কমলা চট্টোপাধ্যায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী

কমলা চট্টোপাধ্যায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী। ছাত্রজীবনে যুগান্তর দলের সাথে কাজ করেছিলেন। দুইবার জেল খেটেছিলেন। দলের ছোটখাটো কাজে নিযুক্ত ছিলেন। ধীরে ধীরে নিজেকে যোগ্য করে তোলেন নানা সাংগঠনিক কাজে। প্রথমবার কারামুক্তির পরেই জীবনের মোড় পাল্টে ফেলেন। নারীদের নিয়ে নানা সংগঠন করেন। লেখালেখিসহ প্রচার ও দাপ্তরিক কাজে দক্ষ ছিলেন।

কমলা চট্টোপাধ্যায়-এর জন্ম ও পরিবার

কমলা চট্টোপাধ্যায় ১৯১৩ সালের ২৪ মে জন্মগ্রহণ করেছিলেন হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়ার বাণীবনে। পিতৃভূমি তার হাওড়ার মুন্সীরহাটে। কমলার পিতা প্রমথনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। তিনি ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলে কাজ করতেন। বৈপ্লবিক কার্যাবলীতে যোগদান করার ফলে তিনি বারবার ধরা পড়েন। ১৯১৩ সালের জুলাই মাসে গ্রেপ্তার এড়াবার জন্য তিনি বিদেশে পাড়ি দেন এবং তার পর আর তার খোঁজ পাওয়া না। ফলে তিনটি সন্তান কমলা, তাপস ও অমলকে মা অসহায় অবস্থায় পড়ে যান। তাপস হিমালয়ের দুর্গম পর্বতে কখনো সাধুসঙ্গে কখনো একাকী ভ্রমণ করে বেড়িয়েছেন। ১৯০০ সালে সাধু তাপস ইহলীলা সংবরণ করেন। তাদের বড় ভাই অমরেন্দ্রনাথেরও ১৯২১ সালে পাঠ্যাবস্থায় মৃত্যু হয়। কমলা ১৯৪৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টির দরদী সভ্য নীরদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার বিবাহ হয়।

শিক্ষাজীবন

কমলা চট্টোপাধ্যায়ের মাকে ১৯১৭ সালে ব্রাহ্মসমাজের কয়েকজন সমাজসেবক ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী স্কুলের বোর্ডিং-এ একটি কাজের ব্যবস্থা করে দেন। মা তখন দুটি কন্যা তাপস ও কমলাসহ সেখানে থেকে যান। তাপস ও কমলা দুটি বোনই মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। দুজনেই ম্যাট্রিক পাস করেন কুড়ি টাকা বৃত্তি নিয়ে। কমলা ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯২৯ সালে। ১৯৩১ সালে আই. এ. পাস করেন। কমলার দিদি তাপস স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি বরাবরই সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাপসের চরিত্র ছিল তপস্বিনীর।  

কমলা চট্টোপাধ্যায়-এর রাজনৈতিক কাজ

কমলা চট্টোপাধ্যায় যখন ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী স্কুলে পড়তেন তখন থেকেই স্বদেশীভাবাপন্ন ছিলেন। ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন উপলক্ষে তারা স্কুলে ধর্মঘট করেন। ফলে বোর্ডিং থেকে কমলাদের বহিষ্কারের আদেশ দেওয়া হয়। কমলা ময়মনসিংহেই বিপ্লবী যুগান্তর দলের সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ, নগেন্দ্রশেখর চক্রবর্তী প্রভৃতির সঙ্গে যুক্ত হন। কমলা চট্টোপাধ্যায় কলিকাতা এসে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন এবং হোস্টেলে থাকেন। এখানে তার রাজনৈতিক পরিধি বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক কাজে মেয়েদের নিয়ে আসা ও আগ্রহী করে তোলা ছিল তার প্রধান কাজ।

১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনের সময় ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা দেশীয় পুলিশ কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে, অত্যাচার বন্ধের এবং আন্দোলনে যোগদান করার জন্য আবেদন করে ইস্তাহার প্রচার করেন। ইলা সেন নারী সত্যাগ্রহীদের উপর আক্রমণ উদ্যত ইংরেজ অশ্বারোহী সার্জেন্টের অশ্বের লাগাম ধরে তার গতি রোধ করেন। এই সমস্ত বীরত্বপূর্ণ ঘটনা কমলা চট্টোপাধ্যায়কে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদানের প্রেরণা দেয়। তিনি ঐ আন্দোলনে যুক্ত হন।

