয়ে জঘন্য একটা জিনিসের উপদেশ – ধর্ম প্রচার : সরকারীভাবে নিযুক্ত যাজকদের জায়গায় নৈতিক প্রত্যয় থেকে কাজ করবে এমন যাজক আনবার চেষ্টা, অর্থাৎ, অতি মার্জিত এবং সেই কারণে বিশেষ ন্যক্কারজনক যাজকতত্র গড়ে তোলার চেষ্টা। যথার্থ বটে:

অভাগিনী তুই শস্যশ্যামলা,
পরাক্রান্তা তবু-যে অবলা,
– জননী রাশিয়া![৪]

এইসব অসঙ্গতির দরুন তলস্তয়ের পক্ষে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন এবং সমাজতন্ত্রের জন্যে সংগ্রামে তার ভূমিকা, কিংবা রুশ বিপ্লবকে বোঝা সম্ভব হয় নি, তা বলাই বাহুল্য। তবে, তলস্তয়ের অভিমতে আর মতবাদে অসঙ্গতিগুলো আপতিক নয়; উনিশ শতকের শেষ তেহাইয়ে রুশে জীবনের অসঙ্গতিপূর্ণ অবস্থা তাতে প্রকাশ পেয়েছে। সবে সম্প্রতি ভূমিদাসপ্রথা থেকে মুক্ত প্যাট্রিয়াকাল গ্রামাঞ্চলকে একেবারে আক্ষরিক অর্থেই পুঁজিপতি আর কর-আদায়কারীদের হাতে তুলে দেওয়া হলো ঠকিয়ে সর্বস্বান্ত করা আর লুটতরাজের জন্যে। কৃষক অর্থনীতি আর কৃষক জীবনের প্রাচীন ভিত্তি, যা যথার্থই টিকে ছিল শতাব্দীর পরে শতাব্দী ধরে, সেটাকে অসাধারণ দ্রুত ভেঙে জঞ্জালে পরিণত করা হলো। তলস্তয়ের অভিমতের অসঙ্গতিগুলোর মূল্যায়ন করতে হবে এখনকার দিনের শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন এবং এখনকার দিনের সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে নয় (এমন মূল্যায়ন নিশ্চয়ই দরকার, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়), অগ্রসরমান পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে, ভূমি থেকে বেদখল হচ্ছে যে জনগণ তাদের সর্বনাশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করতে হবে – এই প্রতিবাদ প্যাট্রিয়ার্কাল রুশ গ্রামাঞ্চল থেকে ওঠা অবধারিত ছিলো। মানবজাতির মোক্ষলাভের নতুন-নতুন দাওয়াইয়ের আবিষ্কারক পয়গম্বর হিসেবে তলস্তয় উদ্ভট হাস্যকর – কাজেই, বৈদেশিক আর রুশী তলস্তয়ী যারা তাঁর মতবাদের সবচেয়ে দুর্বল দিকটাকে ধর্মমতে পরিণত করতে চেষ্টা করেছে তাদের এমন গুরুত্ব নেই যাতে তাদের সম্বন্ধে কিছু বলার দরকার হতে পারে। রাশিয়ায় যখন বুর্জোয়া বিপ্লব ঘনিয়ে আসছিল সেই সময়ে লক্ষ-লক্ষ রুশ কৃষকদের মধ্যে উদ্ভূত ভাব-ধারণা আর অনুভূতির মুখপাত্র হিসেবে তলস্তয় মহান। তলস্তয়ের মৌলিকত্ব আছে, কেননা সমগ্রভাবে ধরলে তাঁর মতামতের সারসংক্ষেপে আমাদের বিপ্লবের বিশেষ উপাদানগুলো প্রকাশ পেয়েছে কৃষক বুর্জোয়া বিপ্লব হিসেবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, আমাদের বিপ্লবে কৃষককুলকে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে হয়েছে যে-অসঙ্গতিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে, বাস্তবিকই তার একখানা দর্পণ হল তলস্তয়ের অভিমতের অসঙ্গতিগুলো। একদিকে, বহু শতকের সামন্ততান্ত্রিক উৎপীড়ন এবং সংস্কারের পরবর্তী দশকগুলির ত্বরিত নিঃস্বতা জমিয়ে তুলেছে পাহাড়প্রমাণ ঘৃণা, ক্ষোভ আর মরিয়া দৃঢ়সংকল্প। সরকারী যাজকমণ্ডলী, জমিদারগণ আর জমিদারদের সরকারকে ঝেটিয়ে একেবারে বিদেয় করার প্রচেষ্টা, সমস্ত পুরন রূপ আর ধরনের ভূমি-মালিকানা ধবংস করার প্রচেষ্টা, ভূমি থেকে জঞ্জাল সাফ করার প্রচেষ্টা, পুলিস-শ্রেণীগত রাষ্ট্রের জায়গায় মুক্ত আর সমান-সমান। ছোট কৃষকদের লোকসমাজ স্থাপনের প্রচেষ্টা – এই প্রচেষ্টা হল আমাদের। বিপ্লবে কৃষককুলের প্রত্যেকটা ঐতিহাসিক পদক্ষেপের মূল উপাদান; নিঃসন্দেহে বলা যায়, তলস্তয়ের অভিমত‘তন্ত্র’কে কখনও-কখনও যে বিমূর্ত ‘খ্রিস্টীয় নৈরাজ্যবাদ’ বলে মূল্যায়ন করা হয় তার চেয়ে ঢের বেশি পরিমাণে কৃষকের এই প্রচেষ্টার সঙ্গেই তাঁর রচনাবলির মর্মবাণী মেলে।

