কমলা দাশগুপ্ত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলের বিপ্লবী নেতৃত্ব

কমলা দাশগুপ্ত ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী নেত্রী। যুগান্তর দলের বিপ্লবীদের সাথে ব্রিটিশবিরোধী কাজ করেছিলেন। মেয়েদের আন্দোলনে যুক্ত করার জন্য ছাত্রাবস্থা থেকেই প্রচার প্রচারনা কাজ করেছেন। পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন। নোয়াখালী দাঙ্গায় বিপদাংকুল মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। রাজনৈতিক কাজের জন্য কারাবরণ করতেও হয়েছিলো।

জন্ম ও পরিবার

১৯০৭ সালের ১১ মার্চ কমলা দাশগুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন ঢাকা শহরে। পিতৃভূমি ঢাকা জিলার বিক্রমপুরের বিদগাঁও গ্রামে। তার পিতা সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত স্বামী বিবেকানন্দের সান্নিধ্যে এসে স্বামীজীর ত্যাগ ও সেবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান ও পরোপকারী। মা চারুলতা ছিলেন শান্ত, বুদ্ধিমতী এবং দেশাত্মরোধে উদ্বুদ্ধ।

শিক্ষাজীবন

১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন কমলা দাশগুপ্ত এবং ২ বছর ধরে ১৩ টাকা করে ব্রহ্মময়ী তারাসুন্দরী বৃত্তি পান। ১৯২৮ সালে কমল দাশগুপ্ত বি,এ পাস করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম,এ, পড়তে থাকে। বেথুন কলেজে পড়ার সময়েই তার মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ হয়। তখন মহাত্মা গান্ধীর যাদুমন্ত্র অসাড় ঘুমন্ত জাতি ধীরে ধীরে জেগে উঠছিল। অন্যদিকে ছিল গুপ্ত বিল্পবের পথে একটা রহস্যময় আকর্ষণ।

কমলা দাশগুপ্ত স্তরের তাগিদে গান্ধীজীকে একখানা চিঠি লিখে ফেললেন যে সবরমতী আশ্রমে তিনি গান্ধীজীর কাছে থাকতে চায় এবং দেশের কাজ করতে চান। সঙ্গে সঙ্গেই জবাব এল, “বাবা মায়ের অনুমতি নিয়ে চলে এসো।” বাবা মায়ের অনুমতি পাওয়া কমলার সম্ভব ছিল না। হল না তার গান্ধীজীর কাছে যাওয়া। তবু কিন্তু জীবনের নানা পথ অতিক্রম করে অবশেষে পথের এক বাঁকে এসে দেখেন, তিনি রয়েছেন গান্ধীজীরই কাছে।

কমলা দাশগুপ্ত-এর রাজনৈতিক কাজে যুক্ততা

ওদিকে ছাত্রীসংঘের কর্মী হিসাবে কমল দাশগুপ্তর ১৯২৮ সালে লাঠিখেলা শিখতেন দীনেশ মজুমদারের কাছে। তিনি ছিলেন বিপ্লবী যুগান্তর দলের সভ্য। একদিন কমলা শিক্ষক দীনেশ মজুমদারকে বললেন, দেশের কাজ করতে তিনি ইচ্ছুক, সেজন্য আলোচনা করতে চান। দীনেশ নিয়ে গেলেন তাঁকে শ্রদ্ধেয় রসিকলি দাসের কাছে।

নেতা রসিকলাল দাস ভারতবর্ষের ইতিহাস এবং তার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের বিশ্লেষণ এমনভাবে করতেন যে কমলার মনে হয়েছিল এই বিপ্লবের পথই তার পথ। তিনি বিপ্লবী যুগান্তর দলে যোগদান করলেন ১৯২৯ সালে।

