ক্ষীরোদাসুন্দরী চৌধুরী ছিলেন যুগান্তর দলের বিপ্লবী

ক্ষীরোদাসুন্দরী চৌধুরী বর্তামান বাংলাদেশর ময়মনসিংহ জেলার একটি গ্রামে জন্মেছেন। বিয়ের পরেই রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের পেটোয়া বাহীনির চোখকে ফাকি দিয়ে বিপ্লবীদের বাঁচিয়েছিলেন। পুলিশ যাতে বিপ্লবীদের অবস্থান চিহ্নিত না করতে পারে সেজন্য কয়েক মাস পরে পরে বাসা পরিবর্তন করেছিলেন। সেসময়ের বিপ্লবীদের কাছে তিনি মা নামে পরিচিত ছিলেন।[১]

জন্ম:

ক্ষীরোদাসুন্দরী চৌধুরী ১৮৮৩ সালে ময়মনসিংহ জেলার সুন্দাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃকভূমিও সেখানেই। পিতার নাম শিবসুন্দর রায় ও মাতা দুর্গাসুন্দরী দেবী। তিনি ছিলেন বিপ্লবীদের মা।

ক্ষীরোদাসুন্দরী চৌধুরী-এর বৈবাহিক জীবন:

ময়মনসিংহের খারুয়া গ্রামের ব্রজকিশোর চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। তাঁর যখন ৩২ বা ৩৩ বছর বয়স তখন একটিমাত্র কন্যা নিয়ে তিনি বিধবা হন। বিপ্লবী ক্ষিতীশ চৌধুরী ছিলেন তাঁর দেওরপুত্র। ক্ষিতীশ চৌধুরী এবং ময়মনসিংহের বিপ্লবী নেতা সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ (পরে বি.পি.সি.সি.-র প্রেসিডেন্ট) ক্ষীরোদাসুন্দরী চৌধুরীকে বিপ্লবী প্রতিষ্ঠান ‘যুগান্তর’ দলভুক্ত করে নেন।

রাজনৈতিক কাজ:  

১৯১৬ সালের ৩০ জুন কলিকাতার গোয়েন্দা-পুলিসের ডেপুটি সুপারিনটেন্ডেন্ট বসন্ত চ্যাটার্জীর হত্যার পর সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ ও ক্ষিতীশ চৌধুরীর নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা বের হয়। তারা ময়মনসিংহে পলাতক রইলেন ক্ষীরোদাসুন্দরী দেবীকে নিয়ে একটি বাড়ি ভাড়া করে। ক্ষীরোদাসুন্দরী হয়েছিলেন পলাতকদের গৃহকর্ত্রী এবং মা।

তার আশ্রয়ে কিছুদিন পরে এসে থাকতে শুরু করলেন ভারত-জার্মান ষড়যন্ত্রের সর্বপ্রধান নেতা যাদুগোপাল মুখার্জী ও বিপ্লবী নলিনীকান্ত কর। সেই সময় ব্রিটিশ সরকার ঘোষনা করেছিলো, যদি কেউ যাদুগোপাল মুখার্জীকে ধরিয়ে দেয় তাহলে তাকে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।

পলাতকদের এই বাড়িটি ছিল পুলিস ক্লাবের একেবারে কাছে। প্রদীপের তলায়ই হচ্ছে অন্ধকার। অত কাছে থেকেও পুলিস অনেকদিন পর্যন্ত বৃথাই বাইরে বাইরে এঁদের খোঁজ করে হয়রান হয়েছে। এই বিপ্লবীরা কিছুদিন পর্যন্ত মা ক্ষীরোদাসুন্দরীকে অবলম্বন করে ময়মনসিংহে পলাতক রইলেন।

সুরেন্দ্রমোহন ঘোষের পিতা কামিনীমোহন ঘোষ ছিলেন এই বিপ্লবী দলের একজন প্রধান ও অতিশয় শ্রদ্ধেয় কর্মী। পুত্রের নেতৃত্ব পিতা কামিনীমোহন ঘোষ অম্লানবদনে মেনে চলতেন। তিনি এঁদের সঙ্গে বাইরের কাজের ও কর্মীদের যোগাযোগ রক্ষা করতেন।

একদিন বিপ্লবীরা পুলিসের অস্বাভাবিক তৎপরতার খবর পেলেন। তৎক্ষণাৎ সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ বাদে এই দল মা ক্ষীরোদাসুন্দরীকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের দেওভোগে চলে গেলেন। সেখানে মাস দুই তারা অবস্থান করেন। পুলিস কমিশনার টেগার্ট তখন সারা বাংলায় বেড়াজাল ফেলে রেখেছে বিপ্লবী নেতা যাদুগোপাল মুখার্জী ও অন্যান্যদের গ্রেপ্তারের জন্য। এই বেড়াজাল ভেদ করে ছিটকে সরে গেলেন তারা মা ক্ষীরোদাসুন্দরী দেবীকে নিয়ে সরিষাবাড়ি।  

কিছুদিন বাদে এখানেও পুলিসের ভিতরে চাঞ্চল্য লক্ষ্য করে তারা বিদ্যুৎবেগে অন্তর্হিত হলেন জামালপুরে। জামালপুরে যে বাসা ভাড়া করা হলো সেখানেও মা হয়ে আশ্রয় দিলেন ক্ষীরোদাসুন্দরী চৌধুরীই। জামালপুরের এই আশ্রয়ে রইলেন যাদুগোপাল মুখার্জী, নলিনীকান্ত কর, সতীশ ঠাকুর, নগেন্দ্রশেখর চক্রবর্তী, কুশা রায়, ক্ষিতীশ বসু ও পৃথ্বীশ বসু।