অন্যদিকে, যৌথ জীবনযাত্রার নতুন-নতুন প্রণালীর জন্যে সচেষ্ট কৃষককুলের ধারণা বিভিন্ন বিষয়ে ছিল অত্যন্ত চেতনাহীন প্যাট্রিয়ার্কাল, বাতিকগ্রস্ত – সেইসব বিষয় হলো: সেই যৌথ জীবনটা হবে কী রকমের, মুক্তিলাভ করা যেতে পারে কোনো সংগ্রামে, কোনো নেতাদের তারা পেতে পারে এই সংগ্রামে, কৃষক বিপ্লবের স্বার্থের প্রতি বুর্জোয়াদের এবং বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবি সমাজের মনোভাব কী, জমিদারিপ্রথা বিলুপ্ত করার জন্যে জারতান্ত্রিক শাসনের বলপূর্বক উচ্ছেদ আবশ্যক কেন। কৃষকের সমগ্র অতীত জীবন তাকে জমিদার আর আমলাকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে, কিন্তু এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরটা খুঁজতে হবে কোথায়, তা তাকে শেখায় নি, শেখাতে পারে না। আমাদের বিপ্লবে কৃষককুলের একটা ছোট অংশ এই উদ্দেশ্যে যথার্থই লড়েছিল, কিছু পরিমাণে সংগঠিত হয়েছিল বটে; আর শত্রুদের উন্মলিত করতে, জারের নোকর এবং জমিদারদের রক্ষাকর্তাদের খতম করতে অস্ত্র-হাতে দাঁড়িয়েছিল খুবই ক্ষুদ্র অংশই বটে। বেশির ভাগ কৃষকই কেদেছে আর প্রার্থনা করেছে, নীতিবাদ চালিয়েছে আর স্বপ্ন দেখেছে, দরখাস্ত লিখেছে আর ‘উকিল পাঠিয়েছে – ঠিক লেভ তলস্তয়ের ধরনে! তেমনি, এমনসব ক্ষেত্রে সবসময়েই যা ঘটে থাকে, এই তলস্তয়ী রাজনীতি থেকে দূরে-অবস্থান, এই তলস্তয়ী রাজনীতি-বর্জন, রাজনীতি সম্বন্ধে আগ্রহ আর বুঝ-সমঝের এই অভাবের ক্রিয়া হলো এই যে, শ্রেণীসচেতন বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতের নেতৃত্বকে অনুসরণ করল মাত্র একটা সংখ্যালঘু অংশ, আর সংখ্যাগুর, অংশ শিকার হলো সেইসব নীতিবর্জিত দাস-মনোবৃত্তিসম্পন্ন বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের, যাদের নাম কাদেত, যারা ক্রুদোভিক’দের[৫] সভা থেকে তড়িঘড়ি স্তলিপিনের[৬] পাশ-কামরায় গিয়ে হাতে-পায়ে ধরে, দরকষাকষি করে, মানিয়ে-বনিয়ে নেয়, মানিয়ে-বনিয়ে নেবার কথা দেয় – শেষে বহিস্কৃত হয় ফৌজী জ্যাকবটের লাথি খেয়ে। তলস্তয়ের ভাব-ধারণাগুলি আমাদের কৃষক বিদ্রোহের দুর্বলতার, এটি বিচ্যুতিগুলোর একখানা দর্পণ, প্যাট্রিয়ার্কাল গ্রামাঞ্চলের শিথিলতা এবং করিতকর্মা মজিকে’র সংকীর্ণমনা কাপুরুষতার প্রতিবিম্ব।  