১৯৩০ সালে বিপ্লবী কাজের প্রয়োজনে কমল দাশগুপ্তকে একটা মেয়েদের হোস্টেলে বাড়ি ছেড়ে থাকতে হয়। তিনি হলেন হোস্টেলের ম্যানেজার। একদিন নেতা রসিকলাল তাকে বললেন একটা বিপ্লবী প্রচেষ্টা চলছে। সেজন্য কতগুলি বোমা তৈরি হয়েছে। বোমাগুলি যেখানে আছে সেখানে রাখা আর নিরাপদ নয়। সেগুলি কমলা দাশগুপ্ত তাদের হোস্টেলে রাখার দায়িত্ব নিতে পারেন কিনা। কমলা তো বিপ্লবের কাজে লাগতে পারবেন বলে বিপদের ঝুকি জেনেই সাগ্রহে রাজী। সেদিন রাত্রে এক বিরাট ধামায় ভর্তি বোমা এল তাদের হোস্টেলে। ধামার উপরটা ছিল ফল দিয়ে ঢাকা। কমলা দাশগুপ্ত সেগুলি তাঁর ট্রাঙ্কে বোঝাই করে রেখে দিলেন। কতকগুলি রাখলেন ছোটো ছোটো সুটকেসে। সুটকেসগুলি রাখলেন ভাড়ার ঘরে। ম্যানেজার হিসাবে ভাড়ার ঘরের চাবি থাকত তারই কাছে। একটু অসতর্ক হলেই সর্বনাশ।

বিপ্লবী রসিকলাল এক-একদিন এক-একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে সাংকেতিক পরিচয় দিয়ে পাঠিয়ে দেন। কমলা কয়েকটা করে বোমা ছোটো এক-একটা সুটকেসে ভরে তাকে দিয়ে দেন নিঃশব্দে। কখনো বা নিজে নানা বেশে গিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিয়ে আসেন।

ডালহাউসি স্কোয়ার বোমা ষড়যন্ত্র মামলা

১৯৩০ সালের ২৫ আগস্ট দীনেশ মজুমদার, অনুজাচরণ সেন, অতুল সেন ও শৈলেন নিয়োগী ডালহাউসি স্কোয়ারে গিয়েছিলেন কলকাতার কুখ্যাত অত্যাচারী পুলিস চার্লস টেগার্টকে ইহালোক থেকে সরিয়ে দেবার জন্য। টেগার্ডের গাড়ি লক্ষ্য করে বোমার আক্রমণ ও বিস্ফোরণ হল। কিন্তু টেগার্ট কোনোরকমে বেঁচে যায়। নিহত হন অনুজা সেন ও গ্রেপ্তার হন দীনেশ মজুমদার। অতুল সেন ও শৈলেন নিয়োগী ধরা পড়লেন না। দীনেশ মজুমদার যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের দণ্ড মাথায় নিয়ে মেদিনীপুর জেলে বন্দীজীবন যাপন করছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে পালিয়ে যান এবং নানা বৈপ্লবিক ঘটনায় যুক্ত হবার ফলে তার ফাঁসি হয় ১৯৩৪ সালের ৯ জুন।

কমলা দাশপ্তকেও ডালহাউসি স্কোয়ার বোমা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে গ্রেপ্তার করে ১৯৩০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। কিন্তু ২০/২১ দিন হাজতে রেখে ঐ বোমা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়াতে না পেরে মুক্তি দেয়।

গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন হত্যার পরিকল্পনায় ও কারাবরণ

মুক্তির পর কমলা একটা স্কুলে শিক্ষকতার কাজ নেন। ১৯৩২ সালের জানুয়ারি মাসে একদিন তিনি তার বন্ধু কল্যাণী দাসের বাড়িতে গেছেন। কল্যাণী তখন আইন অমান্য আন্দোলন যোগদান করে জেলে গেছেন। তার ছোটো বোন বীণা দাস কমলা দাশগুপ্তকে আস্তে করে বললেন, “আমার ইচ্ছা গভর্নরকে গুলী করি। তুমি আমাকে রিভলবার দেবে?” সেই বছরে বীণার কনভোকেশন হল থেকে বি. এ. ডিগ্রী আনবার কথা। কনভোকেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য গভর্নর আসেন ডিগ্রী দিতে। কমলা এই কাজের বিপদের দিকটা বীণাকে দিনের পর দিন বোঝাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু বীণা ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

এদিকে কমলা দাশগুপ্ত আলোচনা করতে থাকেন তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী সুধীর ঘোষের সঙ্গে। আলোচনার ধারাটা ছিল এই যে বিদেশী শাসনের এক প্রধান প্রতিভূ গভর্নরকে আঘাত করতে পারলে বিপ্লবের যে আলোড়নকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেটা উঠবে একটা উচ্চ শিখরে। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন গভর্নরকে গুলী করা হবে এবং গুলী করার দায়িত্ব গ্রহণ করা হবে।