এই কাজের সুযোগে তিনি বিপ্লবীদের পোস্ট বক্স হিসেবে এবং নিষিদ্ধ জিনিস রাখার কাজও করতেন। খিদিরপুরে কোথায় অস্ত্র পাওয়া যায় বা রাসায়নিক দ্রব্য পাওয়া যায় সে খবর তারা রাখতেন। তিনি তখন বিপ্লবী কল্পনা দত্ত প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত হন। ময়মনসিংহে গেলে সেখানেও বিপ্লবী দল সংগঠন করতে চেষ্টা করতেন। সংগঠনের কাজেই তার বেশি উৎসাহ ছিল। কিন্তু প্রয়োজন হলে দেশের জন্য সব কিছু। করতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন।

কলিকাতায় কলেজে ধর্মঘটের আহ্বানে কমলা চট্টোপাধ্যায়রা অংশগ্রহণ করেন। পুলিস তখন তাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। ফলে হোস্টেল কর্তৃপক্ষ তাকে আর হোস্টেলে রাখতে চাইলেন না। তখন তিনি অন্য হোস্টেলে চলে যান। সেখান থেকেই তিনি ১৯৩১ সালে আই. এ. পাস করেন। ১৯৩১ সালে অনন্ত সিংহরা চট্টগ্রাম জেলের সুড়ঙ্গ কেটে ডিনামাইট বসিয়ে জেল ভেঙে পালিয়ে আসার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। একজন লোক মারফত কলিকাতায় ১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারি অথবা মার্চ মাসে খবর আসে কিছু বারুদ পাঠাবার জন্য দুইবার ৩/৪ ট্রাঙ্ক বারুদ দুজন মহিলা—অমিতা সেন ও নলিনী পাল মারফত পাঠানো হয়। কমলা চট্টোপাধ্যায়দের দিকে পাঠাবার কাজ নিখুঁত ছিল। কিন্তু ডিনামাইট পোঁতার সময় অর্ধেন্দু গুহ ধরা পড়েন। ফলে এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।

১৯৩১ সালে আই. এ. পাসের পর কমলা চট্টোপাধ্যায় বিদ্যাসাগর কলেজের হোস্টেলে থাকেন। শান্তি ঘোষসুনীতি চৌধুরীর কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে নিধনের পর অনেক মহিলাকেই গ্রেপ্তার করা হতে থাকে।

কারাগারের সময়কাল

কমলা চট্টোপাধ্যায়কেও ১৯৩২ সালের জানুয়ারির প্রথমে গ্রেপ্তার করে এবং ডেটিনিউ করে সিউড়ি ও হিজলী জেলে বন্দী রাখে। ১৯৩৮ সালের প্রথম দিকে তিনি মুক্তি পান। ১৯৪১-৫১ সাল পর্যন্ত মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির অনেক সদস্যকেই স্বাধীন দেশের কংগ্রেস সরকার বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করে রাখে, যাদের মধ্যে কমলার সঙ্গেই ছিলেন মণিকুন্তলা সেন, কমল দাশগুপ্ত, অনিলাদেবী, মীরা চ্যাটার্জি প্রমুখ।

বছর অনুসারে সংগঠনিক কাজের তালিকা

১৯৩৮ সালের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে এপ্রিল মাসে তিনি মন্দিরা’ নামক একটি মহিলাদের মাসিক পত্রিকার সম্পাদিকা ছিলেন (বৈশাখ ১৩৪৫ থেকে কার্তিক ১৩৪৫)। একই বছর কমলা চট্টোপাধ্যায় কমিউনিস্টদের সঙ্গে মিলে মিশে কাজ করতে থাকেন এবং ১৯৩৮ সালের শেষ দিকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। তিনি পার্টির ছাত্রী এবং মহিলা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

১৯৩৯ সালে বাংলার কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে তৈরি হয় Girl Students’ Association এবং পরে তা ছাত্র ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত হয়। এঁদের কাজ ছিল ছাত্রী মহলে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানো ও ছাত্রীদের সংগঠন গড়ে তোলা। কমিউনিস্ট পার্টির কল্যাণী মুখার্জি, কনক দাশগুপ্ত, লেবার পার্টির উমা ঘোষ, গীতা ব্যানার্জি (মুখার্জি) প্রমুখদের নিয়ে তৈরি হয় Girl Students’ Committee। এঁদের সাথে প্রথম থেকেই যুক্ত ছিলেন কমলা চট্টোপাধ্যায়।