সাহিত্য সম্পর্কে একটি আলোচনা শুনুন

১৯০৫-১৯০৬ সালের সৈনিক বিদ্রোহের কথা ধরা যাক। এই যে-মানুষগুলি আমাদের বিপ্লবে লড়ল, এদের সামাজিক গঠন অংশত কৃষক, অংশত প্রলেতারিয়ান। প্রলেতারিয়ানরা ছিল সংখ্যালঘু – কাজেই, যে-প্রলেতারিয়েত সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক হলো যেন হাতের ইশারায় তারা প্রদর্শন করল যে-দেশব্যাপী সংহতি, যে-পার্টিগত চেতনা, তার কাছাকাছিও তা প্রদর্শন করে নি সশস্ত্র শক্তির ভিতরকার আন্দোলন। তবুও, সশস্ত্র শক্তির ভিতরকার বিদ্রোহ ব্যর্থ হলো কোনো অফিসারেরা সেটাকে পরিচালনা করে নি বলে, এই মতের চেয়ে ভুল আর কিছুই নয়। বরং তার বিপরীত: ‘ছাইরঙা পাল’টা যে তাদের উপরওয়ালাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র-হাতে বিদ্রোহ করল, ঠিক এরই থেকে দেখা গেল ‘নারোদনায়া ভলিয়ার’ [৭] সময়ের পর থেকে বিপ্লবের কী বিপুল অগ্রগতি ঘটেছে, আর উদারপন্থী জমিদার এবং উদারপন্থী অফিসারেরা অত আতঙ্কিত হয়েছিল তাদের ঐ আত্মনির্ভরশীলতার দরুনই। কৃষকের স্বার্থের প্রতি সাধারণ সৈনিক ষোলআনা সহানুভূতিশীল ছিল; জমির কথা উচ্চারিত হলেই তার চোখ জলজল করত। একাধিক ক্ষেত্রে সশস্ত্র শক্তিতে কর্তৃত্ব চলে গিয়েছিল সৈনিক সাধারণের হাতে, কিন্তু এই কর্তৃত্বের বদ্ধপরিকর ব্যবহার আদৌ হয় নি বললেই হয়; সৈনিকেরা অটল থাকে নি; দিন-দুয়েক পরে, কোন-কোন ক্ষেত্রে অল্প কয়েক ঘণ্টা পরে কিছুকিছু, ঘৃণিত অফিসারকে বধ করার পরে গ্রেপ্তার করা অন্যান্য অফিসারকে তারা ছেড়ে দিয়েছে, আলোচনা করেছে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে, আর তারপরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে বন্দুকধারী জল্লাদের সারির সামনে, কিংবা পিঠ খুলে ধরেছে চাবকানির জন্যে, কিংবা জোয়াল পরেছে আবার — ঠিক লেভ তলস্তয়ের ধরনে!

তলস্তয় প্রতিফলিত করেছেন ঠেসে-চাপা ঘৃণা, একটু ভাল বরাতের জন্যে সপরিণত প্রচেষ্টা, অতীত থেকে নিষ্কৃতি পাবার কামনা – তেমনি আবার, অপরিণত স্বপ্ন-দেখা, রাজনীতির অনভিজ্ঞতা, বৈপ্লবিক শিথিলতা। ঐতিহাসিক এবং অর্থনীতিক অবস্থা থেকে ব্যাখ্যা পাওয়া ঐতিহাসিক এবং অর্থনীতিক অবস্থা থেকে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এই দুইয়েরই – জনগণের বৈপ্লবিক সংগ্রামের অনিবার্য সূত্রপাত এবং সংগ্রামের জন্যে তাদের অপ্রস্তুতি, অমঙ্গলের প্রতি তাদের তলস্তয়ী না-প্রতিরোধ, ছিল প্রথম বৈপ্লবিক অভিযানের পরাজয়ের সবচেয়ে গুরুতর একটা কারণ।