একদিন সুধীর ঘোষ রিভলবার সংগ্রহ করে আনলেন। কমলা বীণাকে নিয়ে বসলেন রামমোহন লাইব্রেরিতে একাট নিরিবিলি ঘরে। কমলা দাশগুপ্তা রিভলবারের প্রতিটি অংশ খুলে বুঝিয়ে দিয়ে বীণা দাসের হাতে তুলে দিলেন সেই অগ্নিনালিকা।

১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সেনেট হলে কনভোকেশনের সময় অভিভাষণ পাঠকালে গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে বীণা দাস গুলী করেন, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এর ফলে কলকাতা ও সারা ভারতবর্ষে জেগেছিল প্রচন্ড উত্তেজনা। গভর্নরের মৃত্যুটাই বড় কথা নয় বড় কথা হচ্ছে ইংরেজ শাসনের ভিত্তিতে কতখানি আঘাত লেগেছে এবং দেশের লোকের মনে কতখানি সাড়া জেগেছে। এটাই ছিল সফলতার মাপকাঠি।

বহু চেষ্টা করেও পুলিস জানতে পারে নাই বীণার কাজের পশ্চাতে কারা জড়িত ছিলেন। কিন্তু সন্দেহক্রমে অনেকের সঙ্গে কমলা ও সুধীরকে কয়েকদিনের মধ্যেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। কমলা দাশগুপ্তকে ১৯৩২ সালের ১ মার্চ গ্রেপ্তার করে প্রেসিডেন্সি জেলে ও পরে হিজলী জেলে রাজবন্দী করে রেখে দেয়। মুক্তি পান তিনি ১৯৩৮ সালে।

কমলা দাশগুপ্ত-এর গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ

১৯৩৮ সালে বিপ্লবী দলগুলির অনেক নেতাও মুক্তি পেয়েছিলেন। বিপ্লবীদের সশস্ত্র এবং গুপ্ত আন্দোলনের ফলে মুষ্টিমেয় বীরদের চরম ত্যাগের আদর্শ দেশময় প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু, তাদের গণসংযোগ এবং গণসংগ্রাম হয় নি। গণসংগ্রাম ব্যতীত স্বাধীনতা আসতে পারে না। যুগান্তর দলের নেতারা ১৯৩৮ সালে চেয়েছিলেন গণসংযোগ এবং গণসংগ্রাম। তারা চেয়েছেন সর্বাধিক লোকের চরম ত্যাগ।

অন্যদিকে মহাত্মা গান্ধী একটার পর একটা গণ-আন্দোলন করে কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে সমস্ত জাতিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এতদিন তার আন্দোলন প্রবাহে ছিল সর্বাধিক লোকের অল্প ত্যাগ। এখন ১৯৩৮ সালে তিনিও চাইলেন সর্বাধিক লোকের চরম ত্যাগ। বিপ্লবীদের সঙ্গে গান্ধীজীর আলোচনা হয় এবং এ বিষয়ে তাদের মতের মিল হয়। তখন যুগান্তর দল নিজেদের আলাদা নাম ও রূপ লোপ করে পুরোপুরিভাবে কংগ্রেসে যোগ দিল ১৯৩৮ সালে। দলের নেতা ডাঃ যাদূগোপাল মুখার্জি এই সম্পর্কে কাগজে একটি বিবৃতি দেন ১৯৩৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর।

কর্মজীবন ও সম্পাদিকা হিসাবে দায়িত্ব পালন

কমলাও কংগ্রেসে যোগ দিলেন। এই সময়ে কমলা দাশগুপ্তের উপর ভার পড়ে মন্দিরা’ নামে একটি রাজনৈতিক মাসিক পত্রিকার সম্পাদিকা হবার। ‘সন্ধ্যা’, ‘যুগান্তর’, ‘বন্দেমাতরম্‌’, ‘স্বাধীনতা’ প্রভৃতি পত্রিকাগুলির মতো ‘মন্দিরা’রও উদ্দেশ্য ছিলো দেশাত্মবোধের উদ্দীপনা ও প্রেরণা জাগাবার, বিশেষত মেয়েদের মধ্যে।