১৯৪১ সালে হিন্দু নারীর বিবাহ ও সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিলের উপর আন্দোলন চালানোর জন্য বিভিন্ন মহিলা সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। প্রাদেশিক মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির পক্ষ থেকে কমলা তার যুগ্ম আহ্বায়ক হন। এইভাবে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সদস্য হিসেবে কমলা চট্টোপাধ্যায় বহু উন্নয়নমূলক এবং প্রতিবাদী কাজের সাথে যুক্ত হন। যার তালিকা রচনা করা প্রায় অসম্ভব।

১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক কমিটি মহিলা ফ্রন্টকে জোরদার করার জন্যে নানা পদক্ষেপ নেয়। সারা দেশের নারী আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য ৫ জন মহিলা সদস্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয় মণিকুন্তলা সেন, রেণু চক্রবর্তী, কমলা চট্টোপাধ্যায়, যুঁইফুল রায় এবং কনক মুখোপাধ্যায়।

১৯৪৩ সালে ওভারটুন হলে প্রাদেশিক মহিলা সম্মেলনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি ও তার একটি কার্যকরি কমিটি গঠিত হয়। এর সভানেত্রী ছিলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী এবং অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে কমলা চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন। পরে দুর্ভিক্ষ-মহামারী থেকে দুর্গতদের রক্ষা করার জন্যে ঐ বছরই তৈরি হয় পিপলস রিলিফ কমিটি”; কমলা এখানেও সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৩ সালে তিনি “মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি” মারফত দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের কাজে যুক্ত ছিলেন।

১৯৪৪ সালে দুস্থ ও নিরাশ্রয় মেয়েদের আশ্রয় দান ও জীবিকা অর্জনের সুবিধা করে দেবার জন্য কয়েকজন বিশিষ্ট মহিলা ১৯৪৪ সালে “নারী সেবা সংঘ” সংগঠন করেন। এই কাজে কমলা চট্টোপাধ্যায় একজন প্রধান উদ্যোগী ছিলেন।

নোয়াখালি দাঙ্গার পর সেখানে গিয়ে তিনি রিলিফের কাজ করেন। ১৯৪৬ এবং ১৯৪৭ সালে কলিকাতা দাঙ্গার সময়ও তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য বিশেষ চেষ্টা করেন। তিনি চাকুরি করতে করতে এম, এ, ও বি. টি. পাস করেন। স্বদেশী যুগ ও মহিলা আন্দোলনের ইতিহাস লেখা ও বলায় এবং অন্যান্য প্রগতিমূলক কাজে তিনি নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। তার আশা তার এই অভিযান জীবনের শেষ দিন অবধি থামবে না।

১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ শান্তি, প্রগতি ও সমাজ কল্যাণের লক্ষ্যকে সামনে রেখে নাম বদলে হয় ‘পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতি’। ৭৩ জনের একটি প্রাদেশিক কাউন্সিল গঠন করেন তারা এবং কাউন্সিল থেকে ৩২ জনকে নিয়ে গঠিত হয় প্রাদেশিক কার্যকরি কমিটি। শোভা হুই’এর নেতৃত্বে কমলা চট্টোপাধ্যায় স্থান করে নেন এই কমিটিতে।

প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার (১৯৬৭-৬৮) নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিলেও। কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে তখন যে তীব্র মতবিরোধ দেখা যায়, মহিলা সমিতিতেও তার প্রভাব পড়ে সরাসরি। পরে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হলে রাজ্যের নেত্রীদের মধ্যে কনক মুখার্জি, জ্যোতি চক্রবর্তীরা যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’তে; কমলা চট্টোপাধ্যায়, গীতা মুখার্জি প্রমুখ চলে যান দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিতে। তবে যে দলে, যে মতবাদ নিয়েই থাকুন, কমলা সংগ্রামী জীবন থেকে কোনও দিন মুখ ফিরিয়ে নেননি।

তথ্যসূত্র:

১. কমলা দাশগুপ্ত (জানুয়ারি ২০১৫)। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী, অগ্নিযুগ গ্রন্থমালা ৯। কলকাতা: র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন। পৃষ্ঠা ১৫২-১৫৩। আইএসবিএন 978-81-85459-82-0

Leave a Comment

error: Content is protected !!