লোকে বলে, হেরে যাওয়া বাহিনী ভাল শিক্ষা লাভ করে। বৈপ্লবিক শ্রেণীগুলিকে অবশ্য ফৌজের সঙ্গে তুলনা করা যায় খুবই সীমাবদ্ধ অর্থে। সামন্ততন্ত্রী জমিদার আর তাদের সরকারের প্রতি ঘৃণা দিয়ে সম্মিলিত বহু, লক্ষ-লক্ষ কৃষককে বৈপ্লবিক-গণতান্ত্রিক সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল যেসব অবস্থা সেগুলি পুঁজিতন্ত্রের বিকাশের ফলে ঘণ্টায়-ঘণ্টায় বদলে যাচ্ছে, প্রবলতর হচ্ছে। কৃষকদের নিজেদের মধ্যে বিনিময়ের বৃদ্ধি আর বাজারের নিয়মের বুদ্ধির ফলে এবং টাকার ক্ষমতার দরুন সেকেলে ধরনের প্যাট্রিয়ার্কিপ্রথা আর প্যাট্রিয়ার্কাল তলস্তয়ী মতাদর্শ সমানে উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। তবে, বিপ্লবের প্রথম-প্রথম বছরগুলি এবং বৈপ্লবিক গণসংগ্রামের প্রথম-প্রথম পরাজয় থেকে একটা লাভ হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। লাভটা হলো, জনগণের আগেকার কোমলতা আর শিথিলতার উপর পড়েছে যে মারাত্মক আঘাত। সীমানির্দেশক রেখাগুলো আরও স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। শ্রেণীতে-শ্রেণীতে, পার্টিতে-পার্টিতে ভেদ-বিভাগ ঘটে গেছে। স্তলিপিনের শেখানো পাঠের হাতুড়ির আঘাতগুলোর চোটে এবং বিপ্লবী সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটদের অবিচ্যুত এবং সঙ্গতিপূর্ণ আলোড়নের ফলে সমাজতন্ত্রী প্রলেতারিয়েতই শুধু নয়, গণতন্ত্রী কৃষকসাধারণও অনিবার্যভাবেই তাদের ভিতর থেকে এগিয়ে ধরবে ক্রমাগত বেশি ইস্পাত-কঠিন যোদ্ধাদের, যারা আমাদের তলস্তয়বাদের ঐতিহাসিক পাপে পড়তে কম পারগ হবে!

৩৫ নং প্রলেতারি’, ১১ (২৪) সেপ্টেম্বর, ১৯০৮
১৭শ খণ্ড, ২০৬-২১৩ প.[৮]

আরো পড়ুন

টিকা:

১. তলস্তয়, লেভ নিকোলায়েভিচ (১৮২৮-১৯১০) – প্রতিভাবান রুশ লেখক। নিজের রচনায় তলস্তয় দেখিয়েছেন প্রাক-বৈপ্লবিক রাশিয়ার জীবন, ফুটিয়ে তুলেছেন সেই সময়ের পরস্পরবিরোধী পরিস্থিতি যাতে গড়ে উঠত রুশ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও স্তরের মানসতা। —- সম্পাদকের টিকা
২. রাশিয়ায় ১৯০৫-১৯০৭ সালের বিপ্লবের কথা বলা হচ্ছে।
৩. কাদেত’রা (নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক পার্টি) — রাশিয়ায় উদারনীতিক রাজতন্ত্রী বুর্জোয়াদের প্রধান পার্টি; গঠিত হয় ১৯০৫ সালের অক্টোবরে। বুর্জোয়া, জমিদার ও বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধিরা এতে যোগ দেয়। মেহনতীদের প্রতারণার জন্যে কাদেত’রা নিজেদের অভিহিত করত ‘গণ স্বাধীনতার পার্টি’ বলে, কিন্তু আসলে এরা নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের চেয়ে বেশি কিছু দাবি করত না। কাদেত’দের প্রধান লক্ষ্য ছিলো বৈপ্লবিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে লড়া, তারা চেয়েছিল জার আর জমিদারদের সঙ্গে দেশের শাসনক্ষমতা ভাগাভাগি করে নিতে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার সরকারের রাজ্যগ্রাসী বৈদেশিক নীতি কাদেত’রা সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে।
অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয়ের পর কাদেত’রা সোভিয়েত রাজের চরম শত্রু হয়ে দাঁড়ায়।
বালালাইকিন – রুশ লেখক-ব্যঙ্গকার ন, ইয়ে. সালতিকোভ শ্চেদ্রিনের ‘আধুনিক সুখী জীবন’ নামক গ্রন্থের এক চরিত্র। উদারনীতিক কথাবাজ, হঠকারী, মিথ্যুক।
‘রেচ’ (কথা) – দৈনিক পত্রিকা, কাদেত পার্টির কেন্দ্রীয় মুখপত্র; প্রকাশিত হয় পিটার্সবার্গে ১৯০৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত।
৪. রুশ কবি ন. আ. নেক্রাসভের ‘রাশিয়ায় কে সুখী’ কাব্য থেকে ভ. ই. লেনিন উদ্ধতিটি দিয়েছেন।
৫. ত্রুদোভিক’রা (ত্রুদোভিক গ্রুপ) – রাষ্ট্রীয় দুমায় কৃষক এবং নারোদনিক মনোভাবাপন্ন বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে পেটিবুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের একটি গ্রপ; গঠিত হয় ১৯০৬ সালের এপ্রিলে প্রথম রাষ্ট্রীয় দুমার কৃষক প্রতিনিধিদের নিয়ে। রাষ্ট্রীয় দুমায় কাদেত ও সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে দোল খেত ত্রুদোভিকরা। ত্রুদোভিকরা যেহেতু অংশত কৃষক জনগণের প্রতিনিধিত্ব করত, দুমার বলশেভিকরা জারতন্ত্র ও কাদেতদের বিরুদ্ধে সাধারণ সংগ্রামের বিশেষ-বিশেষ প্রশ্নে তাদের সঙ্গে সমঝতা ক’রে চলত।
৬. স্তলিপিন, পিয়ৎর আর্কাদিয়োভিচ (১৮৬২-১৯১১) -জার রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় কর্মী, বড় জমিদার। তার সময়ে শুরু হয় নৃশংসতম রাজনীতিক প্রতিক্রিয়াশীলতা। বৈপ্লবিক আন্দোলন দমনের জন্য ১৯০৭-১০ সালে তিনি চালু করেন বেশি হারে মৃত্যুদণ্ড।—সম্পাদকের টিকা
৭. ‘নারোদনায়া ভলিয়া’ (গণ স্বাধীনতা’) – ‘ভূমি ও স্বাধীনতা’ নামক নারোদনিক সংগঠনের ভাঙ্গনের ফলে ১৮৭৯ সালের অগস্টে গঠিত সন্ত্রাসবাদী নারোদনিকদের গুপ্ত রাজনীতিক সংগঠন। নারোদনিকরা জার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম চালায়, তবে ‘সক্রিয়’ নায়ক ও ‘নিষ্ক্রিয়’ জনতার ভ্রান্ত তত্ত্বের দষ্টিভঙ্গি থেকে তারা বলত যে, জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়াই নিজেদের শক্তিতেই ব্যক্তিগত সন্ত্রাস, ভীতিপ্রদর্শন ও সরকারের কাজ বানচালের মাধ্যমে সমাজের পুনর্গঠন সম্ভব। জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নারোদনিকরা ব্যক্তিগত সন্ত্রাসের পদ্ধতি গ্রহণ করে। ১৮৮১ সালের ১লা মার্চের পরে (২য় আলেক্সান্দরের হত্যা) জার সরকার ‘নারোদনায়া ভলিয়া’কে পুরোপুরি বিধস্ত করে।
নারোদনিকদের ভ্রান্ত, ইউটোপীয় কর্মসূচীর তীব্র সমালোচনা করলেও ভ. ই. লেনিন জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘নারোদনায়া ভলিয়া’র সদস্যদের আত্মত্যাগী সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন, তাদের গুপ্ত প্রকৌশল আর কঠোর শখলাবদ্ধ সংগঠনের উচ্চ মূল্যে দেন।
৮. লেখাটি প্রথমে রোদ্দুরে.কমে ১৫ মে ২০১৮ তারিখে প্রকাশ করা হয়। পরে লেখক অনুপ সাদি সম্পাদিত ভি. আই. লেনিনের প্রবন্ধগ্রন্থ সাহিত্য প্রসঙ্গে, টাঙ্গন ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০২০, পৃষ্ঠা ২০-২৫-এ লেখাটি সংকলিত হয়। সেখান থেকে ফুলকিবাজ.কমে হুবহু প্রকাশ করা হয়েছে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!