মন্দিরা’ মাসিক পত্রিকার সম্পাদিকা ছিলেন-

কমলা চট্টোপাধ্যায় – বৈশাখ ১৩৪৫ কার্তিক ১৩৪৫।

কমলা দাশগুপ্ত— অগ্রহায়ণ ১৩৪৫ শ্রাবণ ১৩৪৯- পৌষ ১৩৫২—চৈত্র ১৩৫৪।

স্নেহলতা সেন— ভাদ্র ১৩৪৯—অগ্রহায়ণ ১৩৫২। (এই সময় কমলা দাশগুপ্ত জেলে ছিলেন।)

১৯৪১ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের মহিলা বিভাগের সম্পাদিকা হলেন কমলা দাশগুপ্ত। তিনি অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জেলা ও গ্রামে গিয়ে মেয়েদের কংগ্রেসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ও সংঘবদ্ধ করার কাজে হাত দিলেন। ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন আদর্শ হিন্দু গার্লস হাইস্কুলে এবং ১৯৭২ খ্রীষ্টাব্দে সেখান থেকে অবসর নেন।

নোয়াখালী দাঙ্গায় অংশগ্রহণ

এরপর “ভারত ছাড়ো” আন্দোলন। ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট কংগ্রেস গান্ধীজীর “ভারত ছাড়ো” প্রস্তাব গ্রহণ করার পর ৯ আগস্ট যখন সব নেতাদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় তখন গান্ধীজীর “করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে” মন্ত্রে সারা ভারত উত্তাল হয়ে উঠল। কমলা দাশগুপ্ত আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেলে বন্দী রইলেন ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। ফিরে এসে আবার সেই কর্মস্রোত। ইংরেজ স্বাধীনতা-আন্দোলনকে দুর্বল করে দেবার জন্য বাধিয়ে দিল হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। ১৯৪৬ সালের ১০ অক্টোবর ঘটেছিল নোয়াখালির একতরফা দাঙ্গা। গান্ধীজী ছুটে গেছেন সেখানে।

সেই সময়ে কাগজের একটা বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে ৮৬খানা চিঠি এসে পড়ে কমলার হাতে। চিঠির লেখকরা নোয়াখালির দাঙ্গার সময় ধর্ষিতা মেয়েদের বিবাহ করতে ইচ্ছুক। কংগ্রেসের মহিলা বিভাগের সম্পাদিকা রূপে কমল দাশগুপ্তাকে পাঠানো হল। গান্ধীজীর কাছে ঐ চিঠিগুলি দিয়ে ১৯৪৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর। নোয়াখালির গভীর অভ্যন্তরে শ্রীরামপুর গ্রামে তখন অবস্থান করছেন গান্ধীজী। তার সেক্রেটারি প্রফেসার নির্মলকমার বোস কমলার ৮৬খানা চিঠি হাতে নিয়ে চলে গেলেন গান্ধীজীর ঘরে। সঙ্গে সঙ্গেই ডাক পড়ল। কমলারা ঘরে ঢুকবার আগেই গান্ধী হাসিমুখে তাদের নমস্কার করছেন যেন তারা তার চির আপন। সেদিন ছিল তার মৌন দিবস। তিনি লিখে দিলেন :

“Personally I do not think the extent of the evil is so great. Many such cases have not come under my observation. In any case you may keep in mind the young men who will take in such girls and see what can be done when you come across a bonafide case.” অর্থাৎ “এমন অশুভ ঘটনার সংখ্যা এত বেশি বলে আমি মনে করি না। এরকম ঘটনা খুব বেশি আমার নজরে আসে নি। যাই হোক, যে-সব যুবক এমন মেয়েদের বিয়ে করতে চায় তাদের কথা মনে রেখো এবং যখন এরকম প্রকৃত ঘটনার সন্ধান পাবে তখন কী করতে পার দেখো।”

তারপর বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতে কমলা বহু রিলিফ ক্যাম্প ঘুরলেন। ওরকম দুই একটি মেয়ে তিনি যা পেয়েছেন তারা ছিল ১৪ বছরের নীচে। যে দুই-একজন বয়স্কা মহিলা ছিলেন তারা বিবাহিতা এবং স্বামীরা তাদের নিয়ে ঘর করছেন। কাজেই কমলা বিবাহ ব্যবস্থা করতে পারলেন না।