জামালপুরে প্রায় দেড়মাস থাকার পর সেখানকার আশ্রয়ও পুলিসের নজরে পড়ে গেছে সন্দেহে, তড়িৎগতিতে এই দল পলাতক হলেন সিরাজগঞ্জে। ক্ষীরোদাসুন্দরী চৌধুরীর সঙ্গে এঁদের সম্পর্ক অন্তরে এবং বাইরে হয়েছিল মাতা পুত্রের। অসুস্থ মায়ের কবিরাজী চিকিৎসার জন্য যেন তারা সিরাজগঞ্জে গেছেন এই কথা ছিল বাইরে প্রকাশ।

প্রায় তিনমাস এখানে পলাতক থাকার পর পুনরায় তারা সন্দেহ করলেন যে, পুলিস খবর পেয়ে গেছে এই আস্তানার। চক্ষের নিমেষে তারা পালিয়ে গেলেন ধুবড়িতে। পলাতক নলিনীকান্ত কর ও সতীশ ঠাকুরকে আগে থেকেই ধুবড়িতে পাঠানো হয়েছিল সেখানে একটা ভাতের হোটেল খুলতে। সেখানে গিয়ে হঠাৎ উপস্থিত হলেন যাদুগোপাল মুখার্জী, কামিনীমোহন ঘোষ, ক্ষিতীশ বসু, পৃথ্বীশ বসু, কুশা রায়, ক্ষিতীশ চৌধুরী, নগেন্দ্রশেখর চক্রবর্তী, গিরীন্দ্রনাথ রায় এবং মা ক্ষীরোদাসুন্দরী।

ঐ দুই পলাতক বিপ্লবী হোটেল মালিকের আড়ালে লুকিয়ে রইলেন এতগুলি বিপ্লবী মানুষ। দুইদিন পরে তাঁরা একটা আলাদা বাসা ভাড়া করে হোটেল থেকে পৃথক রইলেন। সকলেই মা ক্ষীরোদাসুন্দরীর দায়িত্বে পলাতক রইলেন সেই ভাড়া বাড়িতে প্রায় দেড়মাস। তারপর তারা এখান থেকে উধাও হয়ে আসামের বিন্নাখাতা গ্রামের ছনখেতের মধ্যে তৈরি একটি বাড়িতে চলে গেলেন। সাপটগ্রাম স্টেশন থেকে প্রায় ১৪ মাইল দূরে ছিল এই বিন্নাখাতা গ্রাম।

প্রায় দুইমাস এখানে গৃহকর্ত্রী হয়ে ছিলেন মা ক্ষীরোদাসুন্দরী। এই সময়ে তার আত্মীয় স্বজন এবং অন্যান্য সকলেই এতদিন পর্যন্ত তার খবর না পেয়ে আশঙ্কিত হয়ে খোঁজ করতে আরম্ভ করেন। নানা কথা উঠতে থাকে। তখন মা ক্ষীরোদাসুন্দরীকে আর আশ্রয়দাত্রীরূপে রাখা বিপ্লবীরা নিরাপদ মনে করলেন না। তারা তাকে প্রথমে কাশী পাঠিয়ে দিলেন, পরে তার শ্বশুরবাড়ি খারুয়াতে। কাশীতে যে বাড়িতে তিনি কয়েকদিন ছিলেন সে-বাড়ির একটা খাতায় তিনি নিজের নাম ও ঠিকানা লিখে রাখলেন দলের নেতাদের নির্দেশে।

ময়মনসিংহে খারুয়ার বাড়িতে পৌছবার পর পুলিস যখন তার বাড়ি ঘেরাও করে তল্লাশী এবং জেরা করল তার এতদিনের অবস্থান ও কার্যকলাপ সম্পর্কে, তখন মা ক্ষীরোদাসুন্দরী অতি ভালোমানুষের মতো জবাব দিলেন যে তিনি কাশীতে ছিলেন। পুলিস কাশীর সেই বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়ে দেখল সত্যি সে বাড়িতে তাঁর নাম ঠিকানা লেখা রয়েছে। পুলিস শত জেরা করেও সন্দেহ করার শর্তেও কিছু তার কাছ থেকে আদায় করতে না পেরে নিরাশ হয়ে ফিরে গেল।

৭৬ বছর বয়সেও তার অতীত স্মৃতি মন্থন করে তিনি সেই ১৯১৬, ১৯১৭ সালের কাহিনী লাজনকণ্ঠে বলে গেলেন। সেই দিন সামাজিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ নারীর এই দুঃসাহসিক যাত্রা ও তার কীর্তি পদচিহ্ন রেখে গেছে পরবর্তীকালের কর্মীদের জন্য।[২]

তথ্যসূত্র:

১. দোলন প্রভা, ২৮ জুন, ২০১৮, “ক্ষীরোদাসুন্দরী চৌধুরী বাংলার উপনিবেশবাদ বিরোধী নারী বিপ্লবী”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএলঃ https://www.roddure.com/biography/khiroda-sundori-chowdhury/

২. কমলা দাশগুপ্ত (জানুয়ারি ২০১৫)। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী, অগ্নিযুগ গ্রন্থমালা ৯। কলকাতা: র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন। পৃষ্ঠা  ৬৩-৬৪। আইএসবিএন 978-81-85459-82-0।

Leave a Comment

error: Content is protected !!