সুচেতা কৃপালানী কমলাকে দিয়ে বিজয়নগর গ্রামে একটা কর্মকেন্দ্র স্থাপন করালেন। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে শান্তি ও প্রীতি ফিরিয়ে আনা ছিল তাদের কাজ। একদিন সতীশ দাশগুপ্ত খবর পাঠালেন গান্ধীজী নোয়াখালিতে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য গ্রামের পর গ্রামে যে পদ-পরিক্রমা করে চলেছিলেন তার মধ্যে পড়বে বিজয়নগর কেন্দ্রও। ৯ এবং ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭ সালে দুই দিন থাকবেন তিনি কমল দাশগুপ্তদের কেন্দ্রে। ১৯৪৭ সালের ২ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছিল নোয়াখালিতে গান্ধীজীর ঐতিহাসিক পদযাত্রা। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের মধ্যে আছে শুভবুদ্ধি। সেই অন্তর্নিহিত শুভবুদ্ধিকে জাগিয়ে তুলতে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে নগ্নপায়ে চলেছিলেন সাতাত্তর বছরের বৃদ্ধ পিতা।

৯ ফেব্রুয়ারি তাঁকে কমলা দাশগুপ্তরা নন্দীগ্রাম থেকে নিয়ে এলেন বিজয়নগর কেন্দ্রে। রাস্তায় সবাই মিলে রামধুন গাইছিলেন, “যো হি আল্লা সো হি রাম, সবুকো সন্মতি দে ভগবান, রঘুপতি রাঘব রাজারাম….” গান্ধীজী একহাতে সেলাম, অন্যহাতে নমস্কার করে চলেছেন। তার করুণ দৃষ্টিতে কী গভীর অনুরাগভরা আবেদন ফুটে উঠেছে। প্রেম দিয়ে তিনি প্রতিপক্ষকে জয় করবেন, তাদের হৃদয় স্পর্শ করবেন, এই ছিল তার সাধনা, এই তার জীবন দর্শন।

সেদিন সন্ধ্যায় তার প্রার্থনা সভায় যেতে ভীত দ্বিধাগ্রস্ত কুলবধূদের গান্ধীজী নিজে আহ্বান করে সঙ্গে নিয়ে চলেছিলেন। সেই জনতায় ছিল হিন্দু-মুসলমান, নারী-পুরুষ সকলেই। তারা সবাই একে অন্যের আপন। ১১ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটায় চলে যাচ্ছেন তিনি বিজয়নগর ছেড়ে। আবার কমলা দাশগুপ্তের কাঁধে হাত রেখে চলেছেন গান্ধীজী। প্রায়ই তিনি সেলাম ফিরে পাচ্ছিলেন না। কমলা থাকতে না পেরে বলে উঠলেন, গান্ধীজী আপনাদের সেলাম করছেন, আপনারাও করুন। গান্ধীজী বললেন, ওরা নাইবা করল, আমার কর্তব্য আমি করে যাব। একলাই তো চলতে হবে। তিনি গানটা গাইতে বললেন। যাঁরা সঙ্গে ছিলেন তারা গাইতে লাগলেন, “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।”

জগতে অহিংসা ও প্রেমের উচ্চতর সভ্যতা আনতে চেয়েছিলেন যে-গান্ধীজী তিনি দিল্লীতে প্রার্থনা সভায় হিংসার গুলীতে তার ক্ষণভঙ্গুর দেহখানি রেখে গেলেন। আদর্শের জন্য বুকের রক্ত দিয়ে তিনি অমৃতের সন্ধান পেয়েছিলেন। কমলার তুচ্ছ জীবন এমন সব অসামান্য দুর্লভ রত্নের সংস্পর্শে এসে অনুভব করেছিল, “সার্থক জনম আমার, জন্মেছি এই দেশে”। স্বাধীনতা আসার কয়েক বছর পরে কমলা দাশগুপ্তা লিখেছিলেন নিজের জীবনকথা “রক্তের অক্ষরে” নামক পুস্তকে। পরে লিখেছিলেন তিনি “স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী” গ্রন্থ। তিনি ১৯ জুলাই ২০০০ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

তথ্যসূত্র:

১. কমলা দাশগুপ্ত (জানুয়ারি ২০১৫)। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী, অগ্নিযুগ গ্রন্থমালা ৯। কলকাতা: র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন। পৃষ্ঠা ১০১-১০৬। আইএসবিএন 978-81-85459-82-0

Leave a Comment

error: Content is protected !!